মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে ধরাশায়ী আমেরিকার শেয়ার বাজার। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনছেন তিনি?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ১০:৩৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের জের। হু-হু করে নামল আমেরিকার শেয়ার সূচক। ওয়াল স্ট্রিট রক্তাক্ত হওয়ায় আটলান্টিক-পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটিতে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। এ বার কী তবে মন্দার কবলে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র? তার কতটা প্রভাব সইতে হবে ভারতকে? ইতিমধ্যেই সেই হিসাব কষা শুরু করে দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০২১৮
আমেরিকা যে মন্দার কবলে পড়তে পারে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সম্প্রতি ফক্স নিউজ়ের মারিয়া বার্তিরোমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সেখানে আর্থিক মন্দা সংক্রান্ত প্রশ্নে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমি এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে ঘৃণা করি।’’
০৩১৮
এর পরই বিষয়টি খোলসা করেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘প্রশাসন এখন বড় পদক্ষেপ করছে। এটা রূপান্তরের সময়। ফলে আর্থিক অস্থিরতা আসতেই পারে।’’ বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্পের এ হেন মন্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন লগ্নিকারীরা। আর তাই দ্রুত আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন তাঁরা। এই অবস্থা আরও কয়েক দিন বজায় থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
০৪১৮
ট্রাম্পের মন্তব্যের পর আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে রাতারাতি গায়েব হয়ে যায় চার লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু, পরিস্থিতি মন্দার দিকে গড়াচ্ছে কি না, তা এখনই স্পষ্ট নয়। এ বছরের ২ এপ্রিল থেকে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করবে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে আগামী দিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য কঠিন হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
০৫১৮
কী ভাবে মন্দা নির্ধারণ করা হবে, তার একটি সহজ নিয়ম রয়েছে। এটি নির্ধারণ করে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ’ (এনবিইআর)। টানা কয়েক মাস ধরে কোনও দেশের অর্থনৈতিক সূচক নিম্নমুখী থাকলে সেখানে মন্দা এসেছে বলে জানিয়ে থাকে এই সংস্থা। তিনটি মূল মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই বিষয়টি ঘোষণা করে এনবিইআরের ‘বিজ়নেস সাইকেল ডেটিং কমিটি’।
০৬১৮
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, মন্দা মূলত দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সূচকের পতন, তার প্রভাব ও বিস্তার এবং সময়কালের উপর ধার্য করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্দা ঘোষণার অনেক আগে থেকে এটি চালু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, পর পর দু’টি ত্রৈমাসিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস বা জিডিপি) সূচক নিম্নমুখী থাকলে সেখানে মন্দা এসেছে, তা ধরে নেওয়া যেতে পারে।
০৭১৮
অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ডাকো আবার এই তত্ত্বের প্রবল বিরোধী। তাঁর কথায়, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশের জিডিপির হার অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কোনও কারণে আমদানি বৃদ্ধি পেলেও এর সূচক নিম্নমুখী হতে পারে। কিন্তু, তার জন্য যে অর্থনীতি মন্দার গ্রাসে চলে গিয়েছে, এমনটা না হতেও পারে।’’
০৮১৮
চলতি বছরের শেষ তিন মাসে মার্কিন অর্থনীতির সূচকে ২.৪ শতাংশ পতন লক্ষ করা গিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলেও তা বেকারত্বের হারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সেখানে ৪.১ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতির হার। ফলে খরচের ব্যাপারে সতর্ক হচ্ছেন সাধারণ আমেরিকাবাসী।
০৯১৮
দ্বিতীয়ত, সরকারি ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার ঘোষণা না হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে চাকরি ছাঁটাইয়ের প্রবণতা। এটিও মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর্থিক বিশ্লেষকদের বড় অংশেরই দাবি, ট্রাম্প জমানায় আমেরিকায় মন্দার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, খুব ঘন ঘন নীতি বদল করছেন তিনি। এতে বাজার অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১০১৮
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর ট্রাম্প প্রথমে কানাডা, মেক্সিকো এবং চিনের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই কানাডা এবং মেক্সিকোর ক্ষেত্রে শুল্কের বিষয়টি সাময়িক ভাবে স্থগিত করার কথা ঘোষণা করে দেন তিনি।
১১১৮
একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কুর্সিতে বসে নয়াদিল্লিকে ‘শুল্কসম্রাট’ বলে কটাক্ষ করেন ট্রাম্প। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওয়াশিংটন সফরে গেলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন তিনি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করার কথাও বলতে শোনা যায় তাঁকে।
১২১৮
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ বছর ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে কিছু দিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লি আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ওই সময়ে ট্রাম্পের উপস্থিতিতে এই চুক্তির চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
১৩১৮
আমেরিকায় মন্দা এলে তার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, মুখে এক এবং কাজে আর এক রকমের পদক্ষেপ করছেন ট্রাম্প। হঠাৎ কোনও দেশের উপর শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। পর ক্ষণেই সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখছে ওয়াশিংটন। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে ভুগছে মার্কিন বণিক মহল। তা ছাড়া কোনও ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের এ হেন নীতিকে সব সময়েই সন্দেহের চোখে দেখে গোটা বিশ্ব।
১৪১৮
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন অর্থনীতিবিদ জেপি মর্গ্যান। তাঁর কথায়, ‘‘মার্কিন শেয়ার বাজারে কৌশলগত মন্দার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। তবে সেটা এখনও ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি।’’ যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার আরও বাড়লে আমেরিকার অর্থনীতি বড়সড় চাপের মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
১৫১৮
বেরেনবার্গ ব্যাঙ্কের ইউরোপীয় অর্থনীতিবিদ হোগলার স্মিডিং বলেছেন, ‘‘ট্রাম্পের নীতি দীর্ঘ মেয়াদে আমেরিকার আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে।’’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ‘বিভ্রান্তি এবং বিশৃঙ্খলা’র এজেন্ট বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
১৬১৮
মার্কিন শেয়ার সূচকের পতনের প্রভাব সবার আগে কানাডা এবং মেক্সিকোর উপর পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চিন, জাপান-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতিতেও চাপ আসার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি মোটা অঙ্কের লোকসানের মুখ দেখতে পারে।
১৭১৮
ট্রাম্প অবশ্য এ সব কিছুকে পাত্তা দিতেই নারাজ। ফক্স নিউজ়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমেরিকায় মোটা অঙ্কের আয়কর ছাড়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র একটা দুর্দান্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিছু ওঠাপড়া থাকলেও সেটা বড় সমস্যা নয়।’’
১৮১৮
মার্কিন প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ আয়করের আওতাভুক্ত। ফলে ট্রাম্প সেখানে ছাড় দিলে অর্থনীতির পক্ষে কতটা লাভ হবে, তা পরিষ্কার নয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর নীতিতে আমেরিকা লাভবান হয় না কি বিপর্যয় ঘটে, সেটাই এখন দেখার।