ভারতের প্রতি মুইজ্জুর এই অমায়িক ব্যবহার দেখেছে সারা বিশ্ব। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনাও চলছে আন্তর্জাতিক মহলে। তবে মুইজ্জু সরকার হঠাৎ করে ভারতের বিষয়ে সুর নরম করলেও দু’বছর আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুইজ্জু সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত এবং মলদ্বীপ— দু’দেশের কূটনৈতির সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল।
মলদ্বীপের প্রাক্তন ওই মন্ত্রীদের মন্তব্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। ঝড় বয়ে যায় ভারত জুড়ে। ভারতে ‘মলদ্বীপ বয়কট’-এর ডাক ওঠে। মলদ্বীপের শয়ে শয়ে টিকিট বাতিল করে দেন ভারতের পর্যটকেরা। ভারতের নামী তারকারাও মলদ্বীপ না গিয়ে লক্ষদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার পক্ষে আওয়াজ তোলেন। এর পরেই ধাক্কা খায় পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্র মলদ্বীপ।
মলদ্বীপের অর্থনীতি পর্যটননির্ভর। সে দেশের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। ভারত থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ সেখানে ঘুরতে যান। কিন্তু ভারতে ‘বয়কট মলদ্বীপ’ রব উঠলে ক্ষতির মুখে পড়ে মলদ্বীপের অর্থনীতি। যেখানে ২০২৩ সালে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা দু’লাখের কাছাকাছি ছিল, ২০২৪ সালে তা কমে হয়ে যায় মাত্র ৪০ হাজার।
মলদ্বীপের বাড়বাড়ন্তে রাশ টানতে উদ্যোগী হয় নয়াদিল্লিও। প্রতিবেশী দেশগুলিকে সাহায্য করার জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখে ভারত। ২০২২-’২৩ এবং ২০২৩-’২৪-এর বাজেটে মলদ্বীপের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল ভারত। ২০২৩-’২৪ সালে মলদ্বীপের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। তবে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দ কমিয়ে ৪০০ কোটি করা হয়েছে।
এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে মলদ্বীপের উপর পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চাপে। চিনের সঙ্গে মলদ্বীপের দহরম-মহরম শুরুর পর সে দিকে নজর পড়েছিল সারা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) সাবধান করে, চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে পারে মলদ্বীপ। কারণ চিনের থেকে দু’হাতে ঋণ নিলেও তা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা নেই মলদ্বীপের।
অন্য দিকে, গত দু’বছরে মলদ্বীপের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে গিয়েছে। বেজিংয়ের তরফে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের অন্দরে। বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও নাকি মলদ্বীপকে নতুন করে সাহায্যদানে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি বেজিং। সৌদি আরব এবং অন্যান্য পশ্চিম এশীয় দেশও মুখ ফিরিয়েছিল মলদ্বীপের থেকে। এর পর সে দেশের অন্দরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির কার্যকারিতা নিয়ে।
গত বছরের জুন মাসে মুইজ্জু প্রথম ভারতে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর তৃতীয় বারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁকে। এর পর আবার অক্টোবরে সস্ত্রীক ভারতে আসেন তিনি। দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়। মাঝে সে দেশের এক মন্ত্রী এসেও দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করে মলদ্বীপের পর্যটনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের দেওয়া অর্থসাহায্য পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঋণখেলাপি হওয়া এড়াতে সক্ষম হন মুইজ্জু। মলদ্বীপকে সে সময় ৭৫.৭ কোটি ডলারের সহায়তা প্রদান করেছিল ভারত। উত্তর মলদ্বীপে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দক্ষিণ মলদ্বীপে একটি সেতু ও সড়ক প্রকল্প, রাজধানী মালেতে একটি বৃহৎ আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প এবং মালেকে তার পশ্চিম শহরতলির দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নতুন সেতু নির্মাণেও সাহায্য করে মোদী সরকার।
মলদ্বীপ সফরে গিয়ে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতীক হিসাবে দ্বীপরাষ্ট্রের সেনার হাতে ৭২টি সামরিক যান এবং কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তুলে দেন মোদী। মুইজ্জুর প্রতিরক্ষা দফতরের নতুন ভবনকে চিহ্নিত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘এটি শক্তিশালী অংশীদারি এবং অটল বিশ্বাসের কংক্রিট দিয়ে নির্মিত।’’ মলদ্বীপ সফরে গিয়ে মোদীর গলায় শোনা গিয়েছিল নয়াদিল্লি-মালে সামরিক সমঝোতা দৃঢ় করার অঙ্গীকারও।
মোদীর মলদ্বীপ সফরের সময় দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকে একাধিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্র জানিয়েছে, সেই আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতের তরফে মলদ্বীপকে সাড়ে ৫৬ কোটি ডলার (প্রায় ৪৮৫০ কোটি টাকা) ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব। ভারতের থেকে নেওয়া মলদ্বীপের বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও হ্রাস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেই সূত্র।
এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ঝুঁকে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ভারতের কাছে ঝোঁকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না মুইজ্জু সরকারের কাছে। আর সে কারণেই নয়াদিল্লির দিকে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের কাছে নতিস্বীকার করে আখেরে লাভই হয়েছে মুইজ্জুর। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy