আমার যখন স্কুলবেলা তখন আমার জীবনের এক মাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, আশপাশ থেকে দল বেঁধে যারা আমাদের পাড়ার পুকুর সকাল থেকে এপার-ওপার করত, ঠিক তাদের মতো যদি আমার জীবনটা হত। কারণ একটাই— অসময়ের স্বাধীনতা। আঁটোসাঁটো জামাজুতো পরে, রক্তচক্ষু স্কুলের তাড়নায় আমি যখন পৃথিবীর সব থেকে নিপীড়িত প্রাণী, তখন পরম সুখে ওরা যেমন করে আর যেখানে যেখানে ঘুরে বেড়াত আমার মনটা তার পিছু নিত। বছরে মাত্র কয়েকটা দিন সেই স্বাধীনতার উত্তাপ পেতাম, পুজোর সময়। যে দিন সকালবেলা উঠে আমাদের বাড়ির গোলবারান্দার নীচে গোছাখানেক বাঁশ পড়ে থাকতে দেখতাম সে দিন থেকেই ‘ছুটি ছুটি’ বলে বুকের মধ্যে আরবি ঘোড়াটা তাল ঠুকতে থাকত। কত তাড়াতাড়ি সেগুলো তর তর করে বাইবার যোগ্য প্যান্ডেলের খাঁচাখানা হয়ে যাবে, ঘুরেফিরে আঙুলগুলো কেবল সেটাই গুনতে চাইত। ডেকরেশন বলতে লম্বা গলি জুড়ে সারি সারি সরু লম্বা বাঁশের গায়ে লটকানো খানকয়েক সাদা টিউবলাইট। কখনও মনে হয়নি আর বেশি কিছুর প্রয়োজন আছে। এক সময় হাঁটি হাঁটি পা পা করে রোঁদে মারার মতো সেয়ানা হলাম। আশপাশের এলাকা ঘুরে টুনিবাল্বে উড়ন্ত পাখি, চলন্ত ট্রেন আর আকাশছোঁয়া প্যান্ডেলের মাহাত্ম্য টের পেলাম। এমনকী, ফুচকা, বোলেগা বা রকমারি নাগরদোলার সম্ভারও যে সে সব পাড়ায় আমাদের থেকে বেশি সে-ও বোঝা গেল। তবে ফেরার পথে বন্ধুরা এক্কেবারে একমত হতাম, ‘এমনটি আর দেখিলাম না আমার যেমন আছে’; দুগগাঠাকুরের মুখখানা আমাদের ইন্দ্রাণী পার্কের মতো আর কোথাও নয়। আজ বুঝি তারই মধ্যে লুকিয়ে ছিল প্রতিযোগিতার চারাগাছ।
তখন কলেজে পড়ি। শুনলাম বালিগঞ্জ কালচারাল না কি একটা পুজো শিরোমণি পুরস্কার পেয়েছে। পরীক্ষা নয়, স্পোর্টস নয়, আঁকা বা গানের কম্পিটিশন নয়। সব পুজোই তো দুগগাপুজো। একটা আর একটার থেকে ভাল হয় কী রকম করে! সময়ের পিঠে ডানা লাগানো থাকে। তাই স্কুলকলেজ পেরিয়ে শুরু হল খেটে খাওয়া। কপালের দোষে বা গুণে সে-ও এক রকম দুর্গাপুজোই। বিপুল আয়োজন, বহু পরিশ্রম, স্বল্পজীবী, বিসর্জন। সিনেমায় নকল ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বানানোর কাজ করি আমি। সততঃ পরিবর্তনশীল সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির উজান বেয়ে হালের দুর্গাপুজো কতকটা সেই পথই নিয়েছে। সেটা ভাল হল না মন্দ হল এ চর্চা চলতেই পারে। আসলে অতীত আর বর্তমানের মন্দ-ভালর দ্বন্দ্বটা চিরকালের। আমাদের সময় গাছের পাতা বেশি সবুজ ছিল, আকাশের রং ঢের নীল ছিল, এ দাবিটা পড়তি প্রজন্মের থেকেই যায়। তবে কি না আজকের পুজোর নিরিখে আমার বোধ হয়, মলাট পাল্টেছে বটে, পুজোর আকাশ, পুজোর খুশি, পুজো ফুরনোর মনখারাপ তো একই রয়েছে। শুধু পুজোর বাজনার সঙ্গে সঙ্গে বাজতে থাকে প্রতিযোগিতা আর পুরস্কারের বাজনা, হারজিতের খেল। তা বলে সেটা মন্দ বলা যায় না। কল্পনার অতীত সব উপকরণ, পোস্ট মডার্ন সব ভাবনার রূপায়ণ। এমনকী, শিল্পবাজার পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজোর পিছু নেয় চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো। প্যান্ডেল বা সজ্জা চক্রাকারে ঘুরে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে কখনও কখনও। প্রতিমাও অবিনশ্বর হয়ে কলকাতার বাইরের নানা যাদুঘরে জায়গা করে নিচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের অসংখ্য প্রান্তিক শিল্পী বহু যুগ ধরে ঘরের কোণে কাজ করে আসছেন। তাঁদের সঙ্গী দু’মুঠো অন্ন আর শিল্পটুকু বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন। আজকের প্রতিযোগিতা বা পুরস্কার, আজকের বৃত্তাকার বাজার অনামী সেই সব শিল্পীকে রসবোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। সৃষ্টিশীলতা আজ উৎসবের হাত ধরেছে। এ তো বড় কম পাওনা নয়। হয়তো পুরস্কার পাবার কিছু পিচ্ছিল চোরাপথ রয়েছে, হয়তো রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট কিছু পুজো রয়েছে। তাতেই বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? দেখতে গেলে খোদ মহাভারতেই অনৈতিকতার উদাহরণ অজস্র। ভালমন্দ হাত ধরাধরি করে হাঁটছে আবহমান কাল থেকে। কিছু মন্দর জন্য পাওনা ভালটুকু কি বাদ দেওয়া যায়, না উচিত?
আসলে ছোটবেলার যা কিছু তা থাকে বিস্মিত বালকের মনটিতে। সাদামাটা ইন্দ্রাণী পার্কের পুজোর আঘ্রাণ আজকের থিম পুজো, প্রতিযোগিতা বা বৈচিত্র্যময় প্যান্ডেলের কাছে না ছোট হয়ে যায়, না ছোট করে। দেশদুনিয়ার গতি বাঁধা হয়েছে বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার সঙ্গে। শুধুমাত্র বাঙালির পুজো তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে আমাদেরই পরাজয়। উৎসব যদি অর্থকরী হয়, একই সঙ্গে বহু মানুষের উপার্জনের পথ বাতলায়, নতুন নতুন শিল্পভাবনার সুযোগ করে দেয় সে তো আমাদের এগিয়েই দিল। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকটা আমাদের দশপ্রহরণধারিণীর দশ হাত ধরে আসুক না কেন। আমরা আবাহন জানাচ্ছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy