Advertisement
১১ মে ২০২৪

অবসান

রাস্তায় একটা চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল। পুপুল ভাবল, পিছনের বারান্দায় গেলে ব্যাপারটা দেখা যাবে। এমনিতে সন্ধের পর বারান্দাটা একটু অন্ধকার থাকে বলে পুপুল ওখানে যায় না। কিন্তু আজ কৌতূহলবশত ছুটে গেল বারান্দায়। রাস্তায় কয়েক জন লোক দৌড়চ্ছে আর বলছে, ‘চোর চোর, ধর ধর।’ কিন্তু কোনও চোর দেখতে পেল না পুপুল। লোকগুলো কী বোকা! চোর দেখতেই পাচ্ছে না, অথচ চেঁচাচ্ছে, চোর চোর।

বিনতা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রাস্তায় একটা চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল। পুপুল ভাবল, পিছনের বারান্দায় গেলে ব্যাপারটা দেখা যাবে। এমনিতে সন্ধের পর বারান্দাটা একটু অন্ধকার থাকে বলে পুপুল ওখানে যায় না। কিন্তু আজ কৌতূহলবশত ছুটে গেল বারান্দায়।

রাস্তায় কয়েক জন লোক দৌড়চ্ছে আর বলছে, ‘চোর চোর, ধর ধর।’

কিন্তু কোনও চোর দেখতে পেল না পুপুল। লোকগুলো কী বোকা! চোর দেখতেই পাচ্ছে না, অথচ চেঁচাচ্ছে, চোর চোর।

পুপুল ঘরে চলে আসছিল, হঠাৎ বারান্দার বাঁ দিকের অন্ধকারটা যেন একটু নড়ে উঠল। ওর এমনিতেই অন্ধকারকে ভয়, সেই অন্ধকার যদি নড়াচড়া করে সে যে আরও ভয়ের। ফ্যাসফ্যাসে গলায় পুপুল চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা-আ।’ সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারটা বলে উঠল, ‘কাউকে ডেকো না, কাউকে ডেকো না।’

অন্ধকার মানুষের ভাষায় কথা বলছে?

পুপুল একটু সাহস করে এগিয়ে গেল।

সেই জমাট অন্ধকারের মধ্যে বসে আছে তার থেকেও ছোট একটা ছেলে।

‘কে তুমি?’ গলা কেঁপে গেলেও পুপুল সাহস করে জিজ্ঞাসা করল।

‘চেঁচিয়ো না। ওরা শুনতে পেলে আমাকে ধরে ফেলবে।’

‘ওরা? ওরা কারা?’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

‘শুনতে পাচ্ছ না? সবাই চেঁচিয়ে তাড়া করছে আমাকে।’

‘তুমি চোর? কী চুরি করেছ? টাকা? না গয়নাগাঁটি?’

‘না না, ও সব কিছু না। আমি একটা পাউরুটি চুরি করেছি।’

‘পাউরুটি আবার কেউ চুরি করে?’ পুপুলের অবাক লাগল। চোর মানে তো

টাকাপয়সা বা সোনাদানা চুরি করে যারা। তবু ও বলল, ‘সে যা-ই চুরি করো না কেন, চোরকে ধরে ফেলাই উচিত।’

‘খিদের জ্বালায় চুরি করেছি। সেই জ্বালায় পড়লে সবাই চুরি করবে। যারা ‘চোর চোর’ বলে তাড়া করছে তারাও।’

‘সে তো তুমি চোর বলে বলছ। চোর মানে খারাপ। তার শাস্তি পাওয়া দরকার।’

কেঁদে ফেলল ছেলেটা, ‘তোমার পায়ে ধরছি। আমাকে ধরিয়ে দিয়ো না। ওরা আমাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে। আমি সকাল হওয়ার আগেই চলে যাব।’

‘পাউরুটিটা খেয়েছ?’

‘না। তাড়া খেয়ে দৌড়তে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেছে।’

পুপুল বারান্দা ছেড়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিল, সে বলে উঠল, ‘তোমার মা-বাবাকে ডেকো না। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।’

‘না ডাকছি না। তুমি এখানেই বসে থাকো। কোথাও যেয়ো না।’

ঘরে এসে পুপুল ভাবল, এ ভাবে একটা চোরকে জেনেশুনে লুকিয়ে রেখে সে অন্যায় করছে। বাবা-মাকে ব্যাপারটা এখনই বলা দরকার। ডাইনিং স্পেস থেকে তখনই মা পুপুলকে ডাকল, ‘খাবার দেওয়া হয়েছে, খাবি আয় পুপুল।’

পুপুল গিয়ে দেখল, বাবা ডাইনিং টেবিলে আগেই বসে পড়েছেন। ও একটা চেয়ার দখল করে বসে বাবাকে ডাকল, ‘বাবা, একটা কথা ছিল।’

পুপুল যে কথাটা বলার জন্য মুখ খুলতে গেছিল, সেটা না বলে আগে জিজ্ঞাসা করল, ‘খিদের জ্বালা কাকে বলে, বাবা?’

পুপুলের বাবা ওর দিকে চমকে তাকিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এ কথা কেন?’

‘না, এমনি জিজ্ঞাসা করছি, বলো না।’

‘অনেকক্ষণ ধরে যদি কেউ কোনও খাদ্যদ্রব্য না খায়, তা হলে তার খুব কষ্ট হতে থাকে। সেই কষ্ট বাড়তে বাড়তে যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন তাকে খিদের জ্বালা বলে। সেই অনুভূতি যার না হয়েছে, সে বুঝবে না। ব্যাপারটা তোর জানার কথা নয়।’

পুপুল চুপ করে থাকল।

তিন জনের সামনেই খাবারের থালা। ডিনার সারছে ওরা।

হঠাৎ পুপুল বলল, ‘আমার খাবারটা আমি ঘরে নিয়ে গিয়ে খেতে পারি? বই পড়তে পড়তে খাব। একটা ইন্টারেস্টিং বই পড়ছিলাম।’

বাবা অনুমতি দিয়ে দিলেন। সঙ্গে খাবার নিয়ে উঠে এল পুপুল। তার পর ঘরে না গিয়ে বারান্দায় এসে ছেলেটাকে ডাকল, ‘এই, তুমি এই খাবারটা খাও।’

ছেলেটা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল, ধড়মড় করে উঠে বসল। খাবার দেখে ফ্যালফ্যাল করে একটু তাকিয়ে থাকল তার পর কেঁদে ফেলল ‘ভ্যাঁ’ করে।

পুপুল ঠোঁটে আঙুল দিল, ‘চুপ! খাও। আর একটু রাত হলে আমার ঘরে তোমাকে নিয়ে যাব।’ এক বোতল জলও দিয়ে গেল ওকে। যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করল, ‘নাম কী?’

‘মানিক।’ গোগ্রাসে খাবার খেতে খেতে জবাব দিল সে।

ঘরের মেঝেতে চাদর পেতে মানিক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাত তখন তিনটে। পুপুলের ঘুম আসছে না। ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। এক বার শুচ্ছে, এক বার উঠছে। শেষ পর্যন্ত আস্তে আস্তে উঠে ও ডাইনিং স্পেসে এল। খিদের চোটে তার পেট মোচড়াচ্ছে। গুটি গুটি ফ্রিজ খুলল। ফ্রিজ থেকে একটা সন্দেশ বের করল, একটা আপেল। সন্দেশ ওর দু’চোখের বিষ হওয়া সত্ত্বেও দিব্যি মুখের মধ্যে পুরে দিল। খিদের জ্বালা কাকে বলে ও বুঝেছে। আপেলটাও খেয়ে নিল।

ঘরে এসে খাটে শুতে যাওয়ার সময় মানিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হল ওর। ভাবল, কাল তো বাবাকে সব খুলে বলবে ঠিক করেই রেখেছে। তার সঙ্গে এও বলবে, ওকে পুলিশে দিয়ো না। মেরো না। ছেড়ে দাও ওকে।

সকালবেলা পুপুলের ঘরে মানিককে প্রথমেই আবিষ্কার করল মা। তার পর একটা ছোটখাটো হইচই।

মানিক মাথা নিচু করে বসে আছে। বাবার মুখ গম্ভীর। সামনে পুপুল দাঁড়িয়ে।

বাবা বললেন, ‘কী ব্যাপার পুপুল? সত্যি কথা বলবে।’

পুপুল প্রথম থেকে সব সত্যি বলে গেল। খিদের জ্বালা অনুভব পর্যন্ত।

বাবা পুপুলকে কিছু না বলে মানিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চুরি করে খেতে গেলে কেন? বাবা-মা খেতে দেয়নি, নাকি বাড়ি থেকে পালিয়েছ?’

‘বাবা মারা গেছে অনেক দিন।

মা-ও হারিয়ে গেল সে দিন। কত

খুঁজেছি, পাইনি।’

‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’

‘বাড়িই নেই। যে ঘরটায় থাকতাম, সেখান থেকে বার করে দিয়েছে বাড়িওয়ালা। কত কেঁদেছি, খেতে দেয়নি। উল্টে মেরেছে। ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দিয়েছে। কুড়িয়ে খেলে কি পেট ভরে? শুধু জল খেলেও ভরে না। তাই তো কাল পাউরুটিটা চুরি করে ফেলেছিলাম।’ মানিকের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। পুপুলের চোখ দিয়েও।

বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তোমাকে পুলিশে দেওয়াই উচিত। কিন্তু ধরো, যদি তোমাকে ছেড়ে দিই, তুমি কী করবে?’

‘আবার চুরি করব। নইলে খাব কী?’

পুপুলের বাবা উঠে দাঁড়ালেন, ‘সে কী!’

পুপুল বাবার হাত জড়িয়ে ধরল, ‘ওকে তাড়িয়ে দিয়ো না বাবা, ওর খুব দুঃখ। ওর মা নেই, বাবা নেই। ঘরও নেই।’

এ বার দেখা গেল, পুপুলের সঙ্গে সঙ্গে তার মায়েরও চোখে জল, ‘এত দুঃখ! এর তো একটা অবসান ঘটাতেই হবে।’ বাবা বললেন জোরে জোরে। মানিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যদি খাবারের জন্য চুরি করতে না হয়, রাস্তায় ঘুরতে না হয়, তা হলে কী করবে?’

‘যদি খাবার পাই, ঘর পাই, আমি আবার ভাল ছেলে হয়ে যাব। মা যেমন বলত।’

‘ঠিক আছে। তুমি এ বাড়িতেই থাকো এখন। দেখি, ভাল ছেলে হও কি না।

তবে এখানে থাকলে একটু পড়াশোনা

করতে হবে।’

‘হ্যাঁ, হ্যা।ঁ আমি পড়ব। আমি তো স্কুলে পড়তাম। মাইনে দিতে পারেনি মা, তাই তো স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিল।’

পুপুল দেখল মা মানিক আর ওর জন্য দুটো খাবারের প্লেট হাতে এনে দাঁড়িয়েছে। ওরা দু’জনেই হেসে ফেলল ফিক করে। বাবা বললেন, ‘কী হল?’

‘খিদের জ্বালার অবসান।’ পুপুল প্লেট দুটো নিতে নিতে বলল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE