Advertisement
E-Paper

একটু জল একটু পানি

ভারত-বাংলাদেশ। লাহৌর-লখনউ। মৌলালি-মানিকতলা। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থাকে। কোথাও ভালবাসা হয়। কোথাও অ-ভালবাসা। এই কোলাজ-জীবনই বাঁচতে হবে আমাদের।ক’দিন আগে ক্লাস সেভেনের ক্লাসে ঢুকতেই এক রাশ নালিশের মুখে পড়লাম। চুপ করিয়ে বললাম, কী হয়েছে? বসা নিয়ে গন্ডগোল। সুহানা কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলল, ‘ম্যাডাম, ওরা আমাকে বসতে দিচ্ছে না।’ কে বসতে দিচ্ছে না? ‘ওই ওরা’, আঙুল তুলে কয়েক জনকে দেখাল। এ বার আমি বিচারকের আসনে, সামনে ১২-১৩ বছরের আসামির দল।

পিয়ালী রায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
‘বম্বে’ ছবির সেই দৃশ্য। হিন্দু-মুসলমান প্রেমে পড়লেই বিপদ?

‘বম্বে’ ছবির সেই দৃশ্য। হিন্দু-মুসলমান প্রেমে পড়লেই বিপদ?

ক’দিন আগে ক্লাস সেভেনের ক্লাসে ঢুকতেই এক রাশ নালিশের মুখে পড়লাম। চুপ করিয়ে বললাম, কী হয়েছে? বসা নিয়ে গন্ডগোল। সুহানা কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলল, ‘ম্যাডাম, ওরা আমাকে বসতে দিচ্ছে না।’ কে বসতে দিচ্ছে না? ‘ওই ওরা’, আঙুল তুলে কয়েক জনকে দেখাল। এ বার আমি বিচারকের আসনে, সামনে ১২-১৩ বছরের আসামির দল। বেশির ভাগেরই বক্তব্য, সুহানা ক্লাসে খুব ঝগড়া করে। সুহানাকে জিজ্ঞাসা করি, ওরা যা বলছে তা ঠিক? উত্তরে ও যা বলল, তাতে আমার সেদিনকার পড়ানো মাথায় উঠল। ‘ম্যাডাম, আমি মুসলমান বলে ওরা আমায় ঘেন্না করে।’ চমকে উঠে বলি, কী করে বুঝলি? ‘ওই প্রমিতা আমার ব্যাগ ধরে টানাটানি করে, আমায় চেপে চেপে ধরে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বার যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝানোর পালা। দ্যাখ, প্রমিতার এক পাশে রাজিয়া আর অন্য দিকে আজিজা বসে আছে। ক্লাসে তুই তো একা নয়, আরও মুসলিম মেয়ে আছে, তাদের তো কেউ এই অভিযোগ করছে না। তোর বিরুদ্ধে তো সবাই-ই অভিযোগ জানাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে তোকে ঘেন্না করবে, সে তোকে চেপে চেপে ধরবে কেন? তোকে ছোঁবেই না, তাই না? শেষমেশ সুহানাকে বোঝাতে পারলাম, সমস্যাটা ওর মনোগত। প্রমিতা আর ওর হাত মিলিয়ে, ক্লাস শেষ।

ভারী মিষ্টি মেয়ে ছিল নাহিদা। গায়ের রং চাপা। চুল ছোট করে ছাঁটা। পরনে কোনও দিন সালোয়ার-কুর্তা, কখনও জিন্‌স টি-শার্ট। ইউনিভার্সিটিতে ও আমার সহপাঠী, বাংলাদেশ থেকে এসেছিল পড়াশোনা করতে। হোস্টেলে থাকলেও প্রায়ই বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবের বাড়ি গিয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে আসত। পরিবার থেকে দূরে থাকার দুঃখটা বোধহয় এই ভাবেই ভুলতে চাইত। অল্প সময়ের মধ্যে সকলকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা ছিল ওর। কি পিকনিক, কি এক্সকারশন— সবেতেই ও লিডার। ইদের দিন দুয়েক বাদে ক্লাসে আসতেই ওকে বললাম, ইদ মোবারক। নাহিদা আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই দেশে তুমিই আমারে একমাত্র ইদ মোবারক দিলা। আর তো কেউ বলেই নাই।’ বললাম, আসলে তুই যে অন্য ধর্মের, এটা কারও মাথাতেই থাকে না। আর তুইও কি এক দিনের জন্য রোজা রেখেছিলি, বল? নাহিদা হেসে ফেলল, ‘না রে বাবা, আমার বলে খিদায় পেটে টান ধরে, আমার রোজা রেখে কাম নাই।’ নাহিদাকে তখনকার মতো কথাটা বললাম বটে, কিন্তু পরে ভাবলাম, সত্যিই তো, আমরা বাংলা নববর্ষ, বিজয়া, দিওয়ালি এমনকী ক্রিসমাসেও শুভেচ্ছা বিনিময় করি, একে অন্যকে কার্ড পাঠাই, কিন্তু ইদের শুভেচ্ছা জানাই ক’জনকে?

এক দিন আমাদের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হতে হতে হঠাৎ নাহিদার প্রসঙ্গ উঠল। আমি পঞ্চমুখে নাহিদার প্রশংসা করতেই বন্ধুটি বলল, আমিও ওকে খুব ভালবাসতাম। কিন্তু সে দিন জানিস কী হয়েছে! নাহিদা বাংলাদেশ থেকে সদ্য-আসা একটি ছেলেকে বলেছে, ‘এ দেশে হিন্দু দেখতে দেখতে চোখ একেবারে পচে গেছে।’ বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলাম। কথাবার্তা, আদবকায়দা, কোনও ব্যাপারেই তো নাহিদাকে কোনও দিন রক্ষণশীল বলে মনে হয়নি, বরং ও ছিল আমাদের থেকে অনেক বেশি আপ-টু-ডেট। তবে কি সবটাই ওপরের খোলস! পরে মনে হল, হয়তো দীর্ঘ দিন পর দেশের মানুষকে সামনে পেয়ে, আবেগে নাহিদা ও কথা বলে ফেলেছে। হিন্দু বলতে হয়তো কোনও ধর্ম নয়, বোঝাতে চেয়েছে এ-পার বাংলার মানুষকে। যেমন আমরা পশ্চিমবঙ্গীয়রা বেশির ভাগই বাংলাদেশ বলতেই বুঝি মুসলমানের দেশ। ভুলেই যাই, বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার স্বাধীনতার জন্য দুই সম্প্রদায়ের মানুষই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে, প্রাণ দিয়েছে।

মায়া আর আমি কলকাতায় একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। মায়া বাংলাদেশ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এ দেশে পড়তে এসেছিল। এমনিতে খুব হাসিখুশি, কিন্তু মাঝেমধ্যেই মনমরা হয়ে যেত। অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করত, কথা বলত না। মনে হত একটা অসহায়তা, একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রায়ই বলত ‘মা-বাবা চায় আমি ইন্ডিয়াতেই বিয়ে করে থেকে যাই। কিন্তু যখনই পয়লা বৈশাখ বা একুশের সকালটা মনে পড়ে— সেই ফুল তোলা, সেজেগুজে দল বেঁধে শহিদ মিনারে গান গাওয়া... তখন আর কিছুতেই ওই দেশ ছেড়ে আসার কথা ভাবতে পারি না।’ আমি বলি, হঠাৎ করে নিজের দেশ ছেড়ে চলে আসতে যাবিই বা কেন? বাংলাদেশে কি ভাল ছেলের অভাব! এখানকার কোনও ছেলেকে পছন্দ হল, বিয়ে করলি, সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু শুধুমাত্র ইন্ডিয়াতে থাকার জন্যই ইন্ডিয়ার ছেলে বিয়ে করতে হবে, এটা কেমন করে হয়! যে দেশে জন্মালি, বড় হলি, সে দেশ ছেড়ে চলে আসতে কষ্ট হবে না?

মায়া বলত ‘তা তো হবেই। কিন্তু কবে যে কী হয়, তার জন্যই ভয় লাগে।’ কী হয় মানে? তোরা কি ওখানে খুব কষ্টে আছিস? ‘না না, তা নয়। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে খুব অসহায় লাগে। যেমন ধরো কলেজ থেকে ফিরছি, ফাঁকা রাস্তা, মাথায় যদি ওড়নাটা দেওয়া থাকে তবে চট করে কেউ কিছু বলতে সাহস পাবে না। ভাববে মুসলিম কোনও মেয়েই যাচ্ছে। আবার কলেজ হস্টেলে যে দিন গরুর মাংস রান্না হত, সে দিন কিছু মেয়ে জোর করে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করত।’ শুনে আশ্চর্য হলাম। যে মায়া দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই মমতাজ, ইফা বা ইমরানদের সঙ্গে কাটায়, তারই কিনা এত সংশয়! বুঝলাম, প্রত্যেক দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলোর প্রতি ঈর্ষা তাদের অন্তরে বয়ে চলে। সে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানই হোক বা বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুই হোক।

একটা ছুটির দিন, মায়াকে বললাম— চল, মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসি। মায়া রাজি হয়ে গেল। আমার মামাবাড়ি দক্ষিণ কলকাতার এমন একটি অঞ্চলে, যেখানে মুসলমান মানুষের সংখ্যা বেশি। ওই পাড়ায় ঢোকার সময় মসজিদ থেকে দুপুরবেলার আজানের শব্দ ভেসে আসতেই মায়া আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আহা, কত দিন পর আজানের আওয়াজ পাইলাম!’ বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘গোস্তের গন্ধ আসতাসে গো দিদি। বাড়ির কথা মনে পইড়া যাইতাছে।’ কখন যে দুটো সংস্কৃতি নিবিড় ভাবে আপন করে নিয়েছে, ও নিজেই জানে না। ভাবলাম, মুখে যা-ই বলুক না মায়া, কোনও দিনই বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে পারবে না। আজানের ধ্বনি, গোস্তের গন্ধ ওর কাছে আজ কোনও বিশেষ ধর্মের দ্যোতক নয়, তা আস্ত একটা দেশ।

মায়ার মুখে প্রায়ই ওর বাংলাদেশের বন্ধুদের গল্প শুনতাম। অ্যালবাম নিয়ে বসে, এটা এ ওটা ও বলে আমাকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত। সুমন আর মুর্শেদ— এই দুটো নাম প্রায়ই ওর মুখে শুনতাম। মায়া-সুমন-মুর্শেদ তিন জন খুব ভাল বন্ধু ছিল। মুর্শেদের প্রতি মায়ার একটা দুর্বলতা আছে। একই রকম মুর্শেদেরও, কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে মায়া কোনও সম্পর্ক তৈরির দিকে এগোতে পারেনি। মুর্শেদও জোর করেনি। প্রায়ই মুর্শেদের ছবি হাতে নিয়ে দেখত আর বলত, ‘ইস, যদি হিন্দু হতিস, কারও কথা শুনতাম না।’

প্রত্যেক ধর্মেরই কিছু অন্ধ সংস্কার থাকে, যেগুলো থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। আর ধর্মের স্বঘোষিত কিছু রক্ষক নিজেদের সুবিধামত কিছু বিধান হাঁকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিধান পালনের মহান দায়িত্ব মেয়েদের। এক দিন ইফা-র ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি, শোওয়ার ঘরে ল্যামিনেট করা ওর একটা ছবি। জামদানি শাড়ি, কপালে বড় গোল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, খোঁপায় জুঁইয়ের মালা। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। বললাম, ব্যাপার সুবিধের লাগছে না তো! লজ্জা-লজ্জা মুখে বলল, ‘আমার না তোদের হিন্দুদের মতো শাঁখা-সিঁদুর পরতে ইচ্ছে করে।’ বললাম, দেশে ফিরেই তো জাহাঙ্গিরের সঙ্গে বিয়ে করবি, তার পর যত ইচ্ছে সিঁদুর লাগা না। আমার কথায় ইফা আঁতকে উঠে বলল, তোর কি মাথাটা গেছে! আমাদের সমাজ এই সব শাঁখা-সিঁদুর মেনে নেবে ভেবেছিস? অশান্তি লেগে যাবে। শুনে খুব বেশি অবাক হলাম না, কারণ আমাদের তথাকথিত হিন্দু ধর্মে বিয়ের পরই মেয়েদের হাতে একটি নোয়া পরিয়ে দেওয়া হয়— যা নাকি এয়ো-স্ত্রী’র লক্ষণ। সেটি তুমি হাত থেকে খুলেছ কি সকলের চোখ কুঁচকে যাবে। সিঁথির সিঁদুরটাও তোমাকে এমন করে লাগাতে হবে, যাতে অন্যের নজরে তা আসে। অথচ সংস্কৃত ভাষার বিদগ্ধ ব্যক্তিরা বলেন, বেদে সিঁদুরদানের কোনও মন্ত্রই নেই।

‘মুসলমান’ শব্দটার প্রতি ছোটবেলায় একটা ভয়, অথচ কৌতূহল মনে সব সময় কাজ করত। মা-মাসিদের মুখে রায়টের গল্প শুনতে শুনতে বুকটা ভয়ে হিম হয়ে যেত। মায়ের কোন মেসোমশাইকে নাকি দাঙ্গার সময় কেটে ফেলা হয়েছিল, নববিবাহিতা মাসির কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি... এই সব আর কী। শুনতে শুনতে একটা বদ্ধ ধারণা হয়েছিল, মুসলমান মানেই বোধহয় ভয়ংকর কিছু। অথচ বাবার বন্ধু মতিউরকাকু বা শাহজাহানকাকুরা যখন বাড়ি আসতেন, দেখতাম দিব্যি একসঙ্গে চায়ের আড্ডা চলছে। আড্ডা সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলে ভাতও খেয়ে নিচ্ছেন। মনে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করত। তা হলে কোনটা সত্যি? মা-বাবা দুজনেই তো দেখি ওঁদের সঙ্গে দিব্যি স্বচ্ছন্দ! ছোটবেলায় মামাবাড়ি গেলে ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। যিনি দিতেন, অসম্ভব সুরেলা কণ্ঠ ছিল তাঁর। একটা অমোঘ আকর্ষণ ছিল ওই সুরের, আবার ভয়ে হাত-পা শুকিয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত। মনে হত ওই বোধহয় তরোয়াল নিয়ে কেউ কাটতে আসছে। মায়ের শাড়ির আঁচলটা মুখে গুঁজে চুপ করে শুয়ে থাকতাম তাঁকে জড়িয়ে ধরে। আমার এই গল্প যখন মিজানুর বা মমতাজদের কাছে বলতাম, ওরা তো হেসেই খুন। এই নিয়ে ওরা আমায় খেপাত। কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে আমরা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, যা সহজে মেটার নয়।

এক বার আমাদের এক পারিবারিক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে একটি মুসলিম ছেলের সম্পর্ক হল। কন্যেটি তো সেই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য পাগল। এ দিকে পরিবারে হুলস্থুল কাণ্ড! জাত যায় আর কী! অবশেষে সেই মেয়ের মন ফেরাতে নিয়ে যাওয়া হল এক মুসলিম জ্যোতিষীর কাছে। তাবিজ-কবজের প্রভাবেই হোক, বা অল্প বয়সের ক্ষণিক মোহভঙ্গের কারণেই হোক, সে সম্পর্কের সেখানেই ইতি। আজও ওই ঘটনার কথা যখনই মনে পড়ে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। খারাপ লেগেছিল সে দিনও— যে দিন সমাজ-পরিবার সব ভুলে শুধু ভালবাসার টানে ইমরানকে বিয়ে করে তন্বীকে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল, ইমরানের পরিবারে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য। বা, সহকর্মী প্রীতিদির মেয়ে, মুসলিম একটি ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করায়, পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়ের সঙ্গে মা’কে কোনও সম্পর্ক রাখতে দেওয়া হয়নি।

বহু দিন মামাবাড়ি থাকার সুবাদে মুসলমান বিয়ে, মুসলমান পরব— এগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কুরবানি অর্থাৎ বক্‌রি ইদের দিন দুয়েক আগে থেকেই পাড়ায় সাজ-সাজ রব পড়ে যেত। দু-তিন-পা অন্তর ছোট ত্রিপল বা প্যান্ডাল খাটানো, আর তার নীচে বাছুর বা ছাগল দড়ি দিয়ে বাঁধা। অবোধ প্রাণীগুলো পৃথিবী থেকে ছুটি নেওয়ার দিন গুনছে। বক্‌রি ইদ বা পরের দিন রাস্তায় ভেসে আসা রক্তের স্রোত দেখে গা শিউরে উঠত। ভীষণ রাগ হত ধর্মের নামে এই পাশবিকতা দেখে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যেত কালীপুজো বা বিভিন্ন পুজোয় হিন্দুদের পাঁঠাবলির কথা। ‘বলি’ আর ‘কুরবানি’র পার্থক্য তো শুধু এই— ‘এক কোপ’ আর ‘আড়াই পোঁচ’।

দীর্ঘ দিন মেলামেশার সুবাদে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব স্পষ্ট। হিন্দু-মুসলমানের মূল রেষারেষিটা গরু খাওয়াকে কেন্দ্র করে। রসনাতৃপ্তির মতো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তর্কের কী থাকতে পারে বুঝি না। এ প্রসঙ্গে নবনীতা দেবসেনের একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর মা রাধারাণী দেবী ছিলেন নিরামিষাশী, আর পিতা নরেন দেব সর্বভুক। বাবা তাঁর কন্যাকে পরামর্শ দেন, হয় মায়ের মতো নিরামিষাশী হও বা বাবার মতো সর্বভুক।

এক দিন মিজানুরের ফ্ল্যাটে বসে আমি আর ও ভাত খাচ্ছি, হঠাৎ ঝড়ের বেগে জলির প্রবেশ। ঢুকেই মিজানুরকে বলল, ‘কী ব্যাপার, ইন্ডিয়াতে আছো বইল্যা ইদের কথা ভুইলাই গ্যাছ!’ মিজানুর একটু আমতা আমতা করতে লাগল। কারণ, ক’দিন আগেই আমি ইদ কবে হচ্ছে জানতে চাওয়ায় ও ঠিক উত্তর দিতে পারেনি। তার পর সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘হ্যাঁ, ইদ আসতাছে তো, তোমার বাসায় দাওয়াত দিবা না?’ জলি বলে, ‘দাওয়াত মানে! ওই দিন সক্কলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। আমি আর মমতাজ মেনু ঠিক করে ফেলেছি। তুমি মাছ আর খাসির মাংসটা কিনবা, আর গরুর মাংসের অর্ডার আমি অলরেডি দিয়া দিছি।’ বলেই ওর চোখ গেল আমার দিকে। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বার বার আমার কাছে মাপ চায় আর বলে, ‘প্লিজ, কিছু মনে কোরো না। আমার মনেই ছিল না তুমি হিন্দু।’ যত বলি তাতে আমার কিছুই এসে যায় না, ওর সেই এক কথা।

কিছু দিন আগে জনপ্রিয় টিভি রিয়েলিটি শোয়ের এক প্রতিযোগী মহাদেব-কে নিয়ে একটি জোক বলায় কিছু স্বঘোষিত হিন্দুধর্মরক্ষক এমন জ্বালাময়ী মন্তব্য করেছেন, যা শুনে মনে হচ্ছে ভারতে তালিবানি রাজত্ব আসতে আর দেরি নেই। একটি বিশেষ সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের পাতায় অনুষ্ঠানটির পরিচালক, বিচারক, বিশেষ করে সঞ্চালকের (যেহেতু তিনি মুসলমান) প্রতি অত্যন্ত কুরুচিকর মন্তব্য করা হয়েছে। অপর পক্ষ থেকে পালটা জবাবও অবশ্য এসেছে। সেগুলির অশ্লীলতাও সীমাহীন। খারাপ লাগল, যখন কিছু বন্ধুদেরও বলতে শুনলাম, সাহস থাকে তো ‘ওদের’ ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বলুক। ওদের সম্মিলিত গলার জোরকে ছাপিয়ে বলতে পারলাম না— আমার মতে কেউ যদি ভুল রাস্তায় যায়, তা হলে আমি তা শোধ দেওয়ার জন্য ভুল রাস্তাতেই যাব? হায়, ১৬০ বছর আগে বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর নারী বলতে পারেন ‘আমি যেমন শরতেরও মা, তেমনি আমজাদেরও মা’, অথচ একুশ শতকের উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ‘আমরা-ওরা’র ফারাক ঘোচাতে পারলাম না। কী করে ভুলি, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী ভয়াবহ দিনগুলিতে আমার ভাই-দাদাদের বুক দিয়ে আগলে রাখে জাফর-রফিকরা!

এক দিন মমতাজের বাড়িতে বসে আছি, হঠাৎ শাম্ব কী একটা দুষ্টুমি করায় ইরফাত বলে উঠল, ‘হিন্দুদের মতো করিস না তো!’ বেশ মজা পেলাম। ছোটবেলায় এঁটোকাঁটার বাছবিচার না করলেই ঠাকুমা-দিদিমার মুখে শুনেছি— ‘সব মোছলমান হয়েছে।’ ইস, ওঁরা যদি বেঁচে থাকতেন, বলতে পারতাম, শোনো, অত গর্ব কোরো না। তোমাদের আচার-বিচারও কারও কারও কাছে ‘হিঁদুদের মতো’।

piyali.rupu@gmail.com

Robibashoriya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy