Advertisement
১৯ মে ২০২৪

রূপকথা নয়

মেঘালয়ে মাতৃতন্ত্র চলে। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে আসে। সন্তানসম্ভবা মা’কে সবাই আশীর্বাদ করে, ‘কন্যাবতী হও’। কিন্তু তাতেই কি জীবন হ্যাপিলি এভার আফটার?মেঘালয়ে মাতৃতন্ত্র চলে। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে আসে। সন্তানসম্ভবা মা’কে সবাই আশীর্বাদ করে, ‘কন্যাবতী হও’। কিন্তু তাতেই কি জীবন হ্যাপিলি এভার আফটার?

সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০০:১১
Share: Save:

হঠাৎ করেই মেঘ নেমে আসে এখানে। সব ঢেকে যায়। শিলং পাহাড়, পাইনের সারি— সব। এমনকী মেঘ-চাদরে জড়ানো ওয়াট্ল গাছের মাথায় বসে একনাগাড়ে ডাকতে থাকা ছোট্ট মালেঙ্গিয়াম পাখিটাও। শুধু কান পাতলে শোনা যায় দূরের জাসাই নদীর কল্লোল।

ডিংইয়েই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা এক দল খাসি মেয়ে, সকালের নরম রোদের চাদর জড়িয়ে গান গাইতে থাকে। এই ভূস্বর্গের সর্বত্রই মেয়েরা গাইছে। মায়েরা যেন বলছে, আমরা সবাই রানি আমাদের এই রানির রাজত্বে। হ্যাঁ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট প্রদেশ মেঘালয়ে, এখনও মায়েরাই শেষ কথা বলে। এখনও মা-প্রধান পরিবার, সমাজ। পণ দিয়ে বিয়ে করতে হয় না মেয়েদের। বিয়ের পর বরকে নিয়ে বউ নিজের বাড়িতে চলে আসে। আজও সন্তানসম্ভবা মেয়েকে বাড়ির মা-ঠাকুমারা আশীর্বাদ করেন ‘কন্যাবতী হও।’ পুত্রসন্তান জন্ম নিলে নতুন মা মুখ লুকিয়ে কাঁদে— ছেলে বড় হয়ে গেলে বিয়ে করে চলে যাবে বউয়ের বাড়ি। বিয়ের পর ছেলের পদবি বদলায় না ঠিকই, কিন্তু সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ছেলেই হোক বা মেয়ে— মায়ের বংশের মতোই নামকরণ হয়।

যে দেশের মেয়েরা আজও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, লক্ষ-লক্ষ কন্যাভ্রূণ এ দেশে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ এখনও পায় না, সেখানে খাসি মেয়েরা ‘মিসট্রেস অফ দ্য হাউসহোল্ড’! ভাবা যায়! কিন্তু গল্পটা অত সহজ নয় বোধহয়। তার অনেকগুলো দিক আছে।

হিমা খাইরম। শিলং পিক-এর একেবারে উপরে তাঁর চায়ের দোকান। সকাল থেকেই ভিড় জমে দোকানে। ‘আই চা ছিতেলা’ (এক কাপ চা) ‘ওন বয়েল টেলেং’ (একটা ডিম সেদ্ধ) চলতেই থাকে। হাসিমুখে ও...ই... ম্যাডাম, ওথে স্যর! এক মিনিট। কী যে উষ্ণতা হিমার স্বরে! গত কয়েক বছর ধরে আসছি, দোকানটায় কিছুই পরিবর্তন ঘটেনি। তিনটে বড় পাথর-গাঁথা উনুন। উপরে কয়েকটা লোহার শিক। ধিকধিক আগুন জ্বলে সারা দিন। কয়লার অভাব নেই এখানে। আগে ছোট্ট এই দোকানটার কর্ত্রী ছিল হিমার মা। এখন বয়স হয়ে গেছে, দোকানে আসে না। বোধহয় হিমার সন্তানদের দেখাশোনা করে। খাসি মেয়েদের জীবন এ ভাবেই চলে। সম্পত্তি হোক বা বাণিজ্যই হোক— মায়ের থেকে মেয়ের হাতে। হিমা ভাগ্যবতী। এক মেয়ে। হিমার প্রথম স্বামী কৃষ্ণ ছিল নেপালি। হিমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড় ছিল। হিমার দুই সন্তানের পিতা। কয়েক বছর পর এক খাসি পুরুষকে বিয়ে করে হিমা। হেমব্রেম। খাসি সমাজে এখনও আইনি ভাবে বিয়ে কমই হয়। বিয়ে করা আর বিয়ে ভাঙা, দুটোই সহজ।

খাসি মেয়েরা দোকান চালায়, কোমরে বাঁধা থাকে টাকার থলে। স্বাধীন ভাবে নাড়াচাড়া করে টাকা। বাড়ির পুরুষ দোকানের ভারী সামগ্রী পিঠে করে নিয়ে আসে। সারা দিন দোকান পরিষ্কার করা, বাসন ধোয়া— সব কাজই করে। দুপুরে স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেশা করতে যাওয়া, ভাত খাওয়া।

প্রথম স্বামী কৃষ্ণর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত কৃষ্ণ হিমার দোকানে আসত, তার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে কাজ করত। এক দিন অন্য এক খাসি মহিলার সঙ্গে চলে যায়। হেমব্রেমের বয়স কম। তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর হিমার শরীর ভাঙতে থাকে। ‘আমি রোজ দোকানে আসতেও পারছিলাম না, তারই সুযোগ নিল হেমব্রেম। সারা দিন দোকানে থাকত ঠিকই, কিন্তু সন্ধেবেলায় হরলং (খাসি মদ) খেতে যাওয়ার অছিলায় বাইরে যেত। প্রায় রোজ রাতেই বাড়ি ফিরত না। আমার দূর-সম্পর্কীয় এক বোনের সঙ্গে থাকে। তিনটে বাচ্চার দায়িত্ব আমার।’ শুধু হিমা নয়, বিয়ে ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানের দায়িত্ব সব দিক থেকেই সামলাতে হয় খাসি-মা’কে একা।

সেই কবে থেকেই ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মহিলারা একা-মায়ের ভূমিকা পালন করছে। তারা অনেকেই স্বেচ্ছায় একক মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে চাইছে। তাদের বক্তব্য হল, সন্তান পালনের জন্য তারা একাই যথেষ্ট। পাশে পুরুষের প্রয়োজন নেই। কত সহজ ভাবেই তারা বলছে, যদি পুরুষ সমান অনুভূতিপ্রবণ না হয়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয়, তবে সংঘাত, অশান্তি— এ সব থেকে দূরে থাকাই ভাল। কিন্তু পাশাপাশি রেখে দেখলে অবাক হতে হয়, খাসি মহিলারা আর্থ-সামাজিক বৃত্তে মাতৃপ্রাধান্যের ধারা বজায় রাখলেও, ঘোষণা করতে পারছে না যে আমরা একাই যথেষ্ট। বরং কেউ কেউ পিতৃপ্রধান পরিবারকেই ঠিক মনে করছে।

জোনা লিনভো বলছে, ‘কীসের মাতৃপ্রাধান্য? আমরা না এ-দিকে যেতে পারছি, না ও-দিকে। ছেলেরা যখন খুশি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দায়িত্ব নেই। সন্তানদের সব দায়িত্ব মায়েদের। আমরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায় শুধু কাজই করে যাচ্ছি। আমাদের বয়স বাড়ে, কিন্তু কাজ ছাড়তে পারি না।’

জোনার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। চার ছেলে। মেয়ে নেই। বলতে গেলে পোড়া কপাল। তার ওপর আবার বছর তিনেক হল স্বামী অন্য মহিলার কাছে চলে গেছে। ‘আমার তিন ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। ছোট ছেলেকে আমি কিছুতেই বিয়ে করতে দেব না। ও চলে গেলে আমাকে দেখবে কে?’

শিলং শহরের পুলিশবাজারে নানা ধরনের ফুল আর অর্কিড নিয়ে বসে জোনা। রোজ সকালে নীল রঙের যে বাসটা চেরা, বালাট, ডাউকি থেকে শিলং শহরে আসে, তাতেই রোজ সকালে নামতে দেখা যায় জোনাকে। পান-সুপারি খাওয়া মুখটা একেবারে লাল টুকটুকে হয়ে থাকে। নিজের হাতেই বাগান করে। নানা ধরনের ফুলের চারা তৈরি করে, শহরে এসে বিক্রি করে। সময় পেলে শিলং শহরের কয়েকটা বাড়িতে গিয়েও ফুল, চারাগাছ, বীজ দিয়ে আসে। কর্মঠ, স্বাধীন, সাহসী জোনা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ‘আমাদের খাসি মেয়েদের বয়স বাড়লেই পরিবার ভেঙে যায়।’ জোনার কথা ভুল নয়। দেখা যাচ্ছে, খাসি পুরুষ— যদি তার বয়সও হয়ে যায়, কিন্তু যদি সে যথেষ্ট খাটতে পারে— দিব্যি অল্পবয়সি খাসি মেয়েকে বিয়ে করে চলে যাচ্ছে। মধ্যবয়স্কা স্ত্রীর তখন নাজেহাল অবস্থা।

পুলিশবাজারের সেন্টার পয়েন্টে থাকা বড়-বড় হোটেলের সামনে রোজ সকালে ট্যাক্সি দাঁড়ায়। বয়স্ক বাঙালি ট্যাক্সিচালক পরিতোষদা কোনও দিন চেরাপুঞ্জি, কোনও দিন ডাউকি, আপ-ডাউন করেন। এ ভাবেই আছেন গত তিরিশ বছর ধরে। একটা সময় ছিল যখন ত্রিপুরা, শিলচর থেকে বহু বাঙালি ছেলে শিলং-এ আসত ট্যাক্সিচালক হয়ে। পরিতোষদা যেমন এসেছিলেন। শুধু বাংলা কেন, পঞ্জাব, নেপাল, উত্তর প্রদেশ থেকে আসা পুরুষরা কেউ হোটেল, কেউ দোকান করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ পয়সা করে নিয়েছে। খাসি মেয়েদের বিয়ে করেছে। খাসি সমাজের কিছু মানুষ মনে করেন, এ ভাবেই মেঘালয়ের বহু মাটি অ-খাসিদের হাতে চলে গেছে। শুধু মাটি নয়, খাসি মেয়েরাও ঠকেছে নানা ভাবে। বিয়ে করার ছলে পুরুষরা ফুর্তি করেছে খাসি মেয়েদের নিয়ে।

পরিতোষদা কিন্তু অন্য গল্প শোনালেন। ‘এত বছর ধরে শিলঙে আছি। দু-এক জন খাসি মেয়েকে মনেও ধরেছিল, কিন্তু এক ধরনের ভয় থেকে এগোইনি।’

কী ধরনের ভয়?

‘আমার ছোট ভাইও গাড়ি চালাতেই এসেছিল। ভালবেসে বিয়েও করেছিল এক খাসি মেয়েকে। বিয়ের প্রায় বারো-তেরো বছর পর সেই খাসি-মেয়ের এক খাসি-ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার ভাইকে প্রায় এক কাপড়ে ঘর ছাড়তে হয়। ভাই মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল।’

এর পর পরিতোষদা শোনালেন তাঁর প্রতিবেশী এক খাসি মহিলার গল্প। ‘রাধিকা প্রতি বারই বিয়ে করে আর তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। প্রথমে নেপালি পুলিশকে বিয়ে করল। টাকা নিয়ে দোকান খুলল। প্রথমে খুবই গরিব ছিল। পথের ধারে পান-সুপারি বিক্রি করত। দুই সন্তানের মা হল। চাল-ডালের দোকান খুলে দিয়েছিল নেপালি পুরুষ। এক দিন দেখলাম পুলিশ চলে গেছে। প্রথমে বলল, বদলি হয়েছে। অনেক দিন পর দেখলাম, একটি অল্পবয়সি নাগা ছেলে এসে থাকছে। ছেলেটি ট্যাক্সি চালায়। রাধিকা ট্যাক্সি চালানো শিখল। নিজেও চালাত। সন্তানের জন্ম দিল রাধিকা। যথারীতি নাগা ছেলেটির সঙ্গে রোজ রাতে ঝগড়া হয়। ওদের ঝগড়া থামাতে আসত কাছের এক সেনাবাহিনীর কর্মচারী। হিন্দিতে কথা বলত। এক রাতে নাগা ছেলেটির কান্না জড়ানো চিৎকার শুনলাম। রাধিকাও চিৎকার করছিল। পরের দিন সকালে শুনলাম, ছেলেটি ট্যাক্সি চাইছিল, রাধিকা দেয়নি। এ বার রাধিকা ট্যাক্সির মালিক হয়ে গেল। এখন ওই হিন্দিভাষী সেনাটির সঙ্গে থাকে। রাধিকার ছেলেমেয়েরা দিব্যি তাকে পাপা ডাকছে। ইতিমধ্যেই রাধিকা বিরাট দোকান খুলেছে, একেবারে ডিপার্টমেন্ট স্টোর!’

তা হলে? খাসি মহিলারা একাধিক সম্পর্কে অভ্যস্ত। তারা শোষক না শোষিত? তাদের বিয়ে করার সঙ্গে কি অর্থনীতির গল্প জড়িয়ে থাকে? খাসি পুরুষরা কি অসহায়?

‘হ্যাঁ, অসহায়।’ নেশাগ্রস্ত হয়ে জড়ানো গলায় টোকেন মাথা নাড়ে। ‘তোমাদের ‘উৎখার’ (অ-খাসি) পুরুষদের আমার হিংসে হয়। ওদের অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে জানলেও ওদের স্ত্রীরা প্রতিবাদ করে না। না-জানার ভান করে, কারণ ওদের হাতে খাসি মহিলাদের মতো পয়সা থাকে না। আমরা? সংসারে সন্তান প্রতিপালন করে, আর বউয়ের কর্মচারী হয়েই আমাদের জীবন কাটে। এই যে খাসি পুরুষরা এত নেশা করে, তার মূল কারণই হল, তারা অনুভব করে যে সংসারে তাদের কোনও মূল্য নেই। আমরা থাকতে বললে থাকি, আর যেতে বললে চলে যাই।’

সেই জন্যেই কি মেঘালয় জুড়ে গড়ে উঠেছে কিছু পুরুষমুক্তি সংগঠন? একটি সংগঠন গড়েছেন চার জন শিক্ষিত খাসি পুরুষ মিলে, তাঁদের এক জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে, এক জন একটি লজের কর্ণধার, এক জন সহকারী বৈজ্ঞানিক, এক জন শিক্ষক। তাঁদের মূল দাবি: সম্পত্তিতে পুরুষের অধিকার ও পারিবারিক বৃত্তে সমমর্যাদা। তবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গড়ে ওঠা মহিলা সংগঠন যেমন সোচ্চারে অধিকারের দাবি জানায়, এঁরা তা করেন না, বরং লুকিয়েচুরিয়ে মিটিং করেন। সেই ভাবেই জোগাড় করে ফেলেছেন প্রায় তিন হাজার সদস্য। কিন্তু সে ভাবে হোর্ডিং থাকা অফিস নেই। কোনও প্যামফ্লেট বা লিখিত সংবিধান নেই। শুধু যেখানে যখন যে ভাবেই মিটিং হয়, সেখানেই বলা হয়, ‘খাসি সমাজে যত তাড়াতাড়ি পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, তত তাড়াতাড়ি খাসি পুরুষদের মুক্তি হবে। আজ খাসি পুরুষরা এত বেশি নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে— তার মূল কারণই হল পরিবারে তাদের কোনও কর্তৃত্ব নেই, সন্তানের ওপর অধিকার নেই।’ এই সংগঠনের চেরাপুঞ্জি শাখার প্রতিনিধি নিজের পদবি দিতে চেয়েছিলেন মেয়েকে। ফল: স্ত্রীর বাড়ির সঙ্গে সংঘাত ও পাকাপাকি ভাবে সম্পর্ক শেষ। অনেক অত্যাচার সহ্য করেও নিজের বাড়ির দরজায় লিখে রেখেছেন, ‘This is man’s house.’ ঠিক যেমন অধিকার চাইছে দেশের সর্বত্র গড়ে ওঠা মহিলা সংগঠনগুলো।

এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাসি, গারো আর জয়ন্তিয়া— এই তিন জনগোষ্ঠীর মেয়েরাই এখনও বয়ে নিয়ে চলেছে মাতৃপ্রাধান্যে গড়ে ওঠা পরিবারের ঐতিহ্য। যে মহিলা বা খাসি পুরুষ শিক্ষিত হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্যে বাইরে যাচ্ছে, তারা বিয়ের পর পুরুষের তার স্ত্রীর ঘরে চলে আসার নিয়মটি সমর্থন করছে না। লজ্জা পায়। শহরে কাজের অজুহাতে আলাদা ভাবে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে স্বামী-স্ত্রী। এ গল্প অল্প সংখ্যক খাসি পরিবারে ঘটছে। বেশির ভাগ খাসি পরিবারে এখন অশান্তি। হিমা, জোনা কিংবা রাধিকাদের দাম্পত্য জীবনের পরিণতি তাদের এক ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাচ্ছে। তারা প্রশ্ন করছে, পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক পরিকাঠামোই কি শ্রেয়? অন্তত অর্থনীতির দিকটায় চোখ বুজে থাকা যায়! বাড়ির পুরুষের কাঁধে থাকে যে দায়িত্ব, ওরা সে কথা প্রকাশও করছে— ‘ইস, তোমাদের কী সুন্দর জীবন! সারা দিন ঘরে থাকো! তোমাদের পুরুষরা উপার্জন করছে আর তোমরা ইচ্ছে মতো খরচ করছ! আমাদের মতো তোমাদের ভাবতে হচ্ছে না, কালকে কী ভাবে ঘর চালাব।’

আসলে, এই যে খাসি মেয়েদের হাহাকার, তার মূল কারণই হল আর্থিক চাপ, সন্তান বড় করার একক দায়িত্ব, পারিবারিক সংঘাত। খাসি পুরুষদের অত্যধিক নেশাগ্রস্ত জীবন, সংসারের দায়িত্ব না নিতে চাওয়া, স্বাভাবিক ভাবেই এক ধরনের অ-নিরাপত্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যখনই পুরুষ শারীরিক ভাবে অক্ষম হচ্ছে, কম খাটতে পারছে, তখনই সংসার ভাঙছে। আবার আর এক দিকে, খাসি মহিলার যখন বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তখন তার কর্মঠ পুরুষ ঠিকানা পালটে ফেলছে। দুটো ক্ষেত্রেই সন্তানের দায়িত্ব থেকে যাচ্ছে মায়ের ওপর। পুরুষ ঠিকানা বদলালে সন্তানকে সঙ্গে নেয় না, কিন্তু নারীকে নিতে হয়। সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব তার নিজের— একার। যে দায়িত্ব বহন করতে কষ্ট হচ্ছে খাসি মায়েদের। তাই খাসি মহিলাদের প্রাধান্যের গল্প বদলে গিয়ে এক ধরনের বিকল্পহীন দায়িত্বের বোঝা নিয়েই বেঁচে থাকার গল্প হয়ে উঠছে। পুরোটাই একটা মনখারাপের গল্প।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

meghalaya matrilineal system suparna lahiri barua
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE