Advertisement
E-Paper

ষাঁড়ের নাম জামাই, খায় তেলেভাজা

১৯৬৩ সাল। আমরা এগারো জন বন্ধু ভেটেরিনারি পাশ করে যোগ দিলাম হরিণঘাটা ফার্মে। মাখনের মতো রাস্তা, ফুল-ফলের গাছ, খেলার মাঠ। ছিমছাম। ঠাঁই হল ট্রেনি’জ হোস্টেলে। আমাকে কাজ দেওয়া হল মিল্ক কলোনিতে, সেখানে কলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা গরু-মোষ নিয়ে থিতু হয়েছিলেন।

জয়দেব ভাদুড়ি

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০২
ছবি: সুমিত্র বসাক।

ছবি: সুমিত্র বসাক।

১৯৬৩ সাল। আমরা এগারো জন বন্ধু ভেটেরিনারি পাশ করে যোগ দিলাম হরিণঘাটা ফার্মে। মাখনের মতো রাস্তা, ফুল-ফলের গাছ, খেলার মাঠ। ছিমছাম। ঠাঁই হল ট্রেনি’জ হোস্টেলে। আমাকে কাজ দেওয়া হল মিল্ক কলোনিতে, সেখানে কলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা গরু-মোষ নিয়ে থিতু হয়েছিলেন। তখনই আট হাজার মোষ ছিল। হোস্টেলে তিন জন চাকর, রাঁধুনি সরকারি। আমাদের শুধু খাবারের দামটুকু দিতে হয়। মিল্ক কলোনিতে আটটা ইউনিট, আমি একটা ইউনিটের সুপারভাইজর। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে দিগন্ত জোড়া সবুজ নেপিয়ার (এক ধরনের ঘাস, গোখাদ্য)। কাছেই অফিসে আমার বস, কলোনি অফিসার বসেন। প্রথম দিন থেকেই বুঝিয়ে দিলেন, আমায় কী কী করতে হবে।

ফার্মে কাজ হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে। ভোর চারটেয় হোসপাইপ দিয়ে মোষ ধোওয়ানো শুরু। তার পর ওদের খেতে দেওয়া। ছ’টা থেকে দুধ দোওয়া। ব্যবসায়ী-পিছু দুধের ক্যান দেওয়া, ক্যান বন্ধ করে সিল করা। সেই দুধ ওজন হবে কারখানায়। মোষ-প্রতি সাঁইত্রিশ পয়সা ভাড়া। গোয়ালারা ওই ক্যাম্পাসেই থাকতেন, দশটা মোষ রাখলে একটা কোয়ার্টার্স পেতেন তাঁরা।

আমরা কাটা খড় ওদের বিক্রি করি। মোষ ভাড়া আর খড়ের বিল করতে হবে। দশ দিন অন্তর দুধের দাম দেওয়া হয়। এ সব খরচা দুধের দাম থেকে বাদ যাবে, তাই সময়ে বিল পাঠানো জরুরি। এ ছাড়া জল, ইলেকট্রিসিটি ঠিক আছে কি না দেখা... কাজ অনেক। ডিউটির সময় সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা, আবার তিনটে থেকে ছ’টা। স্টেশন লিভ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে।

কাজের ফিরিস্তি শুনে বেশ দমে গেলাম। কিন্তু অফিসে বসে দেখলাম, সইটুকু ছাড়া আমায় কিছুই করতে হয় না। দুজন করণিক আছেন, সব কাজ নিখুঁত করে দেন। কয়েক জন অস্থায়ী কর্মী ছিলেন, দৈনিক পাঁচ সিকে মাইনেতে খুব নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতেন। আমি মাইনে পেতাম আড়াইশো টাকা, হোস্টেলে খাওয়া-খরচ বত্রিশ টাকা। খাওয়াদাওয়া এলাহি। ডেয়ারির খাঁটি ঘি। তাতেই ভাজা পরোটা, ওমলেট। সুগন্ধি চালের ফ্যান-ভাত, ডিমসেদ্ধ। দুপুরে বাটি ভরা মাংস, মাছ। পোলট্রির মাংস তিন টাকা কেজি। ফাটা-ভাঙা ডিম মেলে নামমাত্র দামে। গোটারি থেকে কচি পাঁঠা, পিগারি থেকে শুয়োরের মাংস। ভালমন্দ খেয়ে, দুপুরে ঘুমিয়ে সবার ওজন বেড়ে গেল। বিকেলে ফুটবল, ভলিবল পেটানো, রাতে ব্যাডমিন্টন। কোনও দিন তিন তাস। কাছের মিলিটারি ক্যাম্প থেকে জোগাড় করা রাম। ফার্মের সসেজ-সালামি তো আছেই। একেবারে নরক গুলজার। এক অনন্ত চড়ুইভাতি।

এর মধ্যে এক জন অ্যাসিসট্যান্ট সুপারভাইজরও যোগ দিলেন, তাই আমার কাজ আরও কমল। চা-বিস্কুট খেয়ে খাটালে ঘুরি। আটটা বাজলে হোস্টেলে জলখাবার খেয়ে রওনা দিই। ইউনিটে পৌঁছে খাটিয়ায় বসে গেলাস ভর্তি খাঁটি দুধের এলাচ-ভুরভুর চা খাই। পঞ্জাবি ব্যবসায়ী সুন্দরদাস, কারুমল, দেওয়ান সিং, নান্নু মিয়ার সঙ্গে গল্প করি। এগারোটা বাজলে সবাই জুটি কলোনি অফিসারের ঘরে। ইলেকট্রিক পাম্পের ইঞ্জিনিয়াররাও এসে হাজির হন। অফিসের কথাবার্তা টুকটাক, রঙ্গরসিকতাই বেশি। কোয়ার্টার্সে কার বউ সুন্দরী, কে ‘মিশুকে’, খবর ভাসে। বারোটা বাজলে দল বেঁধে রওনা হই, ফার্ম চলে যায় কেরানিবাবুদের দখলে। মোষেরা বসে বসে জাবর কাটে, কষ দিয়ে ফেনা গড়ায়।

জম্পেশ খানা খেয়ে আঁচাতে আঁচাতেও ঢুলি। তার পর পৌনে তিনটে অবধি লম্বা ঘুম। বিকেলেও একই রুটিন। বেশির ভাগ দিনই কলোনি অফিসারকে বলে মাঠে ফুটবল পেটাই।

দশ দিন অন্তর কলকাতা থেকে বড় ব্যবসায়ীরা আসেন দুধের দাম নিতে। আমাদের সঙ্গে দেখা করেন, সমস্যা থাকলে বলেন। সর্দার জোধ সিং-এর পরিচয় হয়, ষোলোটা কলেজ আছে ওঁদের! খেঁটে ধুতি আর ফতুয়া গায়ে আসেন নন্দীবাবু। সকলের কাছে ঘুরে ঘুরে ঘ্যানঘ্যান করেন: জামাই চেটেপুটে খাচ্ছে না! ‘জামাই’ মানে হৃষ্টপুষ্ট একটা ষাঁড়, ওঁর আয়েরও উৎস। আমরা উপদেশ দিই, বেগুনি আর পেঁয়াজি খাওয়ান। এক চুপড়ি গরম তেলেভাজা বেশ করে বিটনুন ছিটিয়ে গামলায় ধরে দেওয়া হল। জামাই ঠিক আমাদেরই মতো ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে, ‘গো’গ্রাসে পুরোটা সাবড়ে গামলা চাটতে লাগল। তার পর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে নন্দীবাবুর মুখের দিকে মিনতি-ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। নন্দীবাবুর মুখে হাসি ফুটল। হপ্তায় দু’দিন জামাইকে তেলেভাজা দেওয়ার অর্ডার দিয়ে চলে গেলেন।

হাটের দিন হলে পরিমলের দোকানে সাইকেল রেখে মোহনপুর হাটে ঘুরি। সবুজ শাকসবজি, নধর লাউ-কুমড়ো দেখে চোখের আরাম হয়। সাঁওতাল মেয়েরা আসে— করঞ্জার তেল মাখা, কালো কুচকুচে, সুঠাম, সাবলীল। হাতুড়ে ডাক্তার হরিবাবুর চেম্বারে ফোড়া কাটা হচ্ছে, সারা হাট চিল-চিৎকারে সচকিত।

মদনদার বাড়ি বাটানগর। কী কায়দা-টায়দা করে ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের অনেককেই হাফ দামে অ্যামবাসাডর জুতো এনে দিয়েছেন। ফার্মে মাঝেমধ্যে সেমিনারও হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা আসেন। বুকে ব্যাজ, পায়ে অ্যামবাসাডর, গায়ে টেরিলিন শার্ট পরে মাতব্বরি করি। মহার্ঘ প্যাকেট জোটে।

শুন্তি ঝিলে টিকিট কেটে মাছ ধরতে আসেন নামকরা ডাক্তার, সাহিত্যিক, ফিল্মস্টারেরা। ওঁরা ফার্ম দেখতে এলে কৃতার্থ হই। কখনও কখনও মাঝরাতে ডাক আসে— মোষের বাচ্চা হচ্ছে না। কয়েক জন মিলে দৌড়ে যাই। যন্ত্রপাতি দিয়ে, শেখা বিদ্যে ফলিয়ে সাফল্যও পাই। নড়বড়ে বাচ্চাটাকে মা চেটে চেটে চাঙ্গা করে। আমাদের ঘিরে তখন পান-ভোজনের মোচ্ছব।

ভাঙন শুরু হয়। পাঁচ জন বন্ধু চলে যায় উচ্চশিক্ষা নিতে, জন তিনেক ওষুধ কোম্পানিতে। মনখারাপ হয়, দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন ডিউটি করতে করতে দূরাগত ঢাকের আওয়াজে কেমন কান্না পায়। আর এ ভাবেই, আঙুলের ফাঁক দিয়ে জলের মতো, বেরিয়ে যায় চার চারটে বছর।

bhadurijaydeb@gmail.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ
পিএনপিসি হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

office gossip joydeb bhaduri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy