Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Mother Language Day Sale

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে

নিকানো উঠোনে ঝরে ভাষাপ্রেমের ‘ওয়ান ডে’। বাংলা এখন বং, আর তার ভাষা এখন এমন এক অভূতপূর্ব জগাখিচুড়ি, যার প্রায় পুরোটাই অন্য ভাষা থেকে অর্জন, আর নিজস্ব শুদ্ধতার সবটুকু বর্জন।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৪১
Share: Save:

পরুন ও পরান

আমার এক বন্ধুর বুটিকের আউটলেটের সামনে ‘জীবন দুশো, জীবন দুশো’ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। গত বছরের ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারি, মানে ভাষা দিবস আসতে বাকি ছিল মাত্র কয়েকটা দিন। দেখেছিলাম, কাচের দেওয়ালের ভিতরে স্প্লিট এসির হাওয়ায় দুলছেন জীবনানন্দ। বুটিক মালিক আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। দোকানে ঢুঁ মেরে শুধোলাম, “ব্যাপারটা কী?”

বহু বছর সেলসের চাকরি করে ছেড়ে দেওয়া, অন্তর ও প্রাণ দিয়ে ব্যবসা করা আমার আন্তোপ্রানো বন্ধু বলল, “গুরু, এটা হল গিয়ে বাংলা ফেরি করার সিজ়ন। একটা কিনলে দুশো। দুটো কিনলে সাড়ে থ্রি ফর্টি নাইন।” জানলাম, ভাষা দিবসের আগের দিনদশেক জীবনের খুব ডিমান্ড থাকে। জীবন মানে জীবনানন্দ। টি-শার্টে লেখা ছিল, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে— এই বাংলায়।’ লাল-হলুদ-কালো-কমলা টি-শার্টে কবির অভাবী মুখ, হিজল গাছের ছায়ার মতো বিষণ্ণ। দু’চোখে আকুলতা। মুখের পিছনে একটা নদীর ঢেউ খেলছে বেশ। নিশ্চয়ই ধানসিড়ি! পাশের টি-শার্টেও একই কবি। কবির মুখের নীচে ঢেউ খেলানো ফন্টে লেখা, ‘বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ।’ বার কোড মাখা স্টিকার ঝুলছে। আছে একটা কিউআর কোডও। তাতে লেখা, ‘স্ক্যান হিয়ার টু রিড দ্য ফুল পোয়েম।’ আছেন বিশ্বকবিও। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ গাঢ় নীল-সবুজ টিশার্টে রবীন্দ্রনাথ। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধানক্ষেত। আর এই পুরো ব্যাপারটা ধরানো রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপের মধ্যে।

বললাম, “ভাই, একটু তোর দোকানে বসি?”

বন্ধু ভুরু কুঁচকে বলল, “মিডলক্লাস পাবলিকের মতো দোকান বলবি না একদম। এটা আউটলেট। আরামসে বোস। লোকজন আসছে, পারলে কয়েকটা টি-শার্ট পুশ কর।”

শ’খানেক ক্যাপশন-টি-শার্টের ঝালরের মধ্যে বেতের একটা বাহারি চেয়ারে বসলাম। বন্ধু বলল, “এই কবি-ক্যাপশন আর ভাষাপ্রেমের সেকশনটার একটা নাম দিয়েছি। লাভ ইউ, লাভ ইউ, ও মাই বাংলা। নামটা কেমন হয়েছে? খুব ক্যাচি না?”

আমি মাথা নাড়ালাম, উপর নীচে। বন্ধু বলল, “এই ধরনের টিশার্টগুলো সিজ়নাল আর্টিকেল বুঝলি। দিন সাতেক আগে ভ্যালেন্টাইন’স ডে গেল। প্রেমে পড়ার ক্যাপশন থেকে প্রেম ভাঙার ক্যাপশন সবই হাজির করেছিলাম।”

আমার ভ্রুযুগলে হয়তো জিজ্ঞাসাচিহ্ন ছিল। আঁচ করে বলল, “পূর্বরাগের মালগুলো কেনে ‘শোনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি’। আর যাদের ভালবাসা চটকে গিয়েছে, কিংবা চটকাব চটকাব করছে, ওরা পছন্দ করছে, ‘তবে কেন পায় না বিচার, নিহত গোলাপ।’ ছবিতে গোলাপের পাপড়িগুলোর মধ্যে কাঁটা দেওয়া থাকে। সব কিছুই স্টকে রাখতে হয় ভাই।”

জানতে পারলাম, প্রেম-পার্বণের পরেই হঠাৎ বিক্রি বেড়ে যায় ভাষা স্পেশাল ক্যাপশন টি-শার্টের। ওই বুটিকবিশ্বের হ্যাঙারে দোল খাচ্ছিল আরও নানা রকমের উদ্ধৃতিমাখা টি-শার্ট। বেশ কয়েকটায় লেখা ছিল, ‘আই লাভ মাই বাংলা।’ বলাই বাহুল্য, ‘লাভ’ কথাটা শব্দে লেখা ছিল না। পাতলা রবারে এমবস্ করা ছিল লাল রঙের বোঁটাহীন পানচিহ্ন, পাড়ায় পাড়ায় নতুন বসানো ‘আই লাভ মাই ওয়ার্ড’-এর মতো। উপরে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল চকচকে গুঁড়ো। গোলগলা জামাগুলো থেকে বাংলাপ্রেম চমকাচ্ছিল। একটা টি-শার্টে দেখলাম, সামনে লেখা রয়েছে, ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে..’ তার পরে দাঁড়ি নেই। অগুনতি ডটচিহ্ন। ডটগুলো বুকের সামনে লেখা লাইনের পর থেকে শুরু হয়ে পিঠের দিকে ঘুরে গিয়ে মেরুদণ্ডের জায়গায় এসে থামল। থামল বলা ভুল হল অবশ্য। দিক বদল করে এ বারে উঠতে লাগল মাথার দিকে। কলারের কাছাকাছি এসে মিলিয়ে গেল।

বন্ধু বলল, “এটা একদম নিউ অ্যারাইভাল।”

আমি বললাম, “ভাব সম্প্রসারণ করে দে। বুঝতে পারছি না কিছু।” জানতে পারলাম সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা এক ছাত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত এই নয়া ডিজ়াইন। সে আবার কবিও। তাঁর হোয়্যাটসঅ্যাপ স্টেটাসে নাকি লেখা আছে, ‘আমার কবিতা-জন্ম তুলিতে, কলম গর্ভে ছবি।’ এই টি-শার্টটার অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কেও অবগত হওয়া গেল, বন্ধুর দৌলতে। জানতে পারলাম, বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে যে ‘ওয়াও’ ফ্যাক্টরের জন্ম হয়, সেগুলোই ডটের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ডটগুলো বুক, মানে হৃদয় থেকে জন্ম নিয়ে মেরুদণ্ডে ভর করে মাথার গভীরে ঢুকে গিয়েছে। মানে, মাথার মাদারবোর্ডে ড্রিল করে দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষা। যত ক্ষণ বাঁচি তত ক্ষণ শিখি। বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানি! নতুন ভাবার্থ শিখলাম। ‘কাপল স্পেশাল’ সেকশনে পাশাপাশি কিছু টি-শার্ট ঝুলিয়ে রাখা ছিল। একটাতে বিরাট ‘ব’। অন্যটায় ‘অনুস্বার’। কপোত-কপোতী পাশাপাশি হাঁটলেই বং-এর জন্ম হবে। বাঙালি তো অন্তরে ভালবাসা ভরে বং হয়েছে কবেই। বং কানেকশন। কয়েকটি টি-শার্টে আবার খেলা করছিলেন সুনীল-শক্তি। আমার আন্তোপ্রানো সুহৃদের কথায়, “অনেক আশা নিয়ে বেশি করে স্টক আনিয়েছি রে! ২১ ফেব্রুয়ারি ইয়াব্বড় ফাংশন আছে পাড়ার চৌমাথার মোড়ে। ওয়ার্ডের সমাজসেবীরা, মানুষের পাশে আর মানুষের কাছে থাকা লোকজনদের যদি কোনও ডিজ়াইন চোখে পড়ে যায়, একটা বড়সড় অর্ডার পেতে পারি। দেখা যাক।”

আমি মাথা নাড়ালাম ফের। কিছু ক্ষণ পরে স্টলে এল এক যুবক ও যুবতী। কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হবে বড়জোর। ছেলেটির এক কানে দুল। মেয়েটির গলার কাছে একটা সাপের ট্যাটু। এমবিএ পড়ার সময় মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক বলেছিলেন, “কনজ়িউমার বিহেভিয়ার বোঝার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল ওত পেতে ক্রেতাদের কথাবার্তা শোনা।” ওই যুবক যুবতীর মধ্যে কথোপকথন ছিল এ রকম—

“হাবি, কিছু নিয়ে নে না বং টাইপস।”

“টোয়েন্টি ফার্স্টের পর এগুলো তো জাস্ট ট্র্যাশ হয়ে যাবে।”

“আরে ধুস! কাপড়টা ফ্যাব। কটন। হোল ইয়ার পরব তো। কলেজ ফেস্টও আছে সামনে।”

“তোর কটন টি-শার্টের অভাব থোড়ি না আছে।”

“প্লিজ়, হাবি, প্লিজ়। জাস্ট একটা কিনি!”

“লে হালুয়া! এমন আলফাল আব্দার কেন?”

“বাংলা স্পেশাল একটা গোটা দিন আছে হাবি। সেলিব্রেট কী করে করব দেন?”

“চল ডান। কোনটা নিবি?”

“এই লোকটা কে রে? কী লেখা এটা আছে বেশ? আবার আসিব ফিরে? সামনে এটা কার মুখ?”

“হু নোজ়! টেগোরটা সেফ। ওটাই নিয়ে নে।”

বন্ধু সানন্দে বিল কাটল। দু’শো টাকা। বলল, “ভাষা স্পেশাল টি-শার্ট নেওয়ার জন্য একটা গিফ্ট আছে আপনার জন্য ম্যাডাম। এক্সক্লুসিভ ইয়াররিং ফর ভাষা দিবস।” দেখি, একটা ছোট বাক্সের মধ্যে একজোড়া দুল। একটায় ২ ঝুলছে। অন্যটায় ১। মানে, ২১শে ফেব্রুয়ারি দু’কান থেকে ঝুলবে শ্রীভূমির প্যান্ডেলের ঝাড়বাতির মতো।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

ম্যাডাম বললেন, “অ্যামেজ়িং।”

শুনুন ও শোনান

কোন রেডিয়ো স্টেশন সেটা মনে নেই আর। তবে এক কাউন্সিলরের ভয়ঙ্কর হেঁড়ে এবং বেসুরো গলায় বছর তিনেক আগে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-র কথা যেমন ভুলতে পারিনি, ঠিক তেমন ভাবেই ভুলতে পারিনি ব্লু-টুথ স্পিকার থেকে আমার কর্ণকুহর স্নিগ্ধ করা রেডিয়ো জকির বার্তা। সে দিনও ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। মনের রেকর্ডারে রেকর্ড করেছিলাম। এক বার রিওয়াইন্ড আর রিপ্লে করার চেষ্টা করে দেখা যাক। ক’টা হবে তখন? সকাল সাতটা। আমি দাঁত মেজে কুলকুচি করছিলাম। অফিসের জন্য রেডি হওয়ার পালা। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা শেষ হলে আর জে, মানে রেডিয়ো জকি মুখ খুললেন।

“সুপ্রভাত বন্ধুরা, ইয়ানি, গুড মর্নিং এভরিওয়ান! ফ্রেন্ডস, আপনারা কি জানেন, আজকা দিন যো হ্যায় না, দ্যাট কামস্ উইথ এ লট অব সিগনিফিক্যান্স। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। দোস্তোঁ, আজকের দিনে বাংলা ভাষার জন্য এ লট অব পিপল হ্যাড ডায়েড। গুজ়র গ্যায়া থা। মাতৃভাষা, আই মিন, বাংলা ভাষা মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কমপেয়ারেবল। এই দিনটার কথা ভাবলেই চোখে জল চলে আসে বন্ধুরা। আঁখে ভিগ যাতা হ্যায়। একটা ভাষার ইজ্জত বাঁচানোর জন্য ইতনা আদমি কা মৌত হো গ্যয়া? সো ট্র্যাজিক অ্যান ইনসিডেন্ট কুড বি, দোস্তোঁ! আজকা দিন ভি প্যার কা হ্যায়। ভাষাকে ভালবাসার দিন। যদি আপনি আমার মতোই বাংলা ভাষাকে বাই হার্ট ভীষণ ভীষণ ভালবেসে থাকেন, গর্ব ফিল করে থাকেন, তা হলে ইসি ওয়াক্ত এই নাম্বারে হোয়্যাটসঅ্যাপ করে আপনার ভালবাসার কথা জানান, ইন নট মোর দ্যান থার্টি ওয়ার্ডস। টপ থ্রি বন্ধুরা পেয়ে যাবেন পার্ক স্ট্রিটের জবরদস্ত রেস্তরাঁসে বাম্পার ফুড পাস। কি বন্ধুরা! এক্সাইটিং না? এবারে উই উইল লিসন টু তিনটে বাংলাকে ভালবাসার গান। ব্যাক টু ব্যাক। দোস্তোঁ, পাশে আছেন তো?”

গণমাধ্যম থেকে এমন ভাষা শুনে যদি ভিরমি খেয়ে যান, তা হলে, স্যরি টু সে, আজকের দিনে আপনি অস্বাভাবিক। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি মোটে। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এমন এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষা তো সারা বছরই শুনতে থাকি রেডিয়োর বিভিন্ন চ্যানেলে। তাই বলে ভাষাদিবসেও বাংলা শব্দের মধ্যে ‘ইয়ানি?’ যাঁরা এমন আলটপকা প্রশ্ন তুলবেন, তাঁদের আমজনতা দুয়ো দেবেন সমস্বরে। বহু লোক ঠেকে শিখেছেন। শিখছেন প্রতিদিন। আপনারাও শিখুন।

এক পরিচিত বাচিকশিল্পী দিনকয়েক আগে কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, “সাবেকি রেডিয়োয় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন উপস্থাপক। রেডিয়ো জকির মতো তাঁদের সারা শরীরে নিয়ন আলোর দ্যুতি ছিল না। তাই হয়তো তাঁরা একটি ভাষাতেই কথা বলে যেতেন। আরও বড় ব্যাপার হল, ভাষাটা শুদ্ধ বলতেন। ওঁরা হারিয়ে গেলেন, কারণ জকিদের মতো তিনটে ভাষার ককটেল তাঁরা আয়ত্ত করতে পারলেন না কোনও দিন।”

আমি বোকার মতো ফের জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তাই বলে কি ভাষা দিবসের দিনেও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা যায় না? বছরে অন্তত একটা দিন?”

সপাটে উত্তর এসেছিল। উনি প্রায় গর্জে উঠে বলেছিলেন, “কী হবে বলে? ভাষাদিবসের মর্ম বোঝা এবং বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে লাভ কী?” এতটা বলে ভদ্রমহিলা থামলেন খানিক। উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে। মেঘে ঢাকা আকাশ। তারাহীন। মধ্যপঞ্চাশের ভদ্রমহিলা এ বারে বললেন, “এই রেডিয়োয় বুঁদ হয়ে আছে যারা, তাঁরা নিজেরা কথা বলে কি ভাষায়? তা নিয়ে ভেবে দেখেছ কখনও?”

কথাটা উনি ভুল বলেননি একদম। কয়েক বছর আগে ভাষাদিবসকে কেন্দ্র করে একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। বাসের জানালা থেকে এক ঝলকের জন্য দেখেছিলাম সেই অনুষ্ঠান। আয়োজক বললেন, “‘মাতৃভাষা কি ভেন্টিলেশনে?’ শীর্ষক আলোচনায় আমাদের মধ্যে আমরা পেয়ে গিয়েছি এক প্রবীণ ভাষাবিদকে। কেমন আছেন, স্যর?”

বয়স্ক মানুষটির মুখ থেকে ছুটে এসেছিল, “শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর। তোমাদের অনুষ্ঠানের শিরোনামের মতো। আমায় এনেছ কেন? ডিজে চালাও, ডিজে...” সিগন্যাল খুলে যাওয়ায় প্রবল হর্ন দিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল আমার বাস। দূরত্ব বাড়ে। শব্দেরা মুছে যায়।

বাসে-ট্রামে-মেট্রোতে-রেডিয়োয়-সমাজ মাধ্যমের রিল ভিডিয়োয় আমি শুধু কান পেতে রই। কথা শুনি, ভাষা শুনি। মিনমিন করে প্রশ্ন করি, “তুমি কেমন করে বাত করো হে গুণী? আমি অবাক হয়ে শুনি, শুধু শুনি।” প্রশ্নগুলো ফুঁ দেওয়া বুদ্বুদ বলের মতো ওড়ে। তিন চার সেকেন্ড এ দিক ও দিক ঘোরে কিছু ক্ষণ, উদ্দেশ্যহীন ভাবে। তার পরেই ফেটে যায়। নিঃশব্দে। আমিও নিজেকে পাল্টে নিই প্রতিদিন। নতুন শব্দ শিখে নিজে সমৃদ্ধ হই।

চার পাশের শোনা কথা থেকে কয়েকটা প্রশ্ন মনে বুড়বুড়ি কাটে। আমাদের কথ্য বাংলা ভাষা থেকে ‘কারণ’ কথাটা কি শীতঘুমে চলে যাচ্ছে ক্রমশ? লোকেরা কি ‘কারণ’ না বলে ‘কেন কী’ বলা পছন্দ করছেন? আজ সকালেই তো মেট্রোর সহযাত্রী মেয়েটি ফোনে বলছিল, “কাল যেতে পারিনি স্যর, কেন কী ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল।” বন্ধুর বুটিকে আসা ওই ছেলেটির মতো আরও বহু লোকের মুখ থেকে শুনি, “থোড়ি না আছে।” এই আজব শব্দবন্ধটির মানে এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না। আমায় চাপে পড়তে দেখলেই আমার নিখাদ বাঙালি বস কাঁধে হাত রেখে বলেন, “কুল থাকো, কুল থাকো।” প্রায়ই শুনি, “কাজটা আরামসে সাল্টে দিয়েছি।” ইংরিজির ‘সেটল’ নাকি হিন্দির ‘সালটানা’, কোথা থেকে এমন শব্দটি প্রতিদিনের কথ্য বাংলা ভাষায় চলে এল, তা জানতে ইচ্ছে হয় খুব। এগজ়িট ইন্টারভিউতে আমার বাংলা মিডিয়াম স্কুলের বন্ধু তার উপরওয়ালাকে সম্প্রতি বলেছিল, “এত মজদুরি করে মাসের শেষে এইটুকু মাইনে আর পোষায় না স্যর।” বাংলা অভিধানের আসন্ন সংস্করণে কি ঢুকে যাবে ‘ফ্যাব’ শব্দটি, ‘ফ্যাবিউলাস’ কিংবা চমৎকারকে তুড়ি মেরে? এমন অজস্র শব্দ ভনভন করা মাছির মতো প্রতিদিন ঢুকে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভাষায়। ভাষাবিদরা বলছেন, “বিভিন্ন ভাষার শব্দ নিয়ে বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে এক কদাকার, আঠালো চাউমিন তৈরি করে নিচ্ছি আমরা। এর ফলে কোনও ভাষারই যোগ্য সম্মান থাকছে না।” অথচ আমরা জানি, চলছে এমনটাই। এ ভাবেই বলতে হয়। না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।

দেখুন ও দেখান

বছরচারেক আগে শারদোৎসবের মুখে এক নামী পেন্ট সংস্থার বিজ্ঞাপনের কথা কত জনের মনে আছে জানি না। লেখা ছিল, ‘এই পুজো প্লাস্টিক দান করুন, নতুন বঙ্গ গড়ুন। এসো গড়ি নব বঙ্গ।’ হাসাহাসির রোল উঠেছিল চার দিকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রদানকারী এক তাবড় সংস্থা বাংলার উপভোক্তাদের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্ক বোঝাতে বহু খবরের কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। বড় বড় ফন্টে সেখানে যা লেখা ছিল তা হল এরকম। ‘যখন আপনি আমাদের সঙ্গে সম্পর্কতা শুরু করায় একটা প্রমিস বানান, তখন এটা শুধুমাত্র আমরা আমাদের রাখা হয়। কেননা একটা তৈরী করা প্রমিস হলো প্রমিস রক্ষিত করা।...’ মনে পড়ে, সমাজমাধ্যমে বাংলার এমন উটকো ব্যবহার নিয়ে ঝড় উঠেছিল। অস্বস্তির মুখে পড়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিল সংস্থাটি। ভাষার ব্যবহারে আরও বেশি সাবধান থাকার অঙ্গীকার করেছিল।

খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলে বুঝতে পারি, বিজ্ঞাপনের ভুল ভাষাকে কেন্দ্র করে ওই হইহট্টগোল আসলে ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’-র থেকে বেশি কিছু ছিল না। ছোট-বড় এমন নানা ভুলের সাক্ষী থাকছি প্রায় প্রতিদিনই। পাশে রাখা তিন-চার দিনের খবরের কাগজের পাতা ওল্টাই। এই তো, একটি বিখ্যাত সাইকেল উৎপাদক সংস্থা বিজ্ঞাপনে তাদের সাইকেলের ছবি দেওয়ার পর নীচে বড় বড় করে লিখেছে, ‘আসুন আমরা একটি সবুজ ও স্বাস্থ্যকর ভারতের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই।’ মানেটা বোঝা গেলেও বাক্যের গঠনে রয়ে গিয়েছে এক মস্ত গলদ। বহুজাতিক সংস্থাগুলি বাংলা-বাজারেও তাদের নতুন দ্রব্য ‘পেশ’ করে। জীবাণুনাশক নতুন সাবান কিংবা ক্রিম জানান দেয়, এটা ব্যবহার করলেই বডি হয়ে যাবে ‘বিলকুল সাফ।’ রিয়েল এস্টেট সংস্থা লেখে, ‘ফেজ-ওয়ান প্রজেক্টে আপনাদের টোটাল সমর্থন পেয়ে আমরা অভিভূত। ধন্যবাদ কলকাতা।’ বিখ্যাত পেমেন্টস ব্যাঙ্ক বিরাট বিজ্ঞাপনের শেষে খুদে অক্ষরে লেখে, ‘অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য গ্রাহকের একটি গ্রহণযোগ্য আইডি প্রমাণ জমা দেওয়া, একটি আদর্শ নেটওয়ার্ক উপলভ্যতা সহ, সার্ভারের প্রতিক্রিয়ার সময় ও গ্রাহকের প্রয়োজনীয় বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যাঙ্কিং পয়েন্ট দ্বারা সময়ের উপর নির্ভর করছে।’ তিন চার বার পড়েও মানে বুঝি না কিছু! নামজাদা জুয়েলারি চেন আশ্বাস দেয় ‘দীর্ঘস্থায়ী বিনামূল্যে রক্ষণাবেক্ষণ’-এর। একটি এলাচের মশলার সংস্থা কেশরীকে কার সঙ্গে কথা বলতে বলে জানি না। ধূপকাঠির সংস্থা লিখে দেয়, ‘এসে গিয়েছে মনমাতানো খুশবু।’ এমন বাংলা দেখে ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যায়, চন্দ্রবিন্দুর গানের লাইনের মতো।

বিজ্ঞাপন জগতে কর্মরত এক বন্ধুকে এ নিয়ে আমার নানা হিজিবিজবিজ প্রশ্ন জানাতে ও পাশ থেকে যা কানে এল, তা হল অট্টহাস্য। জানতে পারলাম, সর্বভারতীয় সংস্থার কোনও প্রিন্ট অ্যাডভার্টাইজ়মেন্ট প্রথমে তৈরি হয় এক মূল ভারতীয় ভাষায়— হিন্দি কিংবা ইংরিজিতে। তার পরে তা অনূদিত হয় বাংলা সহ বিভিন্ন
স্থানীয় ভাষায়।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “অনুবাদকরা কি টুকে পাশ?”

শুনে ও আবার খিলখিলিয়ে হাসল খানিক। তার পরে বলল, “অনুবাদের জন্য আবার মানুষ লাগে নাকি? কস্ট-কাটিংয়ের বাজারে কে আবার অত
কষ্ট করে! ইন্টারনেটে ট্রান্সলেটার টুলগুলো আছে
কী করতে?”

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “ঘটছে যে বড়সড় সব ভুল!”

ও বলল, “দুচ্ছাই! বিক্রি তো বাড়ছে। তোর কী? তুই কি এ যুগের রামমোহন?”

দোকান খুলল গলির মোড়ে। বাবা লোকনাথ ‘দশকম্মা’ ভান্ডার। মা ‘সাড়দা’ রোল সেন্টারের ভিড় সন্ধে থেকে আর সামলানো যায় না। পলিটেকনিক পাশ করা পাড়ার এক দাদা কোনও চাকরি না পেয়ে গুমটি খুলতে বাধ্য হয়েছে, ‘মিষ্ঠান্নের’। বলরামদার হোটেলের ‘ধোঁকাঢ়’ ডালনা-র খুব চাহিদা হয়েছে বাজারে। ল্যাম্পপোস্টে সেঁটে দেওয়া অমুক আয়া সেন্টারের বিজ্ঞাপন বলছে, ‘স্বল্প খর্চায় উন্নত মানের আয়া ডেলিভার করা হয়।’ দেখতে পাচ্ছি, দলের ‘একনিষ্ট’ কর্মীর অকালপ্রয়াণে ‘পরিবারবর্গদের’ সমবেদনা জানানোর পরে ওই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা ‘শোকস্তব্দ’। ওই তো, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নতুন বছরের জন্য ‘আন্তরীক প্রিতি ও শুভেচ্ছা’ জানিয়ে বিরাট ফ্লেক্স লাগিয়েছেন ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে। বিরাট মেলার ‘আহোবায়ক’ হিসেবেও দায়িত্ব সামলেছেন তাঁদের অনেকে।

এক শিক্ষাবিদকে আফসোস করে বলতে শুনেছিলাম, “ক্লাস নাইনে পড়া কিশোর কিশোরীদের সিংহভাগই এক লাইনও শুদ্ধ বাংলা লিখতে পারে না আজকাল। ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষা লিখতে পারে না বাংলাটা ঠিকঠাক আসে না বলে। এই ঠিকঠাক না আসার ব্যাপারটায় আমরা জরি বসানো হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করি। আর বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েগুলো লিখতে পারে না তাদের সুষ্ঠু ভাবে শেখানো হয় না বলে।”

বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নানা সমীক্ষা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাবোধের এই দুর্বলতার বিষয়ে সিলমোহর দেয়। আমার এক স্কুলশিক্ষক বন্ধু ক্লাস নাইনের একটি ছেলেকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ‘প্রতিযোগিতা’ বানান ভুল লেখার জন্য। বলেছিল, “এই সহজ বানানটাও না জানলে জীবনে দাঁড়াবে কী করে!”

শাস্তিগ্রহণের মিনিটখানেক পরে ছাত্রটি বলে, “স্যার বেঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি রাস্তার বিরাট হোর্ডিংটা। নেতার ছবি আছে, হাত জোড় করা। উনি তো দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। প্লাস্টিক ব্যবহার না করতে বলেছেন। ব্যবহার বানানটা কেমন যেন লাগছে! দেখুন তো স্যর।”

আমার বন্ধু মুখে কুলুপ এঁটে ছাত্রটিকে বসিয়ে দিয়েছিল। আমায় ফোনে বলেছিল, “ভুল বাংলা দিয়ে দুনিয়া গড়ে আমরা আছি বেশ। নির্ভুল শেখানোর দায় কি আমার একার?”

ফালতু লেখাটা ফেলার আগে

আরও একটা একুশে ফেব্রুয়ারি চলে এল। কিছু বয়স্ক মানুষ বাংলা ভাষা রক্ষার তাগিদে চেঁচাবেন ফের। টেলিভিশন চ্যানেলে সান্ধ্য বৈঠক বসবে। বলা হবে, ‘বাঙালির ভাষাপ্রেম শুধু এক দিনের?’ চলবে বিতর্ক। নতুন টি-শার্টে দিনটাকে ‘ফ্যাব’ করবে কিছু কলেজপড়ুয়া। বং সাজবে। ২২ তারিখ থেকে আবার সব অন্য রকম। ২০ তারিখও ঠিক যেমন ছিল।

সত্তর বছর বয়স ছুঁয়ে ফেলা আমার বাবার থেকে একটা গল্প শুনেছিলাম সম্প্রতি। গল্প নয়, স্মৃতির ছবি। আমরা তো আসলে ছিন্নমূল। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে মাথা গুঁজেছিলেন ওঁরা, ষাটের দশকের মাঝামাঝি ও পার বাংলা থেকে সেখানে দেখা করতে এসেছিলেন কিছু আত্মীয়। ছ’-সাত বছরের তিন চারটি শিশুও ছিল ওই দলে। তারা নাকি দিন
রাত বলত, “একুইশারি ফেবরুআরি, ভুলব না, ভুলব না।”

কথাগুলো মিশে গিয়েছিল রক্তে।

এ বছর কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক বার। ও দেশের প্রকাশকের কথ্য বাংলার মধ্যেও জড়িয়ে ছিল ‘সো’ আর ‘বাট’। বারবার।

কাকে যেন বিড়বিড় করে বলতে শুনেছিলাম, “ভাষায় ভাঙন লাগা শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশেও।”

বন্ধুবান্ধবদের জমায়েত ছিল সম্প্রতি, শহরের এক বিখ্যাত পাবে। ডিজে মেশিনের বিজয়রথে চেপে ট্র্যাকের সঙ্গে ট্র্যাক মিশল জোয়ারের মতো, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথের সঙ্গে মুহূর্তে মিশল আট লেনের হাইওয়ে। এ গান ও গান সে গানের মধ্যে পনেরো সেকেন্ডের জন্য বেজে গেল, ‘তোর কোন কোন জায়গায় ব্যথা গো, বান্ধবী ললিতা?’

শুনতে শুনতে মনে হল, মাতৃভাষার সঙ্গে গানটা শেয়ার করতে পারলে মন্দ হত না।

জাস্ট কিডিং, দোস্তোঁ! মজাও কি করতে পারি না? চিল! চিল!

ছবি: রৌদ্র মিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibasoriya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE