শিল্পীর কল্পনায় ভর্তৃহরি
যে রাত্রে আকাশে চাঁদের কণামাত্র নেই, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেছেন কি নক্ষত্রের বাড়াবাড়ি? আপনার মনে কি সত্যিই ভেসে উঠল রাতের আকাশ আর ঝিকমিক করে উঠল মহাজাগতিক জোনাকি? যদি বলি আমি এখন দুপুর থেকে ছিটকে আসা আলোয় আমার ঘরের পড়ার টেবিলে খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে ছাইপাঁশ লিখে যাচ্ছি, দেখতে পেলেন কি, ঘরোয়া দুপুরে বেপরোয়া কলমবাজ? পেলেন? শব্দের কি অপার ক্ষমতা, শুধু একটা শব্দই আপনার মনে জাগিয়ে তুলতে পারে রাতের আকাশ, দিনের চিৎকার! নিছক ছবি নয়, শব্দ জাগিয়ে তোলে অর্থ, তাৎপর্য। কিন্তু আপনি কি আমার টেবিলটি দেখতে পেয়েছিলেন? শব্দের খোলস ছাড়িয়ে কি দেখেছেন প্রকৃত সারস? তেমন শব্দভেদী দৃষ্টি কি আছে কারও?
আসলে তা হয় না। শব্দকে টপকে কোন ‘প্রকৃত’ জগৎ ধরা দেয় না আমার কাছে। এমন কোনও মাটিকে ছুঁতে পারি না, যা ‘রুক্ষ’ নয়, ‘সিক্ত’ নয়, ‘বাদামি’ বা ‘কালো’ নয়, নিছক মাটি। এও কোনও নতুন কথা নয়। দেরিদা কিংবা নিৎশেরও অনেক, অনেক আগে এই উপলব্ধি হয়েছিল মহাবৈয়াকরণ আচার্য ভর্তৃহরির। তিনি বলেছিলেন, ‘অনুবিদ্ধমিব জ্ঞানং সর্বং শব্দেন ভাসতে।’ সব ধরনের জ্ঞানই শব্দের দ্বারা অনুবিদ্ধ হয়ে ভাসমান থাকে।
আনুমানিক ৪৫০-৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভর্তৃহরি আবির্ভূত হয়েছিলেন ভারতের মাটিতে। বসুরাত-শিষ্য হিসেবে পরিচিত হলেও, বৈয়াকরণ হিসেবে তিনি আরও প্রাচীন ধারার উত্তরসূরি, যে ধারা পুষ্ট হয়েছে যাস্ক (পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দ), পাণিনি (চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), পতঞ্জলি (দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রমুখের অবদানে। যিনি ব্যাকরণ চর্চা করেন, তিনিই বৈয়াকরণ। আমাদের বিমলকৃষ্ণ মতিলালও ব্যাকরণকেই ‘মুখ্য বেদাঙ্গ’ বলে জানিয়েছিলেন।
একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে ভর্তৃহরির নাম উল্লিখিত হলেও, যে গ্রন্থটির সাথে নিশ্চিত ও আবশ্যিক ভাবে তাঁর নাম যুক্ত, সেটি হল ‘বাক্যপদীয়’। ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও দর্শনের সম্মিলনে এই গ্রন্থ এক আশ্চর্য কীর্তি! ছন্দোময় সংস্কৃত ভাষায় শ্লোকের পর শ্লোক কেবল শব্দকেই নিবেদিত। এমন শব্দপূজা আর কে কবে করেছেন? প্রারম্ভিক শ্লোকে আচার্য শব্দকেই পরমসত্তা রূপে বর্ণনা করেছেন: শব্দতত্ত্বরূপ অক্ষর ব্রহ্ম থেকেই জগৎ বিবর্তিত হয়েছে। ব্রহ্মকে বলা হয়েছে ‘অক্ষর’, তিনি ‘ক্ষর’ অর্থাৎ পরিবর্তনশীল নন। আবার ‘অক্ষর’ বলতে তো বর্ণও বুঝি। ‘ক’— এই চিহ্নের সঙ্গে ‘ক’ বর্ণের সম্পর্ক তো আপতিক, বর্ণ অবিনাশী। ভাষ্যকারেরা ভর্তৃহরিকে ‘শব্দব্রহ্মবাদী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, এই উল্লেখ যথার্থ। তাঁর মতে এই জগৎ শব্দময় এবং ব্রহ্মই এই শব্দসমূহের উৎস। শব্দ, অর্থাৎ ভাষা। ‘ভাষা’ শব্দটি তুলনায় অর্বাচীন। ভারতীয় দর্শনে শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ সম্প্রদায়ই শব্দকে পৃথক প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেছেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘শব্দ’ মানে শাস্ত্র বা জ্ঞানী ব্যক্তির বচন। কিন্তু ভর্তৃহরির মতে, শব্দ শুধু প্রমাণ নয়, জ্ঞানের বিষয়, জ্ঞান, এমনকি জ্ঞাতাচৈতন্যও শব্দ। ‘শব্দ’ যেন সেই বাক্ যার প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলেছেন— বাক্ বৈ ব্রহ্ম ইতি। জনক রাজাকে যাজ্ঞবল্ক্য ব্যাখ্যা করছেন, সমস্ত বেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, উপনিষৎ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যান, ব্যাখ্যান, ইষ্ট, হোম, অশন, পানীয়, ইহলোক, পরলোক, সর্বভূত, এমনকি বন্ধুকেও বাক্ দ্বারাই জানা যায়।
বাক্ই পরম ব্রহ্ম। আমার আমি, আমার দেহ, আমার পায়ের তলার মাটি, ঘাস, গঙ্গাফড়িং, আমার বারান্দায় টবের গাছ, আমার বই, কবি ও কবিতা, আমার আকাশভরা সূর্যতারা, বন্ধু, হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ, মুখ ও মুখোশ, সব শব্দ! আমার চেতন, অবচেতন, অবভাস, অবভাষা, ভাষা— সব ভাষা। আমার এই সাধের কলমটিকে বোঝাবার জন্যে আমি যে ‘কলম’ শব্দটি ব্যবহার করছি, শুধু এটুকুই নয়। কলম নামক বস্তুটিও শব্দার্থ হিসেবে শব্দই। জগতের যাবতীয় বস্তুই কোনও না কোনও শব্দের অর্থ। অর্থকে ভর্তৃহরি বলবেন ‘স্ফোট’, যা আর কিছুই নয়, বুদ্ধিতে বস্তুর উপলব্ধি বা প্রতীতি। প্রতীতি শব্দেই ধৃত থাকে। বুদ্ধি, অর্থাৎ প্রতীতি বস্তুকে যে ভাবে প্রকাশ করে থাকে, তার অতিরিক্ত কোনও সত্তা বস্তুর নেই।
সারস্বত: ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থের অংশ।
উচ্চারিত শব্দকে ভর্তৃহরি বলেছেন ‘নাদ’ বা ‘বৈখরী’। বক্তার দিক থেকে শব্দের তিন ভাগ— পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। অনবদ্য উপমায় আচার্য এই ত্রিবিধ বাক্ সম্বন্ধে বললেন, ‘অনেকতীর্থভেদায়া’। তীর্থ, অর্থাৎ অধিষ্ঠান। প্রাণ (শ্বাস), বুদ্ধি এবং হৃদয়কে আশ্রয় করে যথাক্রমে বৈখরী, মধ্যমা এবং পশ্যন্তী ‘আত্মলাভ’ করে। আবার ‘তীর্থ’ এসেছে ‘তর্’ ধাতু থেকে। ‘তর্’ গতিব্যঞ্জক, যা থেকে তরণ বা পার হওয়া। তীর্থ মানে ঘাটও। ভাষা-নদী তিনটি ঘাটকে স্পর্শ করে কেমন বয়ে চলেছে! বাক্ স্রোতস্বিনী, শব্দময় এই প্রপঞ্চ যে কাল-শক্তিরই ক্রিয়া, সে কথা আচার্যই বলেছেন।
পশ্যন্তী বাক্-এর সূক্ষ্মতম অবস্থা, একে বলতে পারি স্ফোটরূপ অর্থের ক্রমজ্ঞানহীন উপলব্ধি। বলা হয়, উচ্চারিত শব্দের একটি ক্রম থাকে, কিন্তু শব্দার্থ একটি অখণ্ড উপলব্ধি। মধ্যমা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “আমি এই শব্দটি উচ্চারণ করব”, বুদ্ধিস্থিত এমন শব্দাকারই মধ্যমা। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের মতে, এই মধ্যমা স্তরে অর্থ এবং বাচিক দিকটির (যা উচ্চারিত হবে) তফাত বক্তা করতে পারে। প্রাণ, অর্থাৎ শ্বাস যুক্ত হয়ে উচ্চারিত শব্দই বৈখরী বা নাদ। প্রাণবায়ু, কন্ঠ, তালু, জিহ্বা ইত্যাদির অভিঘাতে উৎপন্ন হয়ে এই শব্দ ছড়িয়ে পড়ে বলেই তা বৈখরী। হিন্দিতে যাকে বলতে পারি— বিখর গয়া। ব্যাকরণ এই বৈখরী বাকেরই অনুশাসন করে থাকে।
তাই বৈখরী অধ্যুষিত প্রপঞ্চে আমি এক নীরব মধ্যমা, শব্দকলম থেকে উগরে দিচ্ছি সারিবদ্ধ বর্ণমালা। ‘কলম’— এই শব্দবন্ধন ছিন্ন করে আমি ‘বিশুদ্ধ’ বস্তুতে পৌঁছতে পারি না। ‘কলম’ কেবল ধ্বনি নয়, শব্দ ও অর্থের যুগলবন্দি। মহাকবি কালিদাস শিব-পার্বতীকে বাক্ ও অর্থের মতোই সম্পৃক্ত বলেছেন। এমনকি যে চৈতন্য জ্ঞাতা, সেও তো বাগ্রূপতাকে অতিক্রম করতে পারে না, বলেছেন ভর্তৃহরি। জ্ঞাতা হিসেবে শব্দার্থের জাল ছিন্ন করে শব্দময় এই জগৎ পেরিয়ে কিছুতেই ছুঁতে পারব না অর্থহীন প্রকৃত জগৎ। শব্দ আমার বন্ধন নয়, শব্দই আমার আশ্রয়— ভাষাই আমার দেশ, আমার ঘর। শব্দের এই অমোঘতা লক্ষ করেই ভর্তৃহরি বলেছিলেন, শব্দকে অস্বীকার করা স্ববিরোধী। কারণ ‘ন শব্দ’ বা ‘শব্দ নেই’ বললেও তো শব্দকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। তুলনা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ‘অহমস্মি’ বা ‘আমি আছি’— এই প্রত্যয়ও যেমন ‘নাহমস্মি’ বা ‘ন মম’—এই রকম বিপরীত প্রত্যয় দিয়ে বাধিত করা যায় না, করলেই তা স্ববিরোধী হবে। ভবিষ্যতের হাজার বছর পেরিয়ে যেন ফরাসি দার্শনিক দেকার্তকেও দেখতে পেয়েছিলেন আচার্য ভর্তৃহরি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy