ওরা তখনও কেউ জানত না, ওটা ওদের ইস্কুলে যাওয়ার শেষ দিন! কারণ সে দিন বাড়ি ফেরার সময় লক্ষ্মী মেয়েদের মতো রোজকার ইস্কুল ভ্যানে না উঠে ওরা পাঁচ বোন একটু সমুদ্রের ধারে গিয়েছিল। সেখানে ক্লাসের ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে প্রচুর হুল্লোড়, জল-ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছিল। খেলার ছলে মেয়েরা ছেলেদের পিঠেও চড়েছিল। তাদের গাঁয়ের এক মাসিমা গোছের মহিলা তা দেখে ফেলে! ব্যস! আর যায় কোথায়! মেয়েগুলোর ঠাকুমার কানে কথাটা ওরা বাড়ি পৌঁছবার আগেই পৌঁছে যায়। বড় তিন বোনকে সে জন্য ঠাকুমা ঘরের দরজা বন্ধ করে হালকা পিটুনিও দেন। সঙ্গে বকুনি— তোদের উপচানো যৌবন পরপুরুষে ছুঁয়ে দিল! হায়া নেই তোদের? এ তল্লাটের কেউ আর তোদের বিয়ে করবে?
ওদের কাকা ফিরে এসে বড় বোনের চুলের মুঠি ধরে আর এক প্রস্থ মারধর করতে যাচ্ছিল, ঠাকুমা ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনও রকমে ছাড়ান। কিন্তু ডাক্তারখানায় নাতনিদের সতীত্ব পরীক্ষা ঠেকাতে পারেন না। সাগরজলে ছেলেদের সঙ্গে হুটোপাটি করেও ভাইঝিদের কৌমার্য ঠিক আছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েই কাকা এ বার নতুন ফতোয়া জারি করলেন— ঢের হয়েছে। কাল থেকে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
কাকার শাসনে, ঠাকুমার দেখভালে, পাঁচ বোনকে এ বার ‘গৃহকর্মনিপুণা’ করে গড়ে তোলা শুরু হল। এ পাড়া-ও পাড়া থেকে পিসিমা-দিদিমারা এসে চাপাটি থেকে চুইংগাম অবধি রকমারি রান্না, সেলাই-ফোঁড়াই সব শেখাতে শুরু করে দেন। গোটা বাড়িটা যেন হয়ে ওঠে বউ বানানোর আজব কারখানা।
খানিক আত্মজৈবনিক ছবিটায় (এটাই পরিচালিকার প্রথম কাহিনি-ছবি) যে অনাথিনী পাঁচ বোনের গল্প বলেছেন, তাদের বাবা-মায়েরা বেঁচে থাকলেও গল্পটা বোধহয় একটুও পালটাত না। কারণ কৃষ্ণসাগরের তীরে উপকূল-তুরস্কের ওই গ্রামটায় বা ওই রকমই আরও অনেক গ্রামে অবরোধের সংস্কৃতিটা একই রকম থেকে যাবে। মেয়েদের জন্মই হবে বাড়ির লোকের বেছে দেওয়া কোনও হুমদো পাত্রের সতীলক্ষ্মী বউ হওয়ার জন্য। ফুলশয্যার পর দিন সকালে শয্যায় রক্তচিহ্ন দেখাতে না পারলে, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলবে, বউমা ‘অসতী’! মেজ বোনের ক্ষেত্রে সে ঝামেলা হয়ও। ফের ডাক্তারখানা।
ঘরে-বাইরে অবরোধ আর অবদমনের সমাজটাকে পরিচালিকা যে ভাবে দেখেছেন, তাতে কৌতুকের পাশাপাশি কোথাও একটা তাচ্ছিল্যও ছুড়ে দেওয়া আছে। এক সময়ের ইরানি ছবির মতোই আপাত-সরল, সহজ ন্যারেটিভে তিনি গল্পটা বলেছেন। সেখানে পুরুষতন্ত্রের নিষ্পেষণের উলটো পিঠে তিনি অন্দরমহলে একটা মেয়েলি পৃথিবীও তৈরি করেছেন। সেখানে অত্যাচারিত পাঁচ বোন যেমন আছে, তেমনই পিতৃতন্ত্রের তরফে সে নির্যাতনে যারা শামিল, সেই ঠাকুমা-পিসিমারাও তাঁদের শতাব্দীর অসহায়তা নিয়ে আছেন। গ্রিলের গরাদ ক্রমশ উঁচু করে করে, আরও নতুন গরাদ এনে, গোটা বাড়িটাকে দমচাপা জেলখানা বানিয়ে ফেলা যেমন আছে, তেমনই পাঁচ বোনের তরফে বিদ্রোহ আর অন্তর্ঘাতও আছে। বন্দিনী শরীর আর স্বাধীন ইচ্ছের ঠোক্করে সেটা ঠিকরে বেরিয়েছে। পরিচালিকা এখানে হয়তো খানিকটা সিনেম্যাটিক ছাড়পত্র নিয়েছেন। বোনেদের স্রেফ অন্তর্বাস পরে দালানে শুয়ে থাকায় বা বন্য-গহন খোলা চুলের রাশে সে বিদ্রোহ আছে।
এবং অবশ্যই লুকিয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার উৎসবে, বা ভরা রাস্তায়, বন্ধ গাড়ির মধ্যে অচেনা ছেলের সঙ্গে আচমকা যৌনতায় সেই অন্তর্ঘাত আছে। আর ছবির একেবারে ক্লাইম্যাক্সে অপছন্দের বিয়ে আর যৌন নির্যাতনকারী কাকার খপ্পর থেকে ছোট দুই বোনের ইস্তানবুলে পালিয়ে যাওয়াটা প্রায় গেরিলা যুদ্ধের মতো। হয়তো তাতে একটু ইচ্ছাপূরণের ছোঁয়া আছে। তবু এই জিতে যাওয়াটুকু বিশ্বাস করতে বড্ড ইচ্ছে করে।
sanajkol@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy