Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ছড়ার ছন্দে বাংলার ইতিহাস

‘আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম’ সেইসব ডোমসৈন্যের কথা বলে যারা বাংলার সীমান্ত রক্ষা করত। ‘এলাটিং বেলাটিং’ দেখায় ভোগের জন্য গরিব ঘরের মেয়ে কেনাবেচার ইতিহাস। মেয়েদের মুখে-মুখে তৈরি ছেলে ভোলানো ছড়াগুলিতে আছে সমাজের নানা ছবি। অর্পিতা চন্দসাহিত্যচর্চার মতো ভেবেচিন্তে কথা বসানো নয়, শব্দের চলন এখানে নিশ্বাস–প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি কোনও ইতিহাস লেখার জন্য ভেবেচিন্তে কিছু করা হয়নি।  তবু ছড়াগুলিতে রয়ে গিয়েছে নানা সমসাময়িক ঘটনার প্রভাব, যার সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।

ছবি:ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি:ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

নকশিকাঁথা, আল্পনার মতো ছেলে-ভোলানোর ছড়াও প্রধানত মেয়েদের তৈরি। মা-ঠাকুমারা ছেলে ভোলানোর জন্য কথার পিঠে কথা বসিয়ে, ছন্দ মিলিয়ে এগুলি তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আধুনিক কালের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অনেকেই ছড়া লিখেছেন। আবার কখনও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার অঙ্গ হিসেবে রচনা হয়েছে ছড়া, যেমন, এলাটিং বেলাটিং সই লো, কিসের খবর আইল ইত্যাদি। সাহিত্যচর্চার মতো ভেবেচিন্তে কথা বসানো নয়, শব্দের চলন এখানে নিশ্বাস–প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি কোনও ইতিহাস লেখার জন্য ভেবেচিন্তে কিছু করা হয়নি। তবু ছড়াগুলিতে রয়ে গিয়েছে নানা সমসাময়িক ঘটনার প্রভাব, যার সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।
আমরা উদাহরণ হিসাবে প্রথমে খুব চেনা-জানা একটা ছড়া দেখি। -
আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।
কমলাফুলির টিয়েটা।
সুয্যিমামার বিয়েটা।।
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
এক খিলি পান কিনে খাই।।
পানের ভিতর ফোঁপড়া।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।
কচি কচি কুমড়োর ঝোল
ওরে খুকু গা তোল।।
জ্যোৎস্নাতে ফটিক ফোটে, কদম তলায় কে রে।
আমি তো বটে নন্দ ঘোষ, মাথায় কাপড় দে রে।।
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
মামার নামে টগর ফুল॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছেলেভুলোনোর ছড়া’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই ছড়াটির প্রথম কয়টি ছত্রে বিবাহ যাত্রার বর্ণনা আছে। আগে অভিজাত পরিবারের বিবাহের শোভাযাত্রা ছিল যুদ্ধযাত্রারই পরিবর্তিত রূপ। কারণ একটা সময় জোর করে মেয়েদের তুলে আনা হত। বিজয়ী গোষ্ঠীর লোক বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করবে, এমন প্রথা ছিল। আজও কিছু অবাঙালিদের বিয়েতে ঘোড়ায় চেপে হাতে তরোয়াল নিয়ে বিবাহ করতে যাওয়ার রীতি আছে। এই ছড়াটিতে সেই বিবাহযাত্রারই একটি রূপের বর্ণনা পাই আমরা। কৃত্তিবাসী রামায়নেও এমন বীররসাত্মক বর্ণনায় বরযাত্রীদের শোভাযাত্রার কথা বলা আছে। এমনকি তখনকার দিনে বিয়েতেও জয়ঢাক যে বাজানো হত, তার উল্লেখ আছে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে।
কিন্তু মূল ছড়ার প্রথম অংশ আসলে ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘বেনের মেয়ে’ গ্রন্থে আমরা এই ছড়ার একটি অন্য রূপ আমরা পাই -
“আগডোম, বাগডোম, ঘোড়াডোম সাজে।
ডাল মৃগল ঘাঘর বাজে,
বাজতে বাজতে পড়লো সাড়া
সাড়া গেল বামনপাড়া”।
(একাদশ পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয়াংশ)
এবার আসি সেই ইতিহাসের ভুলে যাওয়া গল্পে, যা প্রচ্ছন্নভাবে ধরা আছে এই ছড়ায়। সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের বাগদী রাজা, রূপারাজা যখন হরিবর্মার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, তখন হুকুম দিলেন ‘‘সব বাগদী সাজ’’। রূপারাজার ছিল বাগদী ও ডোম সেনা। বাগদী সেনারা লড়াই করে, কিন্তু ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। একসময় এই ডোম সেনারাই বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ছিল। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোম সেনা ছিল। আগডোম মানে অগ্রবর্তী ডোম সৈন্যদল, ‘বাগডোম’ মানে বাগ বা পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা এবং ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী সৈন্যদল। যুদ্ধের দামামা বাজলেই এই ডোমসেনারা গিয়ে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতেন, রাস্তা বানাতেন আর ঘোড়ায় চেপে দেশের অবস্থা-পরিস্থিতির উপর নজর রাখা শুরু করতেন। এই ডোম জাতি রাঢ় অঞ্চলের সেই সমস্ত তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যারা একদিন নির্ভীক বীরের মতো যুদ্ধ করতেন সমাজের উঁচু তলার রাজা, মহারাজা ও সামন্তপ্রভুদের জন্য। তাঁদেরই বীরত্বের বলে প্রভুরা হতেন ‘অরি-বিমর্দন’, ‘সসাগরা ধরণিপতি’ আর থাকতেন নিরাপদে। এই সব প্রভুদের কথা ইতিহাদের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি কোন ইতিহাস বই বা তাম্রশাসনে। এদের বীরগাথা লুকিয়ে আছে বাংলার ছোট ছোট ছেলেদের খেলার ছড়ায়, আছে লোকসঙ্গীতে, লোকগাথা ও রাঢ় বাংলার মঙ্গলকাব্যে, যেগুলিকে অনেকেই ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এই ছেলে ভোলানো ছড়াতেই ধরা আছে সেই ডোমসেনাদের সীমান্তরক্ষার কাহিনি। মধ্যযুগের বাংলার লৌকিক সাহিত্যে এইরকম অনেক ডোম বীরের শৌর্যের কাহিনী আছে। ‘ধর্মমঙ্গল’–এ কালু ডোম ও লখাই ডোম এর উদাহরণ আছে। তাই ছড়াটিকে আমরা ইতিহাসের স্বাক্ষর বলতেই পারি।
তারপর একদিন এই ডোম সৈন্যদলের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুরোল, আর আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেন এই সেনারা। তাই এই ছড়ার মূল অর্থ অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেন না।
ঘরের ভিতরে সময় কাটানোর জন্য ছোটদের খুব জনপ্রিয় একটি খেলা ‘ইকিড়-মিকিড়’। বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়জলের সময় যখন বাড়ির বাইরে যাওয়া যেত না, সেইসব দিন কাটাতে এই খেলার জুড়ি ছিল না। এর সঙ্গে যে আমরা বলতাম —
ইকিড় মিকিড় চামচিকির
চামে কাটা মজুমদার।
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়ি কুঁড়ি
দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।
চাল কুড়িতে হল বেলা
ভাত খেয়ে যা জামাইশালা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা
খা খ্যাঁকশিয়ালের মাথা।
নিতান্ত শিশুদের খেলার ছড়া। তবু এই ছড়াটিও ধরে রেখেছে ইতিহাসের একটি স্বল্প আলোচিত অধ্যায়। ছড়াটিতে ধরা আছে বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠালেন বাংলার বারো ভুঁইঞাদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করতে। মানসিংহ জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আসতে গিয়ে পড়লেন ঝড়ের কবলে। তখন তাকে সাহায্য করলেন তিনজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’। তারা হলেন, ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষীকান্ত মজুমদার এবং জয়ানন্দ মজুমদার। এঁরা তিনজনেই মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন। এঁদের মধ্যে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, হুগলির কানুনগো দপ্তরের মুহুরি ভবানন্দ মজুমদারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়। ভবানন্দ মানসিংহকে নৌকো দিয়ে নদী পার হতে সাহায্য করেন। নিজের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে আসেন ও বিশাল সৈন্যবাহিনীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে ‘চামচিকির’ কথাটার মানে যে বিশেষ সুবিধের নয় তা বোঝা সহজ। ‘চামে কাটা’ মানে যার ‘চামড়া নেই’ বা নির্লজ্জ–বেহায়া। আর ইঙ্গিতটি মানসিংহের সাহায্যকারী মজুমদারের প্রতি।
দামোদরের বন্যা তো একটা সময় প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল । তাই কোনও নদীর বর্ষায় ফুঁসে ওঠা বা তার ভয়ঙ্কর রূপকে দামোদরের ধেয়ে আসার সাথেই তুলনা করা হত। আর তাই ঝড়বৃষ্টির রাতে ফুঁসে ওঠা জলঙ্গীকে এখানে দামোদরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার যে বিপুল আয়োজন তা ভবানন্দ মজুমদার হাসিমুখে করলেও তার তাঁর পাকশালের কাজের লোকেদের অবস্থার কথাও হয়তো ধরা আছে ছড়ায়। রান্নার ব্যবস্থা করতে তাদের বেলা গড়িয়ে যেত। আর বাংলার ভুঁইঞাকে আক্রমণ করতে আসা মানসিংহকে যে বাংলার মানুষ নেকনজরে দেখবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। আর ভারতসম্রাটের সেনাপতিকে যে ভবানন্দ ‘জামাই’ আদরে রেখেছিলেন এটাও তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। যেহেতু ছড়াগুলির উৎপত্তিকালের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই, তাই এই বিশ্লেষণগুলি নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে প্রতাপাদিত্য, ভবানন্দ আর মানসিংহের এই সংঘাতের ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
উপেনটি বাইস্কোপ
উপেনটি বাইস্কোপ
নাইন টেন টাইস্কোপ
চুলটানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা।
বাবু বলেছেন যেতে
পান সুপারি খেতে।
পানের ভিতর মৌরি বাটা
ইস্কাপনের ছবি আঁটা।
আমার নাম যদুমণি
যেতে হবে অনেকখানি।
এই খেলাটি কয়েক প্রজন্ম আগে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে খেলেননি এমন কোনও মেয়ে পাওয়া বিরল। দু’জন রাজার উঁচুতে রাখা ইংরেজি হরফ ‘ভি’-এর মতো হাতের ফাঁক দিয়ে সবাইকে বৃত্তাকারে ঘুরতে হয় আর ছড়াটি শেষ হতেই একজন ধরা পড়তেন তাদের হাতের ফাঁকে। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও মানে না বোঝা গেলেও ওই সাহেব বাবুর বৈঠকখানায় যদুমণির পান-সুপারি খেতে যাওয়ার নিমন্ত্রণের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক করুণ ইতিহাস। এই দেশে একটা সময় পর্তুগিজ ও ইংরেজ সাহেবদের মধ্যে এদেশীয় মেয়েদের রক্ষিতা বা বিবি হিসেবে রাখার একটা চল ছিল। আর তা যে তারা সোজা পথে করতেন, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কখনও কখনও গ্রামবাসীরা ভয়ে নিজেদের বাড়ির মেয়ে তাদের সমর্পণ করতেন বা আবার কোথাও-কোথাও সাহেবরা বলপূর্বক এটি করতেন। আবার এই মেয়েদের তারা ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রিও করে দিতেন।
এই ছড়াটিতে সাহেবদের বৈঠকখানার সেই আমোদ-প্রমোদের তাসের আসরে যদুমণিদের রক্ষিতা হয়ে যাওয়ার চিত্রই ফুটে উঠেছে। বাঙালি মেয়েদের এই লাঞ্চনার ইতিহাসই লেখা আছে এই ছড়ায়। তবে ‘বাইস্কোপ’ কথাটির সংযোজন থেকে মনে হয় যে, এই কথাটি হয় পরবর্তী সংযোজন বা হীরালাল সেনের হাত ধরে এদেশে বায়োস্কোপ আসার পরবর্তীকালের সৃষ্টি।
এলাটিং বেলাটিং সইলো ...
এটিও একটি মেয়েদের খেলার ছড়া। সমান সংখ্যক মেয়ে নিয়ে দু’টি দলে ভাগ হয়ে খেলা এই খেলার নিয়ম। খেলার নিম্নলিখিত ছড়াটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বলা হয়—
প্রথম পক্ষঃ এলাটিং বেলাটিং সইলো।
দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসের খবর আইলো?
প্রথম পক্ষঃ রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো।
দ্বিতীয় পক্ষঃ কোন বালিকা চাইল?
প্রথম পক্ষঃ অমুক বালিকা চাইল।
দ্বিতীয় পক্ষঃ কী প’রে যাবে?
প্রথম পক্ষঃ বেনারসী প’রে যাবে।
দ্বিতীয় পক্ষঃ কীসে ক’রে যাবে?
প্রথম পক্ষঃ পালকি ক’রে যাবে।
দ্বিতীয় পক্ষঃ কত টাকা দেবে?
প্রথম পক্ষঃ হাজার টাকা দেবে।
দ্বিতীয় পক্ষঃ নিয়ে যাও নিয়ে যাও বালিকা।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই অর্থের বিনিময়ে মেয়ে কেনাবেচা চলত। রাজা বা জমিদাররা অর্থের বিনিময়ে নিজেদের ভোগের জন্য গরিব ঘরের মেয়েদের কিনতেন। দিল্লিতে এরকম মেয়ে কেনা-বেচার বাজার ছিল। সমাজের এক করুণ ঘটনা খেলাটির ও ছড়াটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
শেষে একটি ঘুমপাড়ানি ছড়া বা ছেলে ভোলানো ছড়ার কথা বলব। এই ছড়া শুনে ঘুমোয়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদের সকলেরই ছোটবেলার সঙ্গে এই ছড়া জড়িয়ে আছে।
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরলো, পান ফুরলো, খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।
এই ছড়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মরাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে ১৭৪১ সালের অগস্ট মাস থেকে ১৭৫১-র মে মাস পর্যন্ত মরাঠা বর্গীদের দ্বারা ছ’বার বাংলা আক্রমণের ইতিহাস। মরাঠা বর্গীদের এই আক্রমণে বাংলা ও বিহারে প্রায় চার লক্ষ প্রাণ গিয়েছিল এবং প্রভূত ধন-সম্পত্তি লুঠ হয়েছিল। মহিলাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। বাংলার নবাবের সঙ্গে চৌথ আদায়ের চুক্তিতে সন্ধি হলে আক্রমণ বন্ধ হয়। ছড়ার মধ্যে খাজনা আদায় সংক্রান্ত উদ্বেগও স্পষ্ট। পূর্ববঙ্গে বর্গী আক্রমণ হয়নি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল অবধি এই আক্রমণ চলে। এই সময় বহু মানুষ কলিকাতা ও বহু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। সম্ভবত তাঁরাই ছড়াটি পূর্ববঙ্গে
নিয়ে গিয়েছেন।
আমাদের গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে এমন অজস্র ছড়া লুকিয়ে আছে। ইতিহাস শুধু রাজা-রানির কথা বলে, কিন্তু এই ছড়াগুলো বলে সাধারণ মানুষদের কথা। তাই এই ছড়াগুলি হারিয়ে গেলে এই ইতিহাস হারিয়ে যাবে। শুধু ছড়াগুলি কেন, হা-ডু-ডু, গাদি, কুমিরডাঙা, এক্কাদোক্কা ইত্যাদি অনেক খেলার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন ইতিহাস যার সমাজত্বাত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বাংলার বহু মনীষী এই ছড়াগুলির গুরুত্বের কথা বলে গেছেন। তাই শুধু ছড়া সংকলন নয়, তার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাও করা দরকার। তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Literature Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy