বিধানসভায় জ্যোতি বসুর অফিসের কম্পিউটারে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেট কানেকশন। ১৯৯৮ সালের ছবি।
নব্বইয়ের দশক। লেখাপড়ার পাট শেষ, রোজগারের ধান্দায় ঘুরছি। বামপন্থীদের বিরোধিতার পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে অফিসে কম্পিউটার ঢুকতে শুরু করেছে সবে। কমার্সের ছাত্রদের একটা অ্যাকাউন্টিং কোর্স করা থাকলে চাকরি পাকা, সন্ধান দিল এক বন্ধু। ব্যাপারটা পরখ করতে গেলাম আমি আর আমার বন্ধু রুবন। রুবনের সাইকেলে সওয়ার হয়ে উল্টোডাঙার এক অফিসে পৌছলাম। এসি অফিস। ঢুকতেই কফি। কাউন্সেলার ভদ্রমহিলা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে স্বপ্নের কেরিয়ারের রোডম্যাপ বোঝালেন। আর সব শেষে, সোনার চাবি হাতে পাওয়ার রাস্তা, অ্যাকাউন্টিং কোর্স ফি-র কথাও। সে অনেক টাকা। পরে যোগাযোগ করব, বলে কেটে পড়লাম। এত খরচায় অ্যাকাউন্টিং শেখা পোষাবে না।
ফেরার পথে বাগুইআটিতে একটা বাড়ির গায়ে দেখি লেখা ‘কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। ঢুক়লাম। আমাদের থেকে বছর দুয়েকের বড় ছেলেরা এখানকার ইন্সট্রাক্টর। ছ’মাসের কোর্স, মাসে শ’দুয়েক টাকা মাইনে। অঢেল সময় মেশিনে বসে হাতে-কলমে কাজ শেখার। আর কী চাই! ইনফরমেশন টেকনোলজির দুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়ে গেল আমাদের।
মাস্টারমশাইরা একাধারে শিক্ষক, গ্রাফিক ডিজাইনার ও ট্রেডার। আমাদের মত কিছু ছেলে কম্পিউটার শিখতে আসত, আবার বই, ছোটখাটো বিজ্ঞাপনেরও কাজ হত। এর সঙ্গে জুড়ল ডেটা এন্ট্রির কাজ আর কম্পিউটার সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির ব্যবসাও।
আমার সব ব্যাপারেই চূড়ান্ত উত্সাহ। বছর খানেকের মধ্যে আমিও ‘মাস্টার’ হয়ে গেলাম। তিন-চারটে ছেলেমেয়ে আমার কাছে ‘DOS’ (ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম) শেখে। পেজমেকার, কোরেল ড্র ব্যবহার করে বইয়ের কাজ করতে পারি। আগে থেকেই টাইপ জানতাম বলে ডেটা এন্ট্রির কাজেও বেশ দক্ষ। দাদারা বললেন, এ বার একটু টেকনিকাল সাপোর্টের কাজও করতে হবে।
দাদাদের যোগাযোগ ছিল মিস্টার জালান নামে এক মারওয়াড়ি ভদ্রলোকের সঙ্গে। উনি ব্যাঙ্গালোর থেকে দু’রকম জিনিস নিয়ে আসতেন। অ্যান্টি-ভাইরাস কার্ড আর মোডেম। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ইনস্টল করা, ইউজারদের ব্যবহার করতে সাহায্য করা, খারাপ হয়ে গেলে বদলে দেওয়া: এই হচ্ছে কাজ।
কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম, মিস্টার জালান নিজে জ্বলেন না, কিন্তু কাস্টমারদের জ্বালান। তখন এখনকার মতো অ্যান্টি-ভাইরাস সফ্টওয়্যার আলাদা করে পাওয়া যেত কম। সফ্টওয়্যারগুলো আসত হার্ডওয়্যার কার্ডের সঙ্গে। মানে, দুটোই লাগাতে হত কম্পিউটারে। এক বার কেউ অ্যান্টি-ভাইরাস লাগালে, প্রত্যেক মাসে সফ্টওয়্যার আপডেট করতে হত। প্রথম বছর বিনা পয়সায়, কিন্তু পরের বছর থেকে গুনতে হত নগদ কড়ি।
স্যাম পিত্রোদার হাত ধরে আমাদের দেশ তখন ‘যোগাযোগ ক্রান্তির’ আঙ্গিনায় সবে পা রাখছে। আজকের এত টেলিকম অপারেটর, এত প্রতিযোগিতা তখন কোথায়! ইন্টারনেট সংযোগ নিতে গেলে দরখাস্ত করতে হত বিদেশ সঞ্চার নিগমের কাছে। ফর্ম জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে হত, কবে বাবুরা দয়া করবেন, কবে একটা বন্ধ খামে ভিএসএনএল দফতর থেকে লগ-ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড সমেত ইউজার ম্যানুয়াল আসবে।
মোডেম বিক্রির জন্য এই সার্ভিসটা আমাদেরই দিতে হত। মানে, ফর্ম ফিল-আপ করিয়ে জমা করা পর্যন্ত। তখন ইন্টারনেট যোগাযোগ স্থাপন হত বাড়ির সাধারণ টেলিফোন লাইনের সঙ্গে প্যারালাল কানেকশন নিয়ে। কানেকশন দেওয়ার সময় টেলিফোনে কোনও কল এলে, হাতে কারেন্টের ঝটকাও খেতে হত। জালানবাবু বোঝাতেন, ‘সব কুছ পার্ট অব দি জোব আছে, ইয়ং ম্যান!’ ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই তখনও এ দেশে অশ্রুত। যাই হোক, সাধারণ ল্যান্ডলাইন টেলিফোন কাজ করে অ্যানালগ পদ্ধতিতে, আর ইন্টারনেট কাজ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এই অ্যানালগ আর ডিজিটাল-এর পারস্পরিক আদানপ্রদানের জন্যই মডিউলেটর-ডিমডিউলেটর, বা সংক্ষেপে মোডেম ব্যবহার করা হত। গোড়ায় ইন্টারনেটে শুধু টেক্সট মেসেজ আদানপ্রদান করা যেত। তারও পরে এল ব্রাউজার।
ই-মেলের মাধ্যমে তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ব্রাঞ্চের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে কিছু অফিস। তারাই আমাদের কাস্টমার। ঘরোয়া ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেট ইনস্টল করা শুরু হল আরও পাঁচ-সাত বছর পর থেকে। তখন থেকেই বাজারে আসতে শুরু করল বিভিন্ন দামের মোডেম। শুরু হল প্রতিযোগিতা।
মোডেমের সঙ্গে আসত তার ইনস্টলেশন সফ্টওয়্যার। কানেকশন দেওয়ার জন্য সেই সফ্টওয়্যার দিয়ে প্রথমে একটা বিশেষ টেলিফোন নম্বর ডায়াল করতে হত। তখন মোডেম থেকে ‘চিঁ... ক্র্যাও চোঁ... ওয়া.... ই ই ই’ জাতীয় শব্দ বেরোত। জালানবাবু রসিক মানুষ, বলতেন, ‘ইয়ং ম্যান, ইয়ে আছে মেটিং কল্স ফ্রম দি ইলেকট্রনিক জু’। ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফিরও সেটা আদি যুগ। মাধুরী দীক্ষিতের ‘বেটা’ ছবির ‘ধক-ধক’ ড্রেস পরা ছবি ডাউনলোড করতে পাক্কা ২৫ মিনিট থেকে আধ ঘণ্টা লাগত, পয়সাও খরচা হত তেমনই।
এর কয়েক বছর পর আমার এক আত্মীয়বাড়িতে মোডেম লাগানো হয়। সেই বাড়ির অন্য একটি ফ্ল্যাটে কবি জয় গোস্বামী ভাড়া থাকতেন। এই ঘরে জয় এসেছিলেন ফোন করতে। ফোনটা সেই সময় ইন্টারনেটে ব্যস্ত ছিল। ফলে রিসিভার তুলে কানে লাগাতেই ওই চিঁ...ওয়াও শব্দ তাঁর কানে গেল। কবি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন। পরে যখন তাঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া হল, তিনি বললেন, ‘ও, এটাই তা হলে মহাবিশ্বের মহাশব্দতরঙ্গ! দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল তো!’ আর আমি ভাবছিলাম, কৃষ্ণ কেমন? যার মনে যেমন!
অমিতাভ পুরকায়স্থ, মধ্যমগ্রাম
amitava23@gmail.com
নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy