E-Paper

বছর বছর বইমেলাতেই লেখক-পাঠকদের নতুন জন্ম

আর সকলের মতো ছোটবেলা থেকে পাঠক হিসেবেই যাওয়া শুরু। লেখালিখি শুরু করার পরই আগ্রহের ধরন বদলে যায় বইমেলাকে ঘিরে। লেখক বলে ‘আমাকে দেখুন’।

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৮
লোকারণ্য: বইপ্রেমী মানুষজনের এই জমায়েত আজও সংস্কৃতির অঙ্গ। ডান দিকে, প্রিয় বইয়ের সারিবদ্ধ বিপণি।

লোকারণ্য: বইপ্রেমী মানুষজনের এই জমায়েত আজও সংস্কৃতির অঙ্গ। ডান দিকে, প্রিয় বইয়ের সারিবদ্ধ বিপণি। ছবি: শুভেন্দু চাকী

বিচ্ছিরি রাক্ষস আর এক নির্বোধ বালক

বয়স মধ্য-চল্লিশ পেরোল। থুতনির দাড়িতে, জুলপির চুলে ধরেছে পাক। ‘ডাবল চিন’ জেগে উঠছে, কিন্তু ভিতরের সেই ভ্যালভেলে চোখে সব কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকা চোদ্দো বছরের ছেলেটার আর বয়স বাড়ল কোথায়! দু’চোখে তার ধ্যাবড়া করে মায়াকাজল পরানো, এখনও যে সে ‘মুখ দেখে চমকায়’, পদে পদে অবাক হওয়ার বদরোগটি যে আজও তার ঘুচল না। আর তার ঠিক উল্টো পিঠেই বাস করে এক বিচ্ছিরি রাক্ষস। এমনিতে সে অলস, উদ্যমহীন, দিন রাত পড়ে পড়ে ঘুমোয়, কিন্তু কপালগুণে কাঙ্ক্ষিত ক’টা লাইন লিখতে পারলেই বা মনের মতো কোনও গল্প বা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে আর সেগুলো নামী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দেখলেই সে তেড়েফুঁড়ে ওঠে। ঘরের ছাদ ফুটো করে আকাশে তুলে ধরে তার মাথা, বুক বাজিয়ে হাওয়ায় নখরযুক্ত লোমশ দুই হাত ছুড়ে নির্লজ্জ আত্মঘোষণায় মেতে ওঠে, হুঙ্কার দিয়ে উঠে বলতে চায়, ‘এই দুনিয়ায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই মাথা তুলে আমাকে দেখো, আমাকে আর শুধু আমাকেই।’

দু’হাজার বারো সাল। বড় বড় পত্রিকায় পর পর অনেকগুলো গল্প বেরোনোর পর আগের বছরেই জীবনের প্রথম লেখা উপন্যাসটি শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছে। সে সময়ের বড় একটা পুরস্কার পেয়েছে লেখাটি, আর এই বছর সেটি বই হয়ে বেরিয়েছে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। বিজ্ঞাপন দেখার পর থেকেই শরীরটা ফুলে উঠেছে হিলিয়াম গ্যাস ভরা বেলুনের মতো, মাটিতে পা পড়ছে না যেন, অহঙ্কারে মটমট করছে সর্বাঙ্গ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট বড় নদী নালা জলধারার মতো এঁকেবেঁকে যে লোকাল ট্রেনগুলো কলকাতা বইমেলা নামক এক সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়েছে, তার মধ্যে একটিতে এসে পৌঁছেছি সল্টলেকের ‘মিলনমেলা’ প্রাঙ্গণে।

আমি জানি আমার বইটি কোথায় বা কত নম্বর স্টলের কাচের শো-কেসে সাজানো রয়েছে। সেই মুখো পা চালিয়ে প্রকাণ্ড একটা গেট দিয়ে মেলার মধ্যে ঢুকে পড়ে সামান্য ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিলাম। কেউকেটা মনে হচ্ছে নিজেকে, বিলক্ষণ মস্ত এক তালেবর। বাইরে উচ্ছ্বসিত ঋতুরাজ বসন্ত, কিন্তু এই প্রাঙ্গণে এসে নিজের অজান্তেই কখন যে হয়ে উঠেছি মূর্তিমান রিপুরাজ! এখানে উপস্থিত হয়ে পড়েছি মানে, ভিনি ভিডি ভিসি, এ বার যাব, দেখব, জয় করব। ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট ঝলসে উঠবে আমার মুখে, পাঠকরা চার পাশ থেকে এসে ঘিরে ধরবে, সই দিতে দিতে পেনের কালি ফুরিয়ে যাবে নির্ঘাত, ইত্যাদি কত রকমের যে ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত হয়ে কেটেছে গত কয়েকটা রাত দিন দুপুর!

সদর্পেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, চার দিকে মানুষের কালো কালো মাথা, কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে যে যার গন্তব্যের দিকে, গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে অভীষ্ট স্টলের লাইনে। হাতে ম্যাপ, পাবলিশারদের ক্যাটালগ বা লিখে আনা বইয়ের উইশলিস্ট। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না, কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলছে না, অন্য কোনও দিকে তাকানোর সময় নেই বা অবকাশ। সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে এগোচ্ছিলাম রুদ্ধশ্বাসে, হঠাৎ মাঝপথে কী যে হল, পা আটকে এল আচমকাই! কে যেন পিছন থেকে আমার জামা ধরেছে, আমি এগোতে চাইলেও এগোতে পারছি না! কে, কে টেনে ধরেছে এ ভাবে, দেখা বা বুঝে ওঠার জন্য জনস্রোতের মধ্যে থেকে নিজেকে বার করে আনতে লেগেছি, নাকি কেউ কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে ভিড়ের বাইরে বার করে আনছে, বুঝতে পারছি না ঠিক!

বেরিয়ে এসে কোনও রকমে এক পাশে দাঁড়িয়েছি, ঘাড়ের পিছনে কানের পাশে কে যেন চাপা গলায় বলে উঠল, “কে তুই, কী জন্য এসেছিস, কী চাস এখানে?”

শুনেই থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছে আশিরনখ! সাহস জুটিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, “আপনি কে ?”

গম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর আমার প্রিয় কবি এমিলি ডিকিনসন থেকে কোট করে বলে উঠল যেন, “আই অ্যাম নোবডি! হু আর ইউ?”

কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে। সত্যিই তো কে আমি, কিসের আশায় আমার এখানে আসা, আসল মতলবটা কী! আরও এক বার ঘাড় ঘুরিয়েও দেখার চেষ্টা চালালাম কে বলল কথাটা, কিন্তু দেখতে পেলাম না কাউকেই। মুহূর্তের ভগ্নাংশের মধ্যে গলাটা চলে গেছে অন্য কানের পিছনে, স্বরে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ, “কী হল, থামলি কেন, যা যা, এগো। অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। যা ভিতরে। তোর আগে এই তোর মতো ভাবতে ভাবতে যারা যারা এসেছিল, তাদের সঙ্গে যা যা হয়েছে, তোর সঙ্গেও তা-ই হবে, এ আর এখানে নতুন কী!”

“মানে, কী বলতে চাইছেন, কী হবে, কী হবে আমার সঙ্গে?” চেঁচিয়ে উঠি প্রায়। গলাটা বলে, “যা না, যা। ভিতরে নিজে গিয়ে নিজের চোখেই দেখবি, যা বোঝার নিজেই বুঝে নিবি।”

হাতে সময় কম, তাই কথা বাড়াই না। কিছু ক্ষণ প্যাসেজটার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, ধীরপায়ে এগোতে থাকি। মিশে যাই ভিড়ের মধ্যে, লক্ষ্যবিহীন ভাবে চলতে থাকি। দু’ধারে সারি সারি বুকস্টল, থরে থরে সাজানো অসংখ্য বই, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দেশীয় প্রাদেশিক আন্তর্জাতিক টাইটল। অগণিত জীবিত মৃত মৃত্যুহীন ক্ষণজন্মা কালোত্তীর্ণ কবি লেখক শিল্পী চিন্তক গবেষক সমালোচক বিদ্বানদের চিত্তবৃত্তির উৎকৃষ্ট সব ফসল। হাজার হাজার ক্রেতা, পাঠক, বই-শিকারির উন্মাদনা, বই হাতে নিয়ে বইপ্রেমীদের মগ্নতা। এত বিক্রেতা প্রকাশক পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি মুহূর্তের মনোযোগ ব্যস্ততা, বিপণন নিয়ে হাজার চিন্তা-দুশ্চিন্তা, শেষ ক’টা মাসের সাধ্য-সাধনার ফলাফল নির্ধারক সব ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড। বইগুলোকে এমন সব নজরকাড়া নিখুঁত শ্রীমণ্ডিত চেহারায় এখানে হাজির করানোর পিছনে অগুনতি ছাপাইকর্মী, প্রুফরিডার, আর্টিস্ট, বাইন্ডার, ম্যানেজার থেকে শুরু করে মুটেদেরও অক্লান্ত পরিশ্রম, যত্ন নিষ্ঠা। বইয়ের সঙ্গে, বইকে নিয়ে, বইকে আঁকড়ে শতসহস্র মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, জীবন-জীবিকা, বাঁচা-মরা। এক কথায় মন-কালি-কলম, কাগজ-ছুঁচ-সুতো-আঠা, যন্ত্র-রক্ত-ঘাম, রং-রূপ-রস, অর্থ-অনর্থ, অভ্রভেদী উল্লাস অতল দীর্ঘশ্বাস, সব মিলিয়ে নিঃসীম যে এক চরাচর জেগে উঠছে মাথার ভিতর, তার মধ্যে আমি কোথায়! বই নিয়ে এই বিপুল সমারোহ, বিশাল এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোথায় আমার অবস্থান, ভাবতে ভাবতে ভাবনা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে যেতে থাকে পায়ে। ক্রমশ আরও ধীর, মন্থর, অবরুদ্ধ হতে থাকে পদক্ষেপ।

অন্ধকারে তোমার পবিত্র অগ্নি

অথচ কিছু ক্ষণ আগে এই আমিই তো এই চত্বরে এসেছিলাম কী ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে। আচমকাই কী এমন হল যে, পদে পদে প্রকট হয়ে উঠছে সংশয় আর সাবধানতা! বইমেলা যেন এক ভুলভুলাইয়া! কোথায় যাব ভেবেছিলাম, আর ঘটনাচক্রে কোন দিকে যাচ্ছি! বড়, মাঝারি, ছোট কিন্তু উদ্দেশ্যে মহৎ বিপণিগুলোর বইয়ের সম্ভারের পাতা উল্টোতে উল্টোতে লিটল ম্যাগাজ়িনের প্যাভিলিয়ন পেরিয়ে কখন যে আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি। দিগ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে মরছি, বার বার ঘুরে ফিরে এসে পড়ছি সেই একই জায়গায়।

কিন্তু কী আশ্চর্য, যত বার বোকা বনছি, ধন্দে পড়ে নাজেহাল হচ্ছি, অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে! যত বার পথ হারাচ্ছি, খুঁজে পাচ্ছি যেন নিজেকেই। যত বার রাস্তা ভুল করছি, তত বারই যেন নতুন করে নিজেকে চিনে নিতে পারছি ঠিকঠাক। আর এই হারানো আর ফিরে পাওয়ার মধ্যে শরীর থেকে মেদ মজ্জা পোড়া চামড়ার মতো খসে খসে পড়ছে যাবতীয় অলীক অহঙ্কার, অসার আত্মমুগ্ধতা, ষড়রিপুর গা-ভরা গহনা। চমৎকার নির্ভার লাগছে, মনে হচ্ছে আমি তো আদতেই এক কঙ্কাল, কী অভূতপূর্ব, বাধাহীন হেঁটে যাচ্ছি!

আবারও হারাতে চাই, তাই আবারও নতুন রাস্তা ধরি। কী অবাক কাণ্ড, এমন যে হবে কস্মিনকালে তো জানা ছিল না! বইমেলা কি তবে মহাকবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র ‘পারগেতোরিয়ো’, যার মধ্য দিয়ে গেলে আমাদের ছোট ছোট সব ইগো, ক্ষুদ্রতা, অসূয়া, অন্ধত্ব, অগভীরতা, ইতরামি— সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়! বইমেলার এই সুবিশাল বিস্তার কি তবে সেই পবিত্র আগুনের দেওয়াল, যার মধ্য দিয়ে গেলে ইহলোকের সমস্ত পাপ, হীন প্রবৃত্তি, অজ্ঞানতা, মূর্খামি, রক্তমাংসের কামনা বাসনা সব ছাই হয়ে যায়, আর মানুষ এক পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে প্রবেশ করে ‘পারাদিসো’-য়, যা আসলে জ্ঞানের অমৃতলোক! তা-ই যদি না হবে, বইমেলার এই সুবিশাল বিস্তারের মধ্যে চক্কর কাটতে কাটতে কেনই বা এমন অব্যর্থ ভাবে প্রশমন ঘটছে সমস্ত আমিত্বের, কেনই বা বহুর মধ্যে নিজেকে একাকার করে দেখতে পারছি, এমন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারছি নিজের ক্ষুদ্রতা, কত অসম্পূর্ণ আমি, আমার প্রস্তুতি এখনও কতটা বাকি! নিজেকে শূন্য করে ফেলেছি, তাই কি এমন পূর্ণ মনে হচ্ছে! মনের কোণে বাজছে মায়ের ভাঙা রেডিয়ো থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্রগান, “ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।”

সে যে যা-ই বলুন, আমার কেমন যেন মনে হয়, বাঙালির মতো আজন্ম অভিমানী, সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত, নাক-উঁচু জাতির জন্য এই কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা যেন গভীর এক স্বর্গীয় চক্রান্ত। আমাদের এই রেনেসাঁস-বিধৌত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের জন্য পেতে রাখা নন্দনলোকের মস্তিষ্কপ্রসূত সুবিস্তীর্ণ এক জাল। বাঙালি কবি লেখক বুদ্ধিজীবী সারস্বত সমাজের মানুষজন স্বভাবগত ভাবেই দাম্ভিক, স্বপ্নবিলাসী, আপন শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে অনড় ও অনমনীয়। জাতির সবচেয়ে বড় আইকন এক জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি ও ভাষাশিল্পী বলে এঁদের প্রত্যেকেরই প্রায় একটা গুপ্ত বিশ্বাস ‘মরিতে মরিতেও মরে না’ যে এক দিন দুপুরে তাঁর নামে সুইডেনের নোবেল কমিটি থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছবেই, আর ঘটে যাবে মিরাকল। মনগড়া নিজস্ব সব প্রাসাদবাসী এই সব মননজীবীরা বইমেলার দিনগুলোয় তাঁদের গজদন্ত মিনার থেকে মাটিতে নেমে আসেন। হাজারের বেশি গ্রন্থবিপণি ঘুরে দেখতে দেখতে তাঁদের মধ্যে বদল আসে, নম্র নত শান্ত শীলিত হয়ে আসতে থাকে আমিত্ব, মেলার প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রত্যেকেরই উপলব্ধি হয় এখানে ‘আমি’ বলে কিছু থাকতে নেই, এখানে সবাই আসলে ‘আমরা’। তাই এই মেলা ইগো নিরাময়ের পৃথিবীর বৃহত্তম দাওয়াইখানা, যেখানে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, এখানে চিকিৎসায় কাজ না হলে নগদ টাকা ফেরত।

উত্তরাধিকারে পাওয়া বাঙালির এই জন্মগত ব্যাধি নিয়ে তাই সে দিন গিয়েছিলাম বইমেলায়। সেই রাক্ষসটা ছিল সামনে। যে ভাবে সদর্পে ঢুকছিল, তা শুধু দৃষ্টিকটুই ছিল না, ছিল এই পবিত্র ক্ষেত্রের নিয়ম ও সহবত-বিরুদ্ধও। তাই ওই অঞ্চলটার মধ্যে ঢুকতেই কি মুহূর্তের মধ্যে ওকে ‘ডিটেক্ট’ করে ফেলেছিল কোনও লক্ষ্মণরেখা! অলক্ষে লাল আলো জ্বলে উঠেছিল নিশ্চয়ই। সেই কারণেই কি পা আটকে এসেছিল ওর, জামার পিছন ধরে টেনে ধরেছিল এই নন্দনবনের অদৃশ্য রক্ষীরা! যদিও বাধা দেয়নি ঢুকতে, কিন্তু কানের পাশে ফিসফিসিয়ে সতর্কবাণী শুনিয়ে দিয়েছিল, যা ফলে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। তার পর থেকে চার পাশের হাল-হকিকত দেখে-বুঝে রাক্ষস বাবাজি আর পালানোর পথ পায়নি, মুখ লুকিয়েছিল সেই চোদ্দো বছরের শিশুটার আড়ালে। শিশুটি ভাগ্যিস বদলায়নি! সেই ক্লাস এইটে পড়তে, প্রথম বার সেই যে ময়দানের পুরনো বইমেলায় এসেছিল জেঠুর হাত ধরে, সেই আদি অকৃত্রিম বিস্ময়ের ঘোর এত দিন পরেও ঠিক টিকে ছিল তার চোখে। তাই এই যাত্রায় বাঁচোয়া।

ক্ষুদ্র তবু তুচ্ছ নয়

সে না-হয় হল, কিন্তু এ দিকে আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। আমি তো পুরোপুরি সেই রাক্ষসটাও নই, আবার সেই শিশুটাও নই। ‘যে জন আছে মাঝখানে’, তার সমস্যা যে অনেক। আমার বই বাজারে এসেছে অথচ আমি সেই বিক্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছি ঔদাসীন্য অবলম্বন করে, এও কি ঠিক! বাজারজাত হওয়ার চাপ আর যন্ত্রণা দুই-ই যে প্রবল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধেয় মিশছে, আমি আর না থাকতে পেরে চোরের মতো চুপিচুপি এসে দাঁড়াই প্রাথমিক গন্তব্য সেই বিপণির অব্যবহিত দূরে। একা একা দাঁড়িয়ে ওখান থেকে দেখতে থাকি ভিড়ের ক্রমবর্ধমান লেজ। অথচ সাহস করে এগোতে পারি না গেটের দিকে বা ভিড়ের কাছাকাছি। কারণ আমি তো ক্রেতা নই, নই বিক্রেতাও। তা হলে আমি কে? লেখক? কিন্তু যে জীবনে একটিমাত্র উপন্যাস লিখেছে আর কয়েকটি হাতেগোনা ছোটগল্প, তাকে কি সে অর্থে লেখক বলা যায়?

আজন্ম মুখচোরা আমার মাথায় ঠাসা নানা মফস্‌সলি সেন্টিমেন্ট আর অচল আদর্শবাদ। কাছে গিয়ে ‘এই যে আমি’ বলে দাঁড়ানোটা নেহাতই অশ্লীল, অযাচিত ভাবে কথা বলতে গেলে লোকে বলবে হ্যাংলা। ফলে এগোতে পারছি না এক পা-ও। কেন্নোর মতো গুটিয়ে রইলেও মাথা বাড়িয়ে দেখছি, জুলজুল করে তাকিয়ে আছি ভিড়টার দিকে। দোকানের প্রবেশপথ দিয়ে যারা ভিতরে ঢুকছে, তাদের কারও মাথায় কি রয়েছে আমার নাম? বেরোনোর পথ দিয়ে প্রচুর বই কিনে যারা হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে, তাদের এক জনেরও পেটফোলা ব্যাগের কোনও কোণে জায়গা করে নিতে পারল কি আমার বইটি?

মনে হয় না পেরেছে। নিশ্চয়ই পারেনি। পারার কোনও কারণ নেই, তাবড় কিংবদন্তি লেখকদের ছেড়ে পাঠক কেনই বা গাঁটের কড়ি খরচা করে আমার মতো অখ্যাত অনামা লিখিয়ের বইটি কিনতে যাবেন। তবু আশা বড় নাছোড় বস্তু, হতেও তো পারে, কত কিছুই তো হয়! হে ঈশ্বর, কেউ কি আমাকে এই দুঃসহ দোলাচল থেকে উদ্ধার করবে না, কেউ কি বলে দেবে না, সত্যিটা আসলে কী। এ দিকে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার হৃদয় অচিরেই হয়ে উঠেছে সেই সমুদ্রমন্থনের সেই মন্দার পর্বত, যাতে নাগরাজ বাসুকীকে পেঁচিয়ে নিয়ে দুরাশা আর আশা দু’দিক থেকে নিষ্ঠুরতম দড়ি-টানাটানিতে মেতে উঠেছে আর গবগবিয়ে উঠে আসছে হলাহল। সে যে কী প্রাণান্তকর হৃদয়বিদারণ, কাউকে কী করে বোঝাব!

আর পারছি না, মনে হচ্ছে পালাতে পারলে বাঁচি। প্রেমিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সৎসাহসহীন ভিতু প্রেমিকের মতো ঝোপের আড়াল থেকে উঠে কেটে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎই দেবদূতের মতো এসে দাঁড়াল ইউনিভার্সিটি হস্টেলের বন্ধু কাজল। এই জায়গাটা দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে এখানে জবুথবু অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে, “কী রে, এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছিস, তোর উপন্যাসটা বই হয়ে বেরিয়েছে না?”

“হ্যাঁ তো, ওখানেই ছিলাম এত ক্ষণ। এ বার ফিরছি, ট্রেন ধরতে হবে তো।” ডাহা মিথ্যেটা বলতে কেঁপে উঠল জিভ। কাজলের হাতে একাধিক বইয়ের ক্যারিব্যাগ। আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না আর, বন্ধু যখন কিছু মনে করবে না হয়তো, শুকনো গলায় ঢোঁক গিলে বলেই ফেললাম একটা কথা। ওর কানে কথাটা বেহায়ার মতো শোনাল হয়তো, কিন্তু কিছু করার নেই, “ভাই একটা উপকার করবি, ইনডিসেন্ট প্রোপো‌জ়াল, বলতে লজ্জা করছে কিন্তু কী করব! লাইনে দাঁড়িয়ে স্টল থেকে আমার বই একটা কিনে আনবি প্লিজ়। বইটা আদৌ বিক্রি হচ্ছে কি না কিছুই বুঝতে পারছি না, অবশ্য না হওয়ারই কথা, তাও বিচ্ছিরি একটা টেনশন হচ্ছে, প্রথম বই প্রথম সন্তানের মতো, বুঝতেই পারছিস।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, এতে এত ইতস্তত করার কী আছে। দাঁড়া আমি যাচ্ছি। এখানেই থাকিস কিন্তু, এখানে টাওয়ারের যা অবস্থা ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কাউকে। লেখককে যখন পেয়েছি তার নিউ রিলিজ়ে সই না নিয়ে ছাড়া যায় নাকি!” কাজলের মুখজোড়া হাসি। ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ’ বলতে গিয়েও উচ্চারণ করতে পারি না কিছুই, বন্ধুকে ধন্যবাদ জানানোর ব্যাপারটা কেমন বোকা-বোকা।

বই হাতে নিয়ে কাজল ফিরে এল মিনিট দশেকের মধ্যে। ওকে দেখে সহসা মনে হল যেন অ্যাপ্রন পরা গায়নোকোলজিস্ট, আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তোয়ালেতে মুড়ে নিয়ে এসেছে আমার হাতে তুলে দেবে বলে। বইটি বইমেলার মধ্যেই বেরিয়েছে তাই তার মুখ এখনও দেখিনি। সদর্থেই যেন আমার প্রথম সন্তানের মুখ। সই করে দেওয়ার জন্য কাজল খুলে ধরেছে পুস্তানির পাতাটা। বুকপকেট থেকে পেনটা বার করে এনে সই দেওয়ার সেই মুহূর্তটা আজও ভুলতে পারি না। আপাদমস্তক সেই রোমাঞ্চ, সেই শিহরনের সঙ্গে তুলনীয় নয় এ পৃথিবীর আর কিছুই। দু’চোখ অশ্রুবাষ্পাচ্ছন্ন ছিল, তাই সেই মুহূর্তে মুখ তুলে তাকাতে পারিনি ওর দিকে।

তার পর থেকে কেটে গেছে এতগুলো বছর। তার পর থেকে নয়-নয় করে এখন প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাতাশ আর সেই সব ক’টিরই প্রসূতিসদন এই বইমেলাই। তার পর থেকে পাঠকদের সই দিতে হয়েছে অনেক, কত অচেনা অজানা পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব। যাঁদের মনে করে এসেছি কল্পলোকের বাসিন্দা, সেই সব কিংবদন্তি লেখকদের পাশে বসারও সৌভাগ্য ঘটেছে। বন্ধু হিসাবে পেয়েছি এই সময়ের প্রতিভাধর লেখক-লেখিকাদের, ভালবাসা ও প্রশ্রয় পেয়েছি খ্যাতনামা প্রকাশক ও প্রকাশনাকর্মীদের। মনে হয়েছে এই বইমেলা প্রাঙ্গণে নতুন নতুন ভাবে জন্ম হয়েছে আমার। বার বার মনে হয়েছে, আমার মতো এক জন অকিঞ্চিৎকর কলমচির জন্যও এত কিছু রাখা ছিল তোমার পেটিকায়! হে পবিত্র বীজতলা, তুমি আমার আভূমিনত কৃতজ্ঞতা জেনো।

ধর্মনির্লিপ্ত একটি জাতির উৎসব

সব কিছুর পরে বলাই যেতে পারে শিক্ষিত বাঙালির একটি চারিত্রধর্ম রয়েছে। সেই সব গর্বের দিন ফুরোলেও আজও বাঙালি জ্ঞানচর্চাকে ডিরোজিয়োর মতোই ‘অমনিপোটেন্ট’ মনে করে। সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং-এর আদর্শ মেনে চলে। বিশ্বাস করে, ‘যার বাড়ির টিভি-সেটটির মাপ তার বাড়ির বুক-শেলফের চেয়েও বড়, তাকে কখনও বিশ্বাস কোরো না’। ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও সে যে ধর্মনির্লিপ্ত এটা বলাই যায়, আর সেই ধর্মনির্লিপ্ত জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব কলকাতা বইমেলা। বাঙালি কখনও বীরের জাত ছিল না, ছিল না তার ব্যবসায়ী হিসাবে সুনামও। কিন্তু উনিশ শতকের সেই জাগ্রত মননশীলতাকেই যে সে জীবনধর্ম হিসেবে মেনেছে, এ কথা মোটের ওপর বলাই যায়। আশ্চর্য এই ভাষার মানুষ, যাঁরা যত ক্ষমতাশালী বা ধনীই হোন না কেন, যত বড় নেতা নেত্রী মন্ত্রী আমলা, যত বড় সাধক গায়ক নায়ক বিজ্ঞানী খেলোয়াড়ই হন, তাঁর লেখা যদি কোনও বই না থাকে বাজারে, তাঁর সমস্ত জীবন এক লহমায় মনে হতেই পারে সম্পূর্ণ অর্থহীন, বাঁধানো বইয়ের মলাটে নিজের নাম ছাপা অক্ষরে লেখা দেখে যেতে না পারলে তিনি যেন মরেও শান্তি পাবেন না। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এক দিন তিনি থাকবেন না কিন্তু বইটি থেকে যাবে। ইহজীবনে সে বইয়ের সাফল্য জুটুক বা না জুটুক, মৃত্যুর বহু বছর পর কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের মাটির ধুলোয় ফেলে বেচা বই হিসেবেও তিনি যদি কোনও দিন উঠে আসতে পারেন পাঠকের হাতে, তা হলেও তাঁর জন্ম সার্থক। অমরাবতীর পথের ধুলোর চেয়েও যেন পবিত্রতর কলেজ স্ট্রিটের এই সব ফুটপাতের পথের ধুলো। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, বইমেলাই হয়ে উঠেছে বঙ্গের জাতীয় উৎসব। সেখানে গিয়ে পেল্লায় সব লাইনে দাঁড়িয়ে বই উল্টেপাল্টে যারা দেখেনি, পাঁজরা ভরে নতুন বইয়ের গন্ধ যারা নেয়নি, মানিব্যাগ এমনকি স্যালারি অ্যাকাউন্ট অবধি ফাঁকা করে গুচ্ছের বই বাড়ি এনে যারা বৌয়ের বকুনি খায়নি, তারা আর যাই হোক, বাঙালি পদবাচ্য হতে পারে না।

অনেকেই বলবেন, বাঙালির বইমেলা যতটা হুজুগ, ততটা সত্যি নয়। এর মধ্যে যতটা লোকদেখানোপনা রয়েছে, ততটা সারবস্তু নেই। বইমেলা যদি প্রকৃত অর্থেই সৎ ও স্বতঃস্ফূর্ত কোনও উদ্যোগ হত, তা হলে নিশ্চয়ই এত বছরে বাঙালির সারস্বতচর্চার গুণমান আরও উন্নত হত। আমাদের ভাষার লেখকদের, উন্নত মেধার অক্ষরকর্মীদের ভাত-কাপড়ের ভাবনা এমন প্রবল হত না, ইংরেজি বা অন্যান্য উন্নত বিশ্বের ভাষার লেখালিখি ও প্রকাশনার মতো পেশাদারিত্বের ছোঁয়া পেত আমাদের ভাষাও। সে সব কিছুই হয়নি, মানে যে বইমেলা নামক এই কর্মকাণ্ড পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে তা কিন্তু নয়। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, দেশভাগ, অনুন্নয়ন, একদা উদ্বাস্তু সমস্যাদীর্ণ বিপুল জনসংখ্যার ভারে আজও জর্জরিত একটা জাতি তার শেষ সামর্থ্যটুকু নিংড়ে দিয়ে যেটুকু পেরেছে, সেটুকুও কম বড় অর্জন বলা যায় না। বইমেলা আজও হাতছানি দেয়, এই সর্বব্যাপ্ত অবক্ষয়ের যুগে আজও স্বপ্ন দেখায়। শুধুমাত্র শহুরে, পরিশীলিত, সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নগরজাতকদেরই নয়— প্রত্যন্ত গ্রাম, গঞ্জ, মফস্‌সল, জেলা টাউনের পায়ে ছেঁড়া চপ্পল পরা থাকলেও হাতে একটি বই নিয়ে ঘোরা ছেলে বা মেয়েটির চোখে মায়াঞ্জন এঁকে দিতে পারে, এ কম শ্লাঘার বিষয় নয় কিন্তু।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kolkata Book fair book fair

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy