Advertisement
০৭ মে ২০২৪

চলতি কা নাম

সবাই জানে। কিন্তু ভরা বর্ষায়, হিমালয়ের পাহাড়ি চড়াই পথে বা মরুপ্রান্তরে যখন দুরন্ত গতিতে পাড়ি দেয় কার র‌্যালির গাড়ি? তৈরি হয় দুর্দান্ত এক ম্যাজিক। অনঘ গঙ্গোপাধ্যায়সবাই জানে। কিন্তু ভরা বর্ষায়, হিমালয়ের পাহাড়ি চড়াই পথে বা মরুপ্রান্তরে যখন দুরন্ত গতিতে পাড়ি দেয় কার র‌্যালির গাড়ি? তৈরি হয় দুর্দান্ত এক ম্যাজিক। অনঘ গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সালটা ১৯৭৫। অগস্ট মাস। কয়েক দিন ধরে ঘুম মাথায় উঠেছে ভরত পারেখের। অনেক দিন ধরে এমন সুযোগই তো খুঁজছিলেন তিনি। কর্নাটকে কে-১০০০ কার র‌্যালিতে যোগ দিতে তখন দস্তুরমত প্রস্তুত তিনি।

কিন্তু বেরনোর ঠিক আগের দিনই বাধা। বাড়ি ফিরতেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন দিদি, ‘‘তোর যাওয়া হবে না।’’ কী ব্যাপার? পরিবারের এক জনের জ্যোতিষশাস্ত্রে জ্ঞানের উপরে অগাধ ভরসা ছিল পারেখদের। তিনিই জানিয়েছেন, ১৪ অগস্ট আর ১৫ অগস্টের মাঝের রাতটা খুব খারাপ।

শেষ পর্যন্ত দিদিকে অনেক বুঝিয়ে বেরোতে পেরেছিলেন ভরত। কিন্তু কথা দিতে হয়েছিল, সে রাতে স্টিয়ারিং ধরবেন না তিনি। সে যাত্রায় ভরতের সঙ্গী কলকাতার অন্য দুই উৎসাহী ননী চন্দ এবং দুলু।

১৪ অগস্ট মাঝরাত। কর্নাটকের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে চলছে টয়োটা সিলিকা গাড়ি। কথা মতোই স্টিয়ারিং ধরেননি ভরত। চালকের আসনে ছিলেন দুলু। হঠাৎই পিছলে গেল চাকা। পাহাড়ি রাস্তায় কার্যত নিয়ন্ত্রণশূন্য হয়ে কিছু ক্ষণ এদিক-ওদিক নড়াচড়া করল সিলিকা। ভরতরা তত ক্ষণে ধরেই নিয়েছেন, এ যাত্রা আর রক্ষা নেই। একেবারে পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়বে গাড়ি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর দিকে মুখ করেই গাড়ি রাস্তায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল!

সকালে মেঙ্গালুরু পৌঁছে প্রাতরাশ খাওয়ার জন্য থামলেন ভরতরা। তখনই সংবাদপত্র দেখে চমকে উঠলেন। ১৫ অগস্ট ভোরে ঢাকায় খুন হয়েছেন মুজিবর রহমান। ভরত এখনও ভাবেন, তা হলে কি রাতটা সত্যিই অশুভ ছিল?

বছর তিনেক পরের কথা। এ বার নাওয়া-খাওয়া ভোলার পালা আর এক উৎসাহী সুজিত রায়ের। কয়েক দিন ধরেই নাড়াচা়ড়়া করেছেন গাড়ির এটা-সেটা নিয়ে। ১৯৬০ সালের মডেলের অ্যাম্বাসাডর গাড়িটা বড় প্রিয় তাঁর। আর স্বপ্নের দৌড়ে সেটাই হতে চলেছে তাঁর বাহন।

১৯৭৮ সালের কলকাতা-শিলচর কার র‌্যালি নিয়ে তখন রীতিমত হইচই কলকাতায়। আর একেবারে কাঁচা, অনভিজ্ঞ সুজিতের কাছে তখন এক একটা র‌্যালিই এক একটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নেই ভর করে বেরিয়ে পড়লেন নির্দিষ্ট দিন ঠিক সময়ে। সঙ্গে বন্ধু রঞ্জন বসু। যেতে যেতে চোখে পড়ছে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গাড়ির দৌড় দেখছেন কাতারে কাতারে মানুষ। তাতে উৎসাহ আরও বাড়ছিল সুজিত-রঞ্জনের।

হঠাৎ গোলমাল। সুজিত আবিষ্কার করলেন, গাড়ির ডায়নামো পুড়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস সঙ্গে অন্য ডায়নামো ছিল! গাড়ি দাঁড় করিয়ে ডায়নামো বদলাতে হল।

সন্ধেবেলা শান্তিপুরের কাছে ফের বিভ্রাট। ফের পুড়ে গিয়েছে ডায়নামো। সঙ্গে তো আর ডায়নামো নেই। এ বার কী হবে! মাথায় হাত দুই তরুণের। শান্তিপুরের কাছেও রাস্তায় তখন ভিড় করে র‌্যালি দেখছেন অনেকে। অসহায় সুজিত-রঞ্জন দেখলেন, একের পর এক প্রতিযোগী টপকে যাচ্ছেন তাঁদের।

একটু খোঁজাখুঁজির পরে এক মিস্ত্রিকে ধরে আনলেন সুজিত। গাড়িতে হাত দিয়েই লাফিয়ে উঠল সে, ‘‘ওরে বাবা, গাড়ি একেবারে গরম হয়ে রয়েছে। এতে এখন হাত দিতে পারব না।’’ সুজিত-রঞ্জন কিছু বলার আগেই আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক’জন স্থানীয় বাসিন্দা চাঁটি মারলেন মিস্ত্রির মাথায়, ‘‘র‌্যালির গাড়ি আটকে রাখবি! চালাকি নাকি? কাজ শুরু কর এখনই।’’

তাড়াতাড়ি ডায়নামো বদলে দিল মিস্ত্রি। ফের যাত্রা শুরু করলেন সুজিত-রঞ্জন।

সে বার জেতা হয়নি তাঁদের। কিন্তু পথে মানুষের সেই ভালবাসার কথা ভাবলে এখনও চোখ ভিজে আসে সুজিতের।

বছর চারেক পরের কথা। তত দিনে র‌্যালিতে হাত পাকিয়েছেন সুজিত। জুটি বেঁধেছেন ভরতের সঙ্গে। ফিয়াট গাড়ি নিয়ে এ বারের দৌড় কলকাতা-জামশেদপুর র‌্যালিতে। গাড়িতে সুজিত-ভরতের তৃতীয় সঙ্গী রাজীব জিন্দল, বর্তমানে কলকাতায় মারুতি গাড়ির অন্যতম ডিলারশিপের পরিচালক।

এ বার বিপত্তি এল ধলভূমগড়ের কাছাকাছি। গাড়ির ক্ষেত্রে নিতান্তই মামুলি ব্যাপার, টায়ার ফাটা। কিন্তু র‌্যালির ক্ষেত্রে সময় যে অমূল্য! টায়ার ফাটার আগে সবচেয়ে আগে ছিলেন ভরত-সুজিতরাই। কিন্তু টায়ার বদলাতে বদলাতে দেখলেন, তাঁদের ছাড়িয়ে গেল পর পর ছ’টি গাড়ি। টায়ার বদলে ফের যাত্রা শুরু। ফিয়াট গাড়ির ইঞ্জিনের শক্তি বিশেষ পদ্ধতিতে বাড়িয়েছিলেন ভরত। গতি বাড়িয়ে একে একে প্রতিযোগীদের টপকে যেতে লাগলেন তিনি।

সামনে বাকি আর এক প্রতিযোগী, কলকাতারই নিয়াজ আলি। এ বার ‘ন্যাভিগেটর’-এর ভূমিকায় ছিলেন সুজিত। পথনির্দেশের দায়িত্ব তাঁর। বন্ধুকে সতর্ক করলেন, ‘‘সামনে কালভার্ট।’’

কালভার্টের উপরে উঠে নিয়াজকেও টপকে বেরিয়ে গেলেন ভরত। আর একটু এগিয়েই রাস্তায় পড়ল মস্ত বড় গর্ত। ফের বন্ধুকে সতর্ক করলেন সুজিত। সাবধানে গর্ত এড়িয়ে যেতে পারলেন ভরত। কিন্তু সামলাতে পারলেন না নিয়াজ আলি। একেবারে পাশের ধানখেতে গিয়ে পড়ল তাঁর ফিয়াট গাড়ি।

চারচাক্কা: চালক রণেন দত্তগুপ্ত, পাশে ভরত পারেখ। ’৭৬-এ ভারত-নেপাল কার র‌্যালি

সে-যাত্রায় জিতেছিলেন সুজিত-ভরতরা।

আরও বছর তিনেক পরের কথা। ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির জমানায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জাপান থেকে ‘নিসান-২৪০ আরএস’ গাড়ি আমদানি করতে পেরেছেন ভরত। সুজিতের সঙ্গে জুটি বেঁধে চলছে দৌড়।

১৯৮৫ সালের ‘হিমালয়ান র‌্যালি’-তে যোগ দিয়েছেন ভরত-সুজিত। তত দিনে ভারতের গাড়ির দৌড়ের জগতে পরিচিত মুখ তাঁরা। দেহরাদূন ছেড়ে এগোচ্ছেন। স্টিয়ারিংয়ে ভরত। পাশে ‘ন্যাভিগেটর’ সুজিত।

সোজা রাস্তার পরে কিছুটা চড়াই, তার পরে বাঁক। বাঁকের মুখে ভরত হঠাৎ দেখলেন, রাস্তা পেরোচ্ছেন কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা। ব্রেক কষলেন। কিন্তু তাল সামলানো গেল না। সোজা ধাক্কা লাগল রাস্তার পাশের একটা গাছে। গুরুতর জখম হলেন বাঁ দিকের আসনে থাকা সুজিত। ঘটনার অভিঘাত কাটাতে পারছিলেন না কিছুতেই। ধাক্কার ঠিক আগে যে কথাটা বলছিলেন, সেটাই বলে যাচ্ছিলেন বারবার।

একটু পরেই এসে পড়ল উদ্ধারকারী দল। স্ট্রেচারে শুয়ে ক্রমশ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল সুজিতের। মনের পরদায় ভেসে আসতে লাগল বাড়ির লোকজনের মুখ। ভাবলেন, কাউকে তো খবর দেওয়া হল না! তার পরে আর কিছু মনে নেই।

সে যাত্রা কার্যত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছিলেন সুজিত। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর থেকেই ফের পথ ডাকতে শুরু করে তাঁকে। দুর্ঘটনা তো চলারই অঙ্গ। তাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়।

সালটা ২০০৪। মাঝে অনেক পথ পেরিয়েছেন ভরত-সুজিতরা। সুজিত তত দিনে ‘বেঙ্গল মোটর স্পোর্টস ক্লাব’-এর অন্যতম সক্রিয় সদস্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ভারত-আসিয়ান কার র‌্যালি’-র পথ উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে মায়ানমারের মধ্য দিয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। যোগ দিতে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতান সহ দেশ-বিদেশের অনেকে।

কনভয়ে রয়েছে একাধিক অ্যাম্বুল্যান্স। অত ভারী গাড়ি চালানোর অনুমতি নেই সকলের। অগত্যা একটি অ্যাম্বুল্যান্সের স্টিয়ারিংয়ে বসলেন সুজিতই। সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ওই অ্যাম্বুল্যান্সই চালিয়েছিলেন তিনি।

চলতে চলতে মায়ানমারের জঙ্গিদের দখলে থাকা এলাকার প্রান্তে এসে দাঁড়াল কনভয়। ওই এলাকায় কনভয়কে পাহারা দেবে জঙ্গিরাই। র‌্যালির জন্য তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে মায়ানমার সরকারের। চলতে চলতে গাড়ির জানালা দিয়ে সুজিত দেখলেন, রাস্তার পাশে পাশে‌ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে জঙ্গি ‘সেনা’র দল। সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেগুলির শতচ্ছিন্ন পোশাক, পায়ে ছেঁড়া জুতো। কিন্তু প্রত্যেকের কাঁধে রকেট লঞ্চার। পাথরের মতো মুখে কেবল নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তারা। নিতান্তই কিশোর ওই ‘সেনা’দের হাতে এমন মারাত্মক অস্ত্র কেন? প্রশ্নটা এখনও ঘুরেফিরে মাথায় আসে সুজিতের।

কলকাতার অভিজাত ক্লাবের লনে বসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমন বহু টুকরো টুকরো ছবি, অনেক মানুষের কথা ভিড় করে আসে এখন প্রবীণ ভরত আর সুজিতের মনে। আক্ষেপ করেন, কলকাতা এক সময়ে মোটর স্পোর্টসে এগিয়ে থাকলেও এখন তাঁদের প্রিয় শহরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে দিল্লি, মুম্বই। স্বীকার করেন ‘অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র অন্যতম কর্তা প্রয়াত কল্যাণ ভদ্র, কলকাতার অভিজাত ব্যবসায়ী সুরেশ কুমারদের অবদানের কথা। ওঁরা ছাড়া যে পূর্ব ভারতের মোটর স্পোর্ট অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত, তা এক বাক্যে মানতে আপত্তি নেই সুজিত-ভরতদের।

কলকাতার মোটর স্পোর্ট ফের চাঙ্গা হয়ে উঠুক, এটাই একান্ত কামনা ওঁদের মতো অনেকেরই। নতুন ক্লাব তৈরি করেছেন ভরত ও তাঁর সহযোগীরা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে এগিয়ে চলাতেই ওঁদের আনন্দ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Car Race Desert Hills ভরত পারেখ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE