Advertisement
০৭ মে ২০২৪

পাত পেড়ে ভোট

১৯৮৭। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের সময় আমি উল্টোডাঙা থানায় সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পোস্টেড। আমাকে বেলগাছিয়া এলাকার একটি স্কুলের ভোটকেন্দ্রে ইন-চার্জ করে পাঠানো হল। ওই কেন্দ্রে তিনটি বুথ। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম, ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব পাওয়া সেই প্রথম। রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায়, বিরোধী বলতে শুধুই কংগ্রেস। আমার সঙ্গে রয়েছে সাত জন কনস্টেবল ও দুজন হোমগার্ড।

প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

১৯৮৭। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের সময় আমি উল্টোডাঙা থানায় সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পোস্টেড। আমাকে বেলগাছিয়া এলাকার একটি স্কুলের ভোটকেন্দ্রে ইন-চার্জ করে পাঠানো হল। ওই কেন্দ্রে তিনটি বুথ।

একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম, ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব পাওয়া সেই প্রথম। রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায়, বিরোধী বলতে শুধুই কংগ্রেস। আমার সঙ্গে রয়েছে সাত জন কনস্টেবল ও দুজন হোমগার্ড।

সন্ধে ছ’টার মধ্যে এসে গেল পোলিং পার্টি। বারো জন। স্কুলবাড়িটিতে জল, বাথরুম সব ব্যবস্থাই ছিল। শুধু আলো কম। একটা বুথে তো বাল্‌বই নেই।

কাছাকাছি কোনও দোকান নেই, দূরে একটা চায়ের দোকান রয়েছে, সন্ধের পর সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

সাড়ে ছ’টা নাগাদ কয়েক জন যুবক হইহই করে স্কুলে ঢুকে পড়ল। ওদের মধ্যে নেতা গোছের এক জন বলল, ‘আপনারা সবাই এসে গেছেন? ক’জন আছেন?’

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।

—আরে বাবা, পুলিশ আর পোলিং পার্টি মিলিয়ে সংখ্যাটা কত?

এক জন প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, ‘২০ জন। কিন্তু কী ব্যাপার? আপনারা কারা?’

যুবকটি যেন শুধু সংখ্যাটিই শুনতে পেল।

—ঠিক আছে, এখন চা-বিস্কুট আসছে। ন’টা নাগাদ ডিনার। মুরগির মাংস আর ভাত। ঝোল-টোলের ব্যাপার বলে রাতেই রাখছি, কাল পাবেন প্যাকেট-লাঞ্চ— ড্রাই। দাদার অর্ডার, আপনাদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে এক হাতে কেটলি, অন্য হাতে প্লাস্টিক কাপ নিয়ে ঢুকে পড়ল। আর এক জনের হাতে বিস্কুটের প্যাকেট।

—নিন, চা-বিস্কুট খেয়ে নিন।

এই সময়ে জনা পাঁচ-ছয় ছেলে এল। ওদের দিকে তাকিয়ে যুবকটি এক জনকে কাছে টেনে নিল। কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘এরা হচ্ছে বিরোধী পক্ষ। আমাদের ভাইরা সব।’ তার পর গলা তুলে বলল, ‘অ্যাই, এদের চা-বিস্কুট দে। রাতের খাবারও খেয়ে যাবি।’

লজ্জিত মুখে বিরোধী পক্ষের এক যুবক বলল, ঠিক আছে বিভুদা।

সবাই যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, তখন ও বলে উঠল— ‘আমরা রুলিং পার্টি। আপনারা আমাদের এলাকায় ভোট করাতে এসেছেন। মানে অতিথি। আপনাদের খাওয়াদাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে দাদা বলে দিয়েছেন। আর কোনও অসুবিধে আছে?’

এক জন প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, ‘আমার বুথে একটা পয়েন্ট আছে, কিন্তু বাল্‌ব নেই।’

সঙ্গে সঙ্গে বিভু বলে উঠল— পল্টু...

মাথা নেড়ে পল্টু ছুটল।

তার পর আমাদের দিকে তাকিয়ে বিভু বলল, ‘এই যে, এরা বিরোধী পক্ষ এসেছে, কিন্তু সম্পর্কটি একদম ভাই-ভাই। এখানে খুব শান্তিতে ভোট হয়, দেখবেন।’

ও পক্ষের এক জন বলে উঠল, ‘দাদার ব্যবস্থাই আলাদা।’

রাতে স্কুলের হাইবেঞ্চে বিছিয়ে দেওয়া শালপাতার থালায় গরম ভাত আর চিকেন কারি সবাই চেটেপুটে খেল।

ঘুম ঠিক হল না। ভোর ছ’টার সময় কেটলি-হাতে সেই ছেলেটি তার সঙ্গী নিয়ে ঢুকে পড়ে বলল, ‘নিন, চা খেয়ে নিন। সঙ্গে বিস্কুটও নেবেন।’

ভোট শুরু হল সাতটায়। আটটা নাগাদ সবার হাতে পৌঁছে গেল ব্রাউন কাগজের ঠোঙা। তাতে চারটে করে কচুরি, আলুর দম আর একটা লাড্ডু।

খুব শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট হচ্ছিল, বিরোধী পক্ষের এজেন্টরা যে আছে, বোঝাই যাচ্ছিল না। এক জন ভোটারকেও চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।

বেলা একটা নাগাদ একটা ম্যাটাডর এসে থামল ভোটকেন্দ্রের সামনে। মাথায় ক্যাপ পরা দুজন রয়েছে পিছনে, তারা তেরপলের ঢাকাটা তুলল, তার পর হাতের কাগজটা দেখে বলল, চল্লিশটা প্যাকেট নামিয়ে নে।

সেই প্যাকেট পৌঁছে গেল ভোটকর্মী, পুলিশ আর এজেন্টদের হাতে। চিকেন বিরিয়ানি আর একটা তালশাঁস সন্দেশ। ওই ছেলেরাই লাইনে দাঁড়ানো চার-পাঁচ জন ভোটারদের বলল, ‘আপনারা কাইন্ডলি একটু অপেক্ষা করুন, স্যরদের খেতে দিন।’

তাঁরাও সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে, আমরা ওয়েট করছি, আপনারা খেয়ে নিন।’

লাঞ্চের পরেই গাড়ির কনভয় এসে থামল। এজেন্টরা লাফিয়ে উঠল, ‘দাদা এসেছে!’

সাদা হ্যাট পরা দাদা সকলের সামনে এসে নমস্কার জানালেন।

—আপনাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘একদম না, আমরা তো জামাই- আদরে আছি।’

দাদা হেসে, হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

কী শান্তিতে সব কিছু সমাধা হল! এমনকী প্যাকিংয়ের সময়ও প্রত্যেকের হাতে চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে দেওয়া হল।

ফেরার বাসে উঠতে উঠতে দেখলাম, শাসক ও বিরোধী পক্ষের এজেন্টরা একসঙ্গে আমাদের দিকে হাত নাড়ছে!

prosantabanerjee43@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE