Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ভিখারি

বারাসতের ‘সোনার বাংলা জুটমিল’-এর লেবার থেকে ভিখারি হয়ে যেতে প্রায় এক বছর লাগল আঠাশ বছরের অনিল খামরুইয়ের। ‘প্রায়’ বলাই ভাল, কেন না পনেরো দিন বাদে লক আউট ঘোষণার এক বছর পূর্তি হবে।

ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বারাসতের ‘সোনার বাংলা জুটমিল’-এর লেবার থেকে ভিখারি হয়ে যেতে প্রায় এক বছর লাগল আঠাশ বছরের অনিল খামরুইয়ের। ‘প্রায়’ বলাই ভাল, কেন না পনেরো দিন বাদে লক আউট ঘোষণার এক বছর পূর্তি হবে।

লক আউট হওয়ার ফলে কি সব কর্মচারী ভিখারি হয়ে গেছে? মোটেই না। ম্যানেজার আর সুপারভাইজাররা অন্য কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। কম মাইনে হোক আর যাই হোক, চাকরি তো! লেবাররা দেশে গিয়ে চাষবাস করছে, ট্রেনে হকারি করছে অথবা বর্ডার এরিয়ায় স্মাগলিং-এর র‌‌‌‌্যাকেটে নাম লিখিয়েছে। যারা কোনও কম্মের নয়, তারা বউয়ের শাড়ি বা মেয়ের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছে।

মুশকিলে পড়ল ইউনিয়নের নেতা অনিল। সে না পেল চাকরি, না পারল হকারি, স্মাগলিং বা সুইসাইড করতে। চাষবাসের প্রশ্নই নেই, কেন না অনিল গ্র্যাজুয়েট।

লক আউট ঘোষণার সময় অনিলের বিয়ের বয়স মাত্র সাত মাস। আনকোরা বউয়ের সামনে হকারি করা যায়? মানসম্মান বলে একটা ব্যাপার আছে তো!

প্রথম তিন মাস ব্যাংকের টাকায় চলল। অনিলের কিছু সঞ্চয় ছিল। পণ বাবদ বন্দনার বাড়ি থেকেও টাকা এসেছে। সব মিলিয়ে খারাপ না। বন্দনাও শক্ত ধাতের মেয়ে। খারাপ খবর শোনামাত্র বাড়ির ইলেকট্রিকের লাইন কাটিয়ে দিল। একটা মোবাইল ছিল। সেটা বেচে দিল। দু’বেলার বদলে এক বেলা রান্না করতে লাগল। আর দিনরাত অনিলকে খোঁচাতে লাগল, ‘একটা কাজের চেষ্টা দেখো। এ ভাবে বাড়িতে বসে থেকো না। শম্ভুদা হাওড়ার মহাদেব জুটমিলে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে।’ অথবা, ‘সিংজিকে দেখে শেখো। ড্রাইভারি শুরু করে দিয়েছে।’ অথবা, ‘পঞ্চু হেলা স্টেশন রোডে ফুচকা বিক্রি করছে। তুমি কিছু ভাবছ?’

অনিল তখন মিটিং-মিছিলে ব্যস্ত। জুট মিলের সামনে ধর্নায় বসা, মিলের মালিক, সাহা গ্রুপের প্রধান নীরেন সাহার বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা, স্থানীয় কাউন্সিলর, এমএলএ এবং এমপির সঙ্গে কথা বলে নীরেন সাহাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা— কাজ কম? সে সব ছেড়ে ফুচকা বিক্রি? ফুঃ!

তিন মাসের মাথায় বন্দনা জানিয়ে দিল, সে আয়ার কাজ ধরেছে। কলকাতার আয়া সেন্টারে নাম নথিভুক্ত করার পরে ওরা এক দিনের ট্রেনিং দিয়েছে। যাদের বাড়িতে আয়ার দরকার, তারা সেন্টারে ফোন করে। সেন্টারের মালকিন জায়গা মিলিয়ে দেখে নেয় রোগীর বাড়ির কাছে কোন মেয়ে আছে। তাকেই পাঠায়। দুটো শিফ্‌ট। সকাল সাতটা থেকে সন্ধে সাতটা। আর সন্ধে সাতটা থেকে সকাল সাতটা। বারো ঘণ্টা বুড়োবুড়িদের গু-মুত ঘাঁটলে রুগির বাড়ির লোক দু’শো টাকা দেয়। পঞ্চাশ টাকা সেন্টারের মালকিন কেটে রেখে বাকিটা বন্দনাকে দেয়।

সপ্তাহে দু’দিন কাজ পায় বন্দনা। দিনের শিফ্‌ট ছাড়া কাজ নেয় না। মাস গেলে আয় হয় বারোশো টাকা। এতে সংসার চলে?

যে দিন বাজার করতে যাবে বলে বন্দনার গয়নায় হাত দিল অনিল, সেই দিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফাটাফাটি লাগল। অনিল বলল, ‘কারখানা ঠিকই খুলবে। আর কয়েক মাস কষ্ট করতে হবে।’ বন্দনা বলল, ‘কষ্ট করতে আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি আমার গয়নায় হাত দেবে না। মুরোদ থাকলে রোজগার করে দেখাও।’

এই ঘটনার পরে অনিল মুখের রক্ত তুলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল। আরও মিছিল, আরও মিটিং, আরও স্ট্রিট-কর্নারিং, কাউন্সিলর থেকে এমপি পর্যন্ত আরও দরবার। ছ’মাসের মাথায় বুঝতে পারল, সাহা গ্রুপের সঙ্গে তার দলের ওপরের লেভেলে আগেই মিউচুয়াল হয়ে গিয়েছে। সোনার বাংলা জুটমিল কোনও দিনও খুলবে না। ওখানে হাউজিং কমপ্লেক্স, শপিং মল আর মাল্টিপ্লেক্স হবে। বজরংবলী হাউজিং-এর মালিক অরুণ সুরেকার প্রোজেক্ট।

দল এতদিন তার সঙ্গে গট-আপ গেম খেলছিল? এই দলের জন্যে কাজকম্ম ছেড়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছে অনিল! দুর শালা! পেচ্ছাপ করি দলের মুখে! রাগে আর দুঃখে বাংলুর ঠেকে চলে গেল অনিল।

সেখানেই শম্ভুদার সঙ্গে দেখা। এক গাল দাড়ি রেখেছে, চেহারাটাও নধর হয়েছে। বাংলুর গেলাসে চুমুক দিয়ে মাটিতে হাত থাবড়ে বলল, ‘বোস। তোর অ্যাঁড়দোলন শেষ হয়েছে?’

‘তাতে তোমার কী দরকার?’ রাগে গরগর করতে করতে কাঁচা লংকা চিবোয় অনিল।

‘শেষ হলে বলিস। তোর জন্যে একটা কাজ আছে।’

‘কী কাজ?’ নিমেষে অনিলের রাগ উধাও।

‘ভিক্ষে করবি?’

নেহাত শম্ভুদা বয়সে বড় তাই অনিল গায়ে হাত তুলল না। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘মাতলামো না করে বাড়ি যাও।’

সন্তানস্নেহে অনিলের মাথায় হাত বুলিয়ে শম্ভুদা বলল, ‘আমি কোনও জুটমিলে কাজ করি না। ভিক্ষে করে পেট চালাই।’

‘তবে যে লোকে জানে তুমি মহাদেব জুটমিলে চাকরি করো!’

অনিলের গেলাসে বাংলু ঢেলে শম্ভুদা বলল, ‘ইন্ডিয়াতে চার লাখের একটু বেশি ভিখারি আছে। তার মধ্যে আশি হাজার বেঙ্গল থেকে। এই একটা ব্যাপারে আমরা ইন্ডিয়ায় এক নম্বর।’

‘যাঃ!’ আপত্তি করে অনিল।

‘যা বলছি শোন! অনেক ডিগ্রি-ডিপ্লোমাওয়ালা লোক রোববারে ভিক্ষে করে আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা কামিয়ে নেয়। ইউনিয়নকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাকি টাকা পকেটে। কাল বাড়িতে আয়। সব বলব।’

পর দিন সকালে শম্ভুদার বাড়ি গিয়ে অনিল দেখে, সে ধোপদুরস্ত জামাপ্যান্ট পরে কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোচ্ছে। অনিলকে বলল, ‘চল, তোকে কাজকম্ম বুঝিয়ে দিই।’

কাজকম্ম বুঝতে মাসখানেক লাগল। গত দু’মাস ধরে হাওড়া ময়দান এলাকায় ভিক্ষে করছে অনিল। পরনে ছেঁড়া জামাপ্যান্ট, গাল ভর্তি দাড়ি, চোখের নীচে কালি, হাতে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের টিকিট। তাতে লেখা রয়েছে, ছাব্বিশ বছরের বন্দনা খামরুই ব্রেন ক্যানসারে আক্রান্ত।

‘বউকে বাঁচাতে গেলে অপারেশান করতে হবে স্যর। বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি। আপনি কিছু সাহায্য করুন। ভগবান আপনার ভাল করবেন।’ চোখের জল ফেলে সামনের ছোকরাকে বলল অনিল।

বছর ত্রিশের ছোকরা অনিলের হাতে একশো টাকার নোট ধরিয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’

* * *

শম্ভুদা বলেছে, ‘বিপদ দেখলে কেটে পড়বি। পুলিশ হোক বা মাতাল, ঝগড়ুটে বুড়ি হোক বা আওয়াজ দেওয়া কলেজ-ছাত্তর— কারও সঙ্গে ঝামেলায় জড়াবি না।’ গুরুর নির্দেশ মেনে অনিল প্রথমে ভাবল, পালাবে। এ ছোকরা নির্ঘাত বারাসতে থাকে। জুটমিলের কোনও কর্মচারীর ছেলে। আজই পাড়ায় ছিছিক্কার পড়ে যাবে যে অনিল বউয়ের নামে মিথ্যে কথা বলে ভিক্ষে করে।

যেমন চিন্তা তেমন কাজ। ছোকরাকে একশো টাকার নোট ফেরত দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা দিল অনিল। সামনে যে বাস পাবে, তাতে চড়েই কাটবে।

ছোকরা অনিলের হাত ধরে অনুরোধ করল, ‘প্লিজ দাঁড়ান। আমি টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখি। স্ট্রিট বেগার, মানে ভিখারিদের নিয়ে একটা মেগাসিরিয়ালের কাজ চলছে। সেই নিয়ে কথা বলব। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড।’

সন্দীপ সেনগুপ্ত নামের ছোকরা আলাপের শুরুতেই একশো টাকার নোট ধরিয়েছে। কথা বললে আরও কিছু দিতে পারে। অনিল রিস্ক নিয়ে দেখবে না কি?

‘আমাকে স্যান্ডি বলে ডাকতে পারেন।’ অনিলের হাতে চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে বলল সন্দীপ। জামার পকেটে একশো টাকার নোটটা গুঁজে দিল। পরবর্তী কথাবার্তা এগোল তরতর করে। অনিল জানতে পারল, কলকাতা শহরে মেগাসিরিয়াল তৈরি করার জন্যে অনেক প্রোডাকশন হাউস আছে। স্যান্ডি সেই রকম একটা হাউসে চাকরি করে।

স্যান্ডি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার কোনও মোবাইল আছে?’

‘আগে ছিল। কারখানায় লক আউট হওয়ার পরে বেচে দিয়েছি। আমার বউকে আয়া সেন্টার থেকে একটা সস্তার মোবাইল দিয়েছে। সেটাতে আমার হাত দেওয়া বারণ।’

স্যান্ডি বলল, ‘ঠিক আছে। আমি সপ্তাহে দু’দিন আপনার সঙ্গে গল্প করতে দুপুরবেলা এখানে আসব। আপত্তি নেই তো?’

‘ভিজিট লাগবে কিন্তু।’ দাবি পেশ করল অনিল, ‘রোজ একশো টাকা।’

সেই থেকে চলছে। শম্ভুদার শেখানো ট্রেডের নিয়মকানুন স্যান্ডিকে বলেছে অনিল। ‘বাড়িতে আর পাড়ায় বললাম যে হাওড়ার মহাদেব জুটমিলে কাজ পেয়েছি। বারাসত থেকে হাওড়া অনেকটা দূর। কেউ খবর নিতে যাবে না। পাশাপাশি দাড়ি রাখতে শুরু করলাম। কষ্টে আছি এটা বোঝাতে হবে তো! এই লাইনে আমার যে গুরু, সে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের একটা টিকিট জোগাড় করে দিয়েছে। তাতে লেখা আছে, আমার বউয়ের ব্রেনে ক্যানসার হয়েছে।’

‘বউয়ের ক্যানসার চলবে না।’ আপত্তি করে স্যান্ডি, ‘আমার মেগার গল্পের জন্যে মায়ের ক্যানসার চাই।’

‘বুড়োবুড়িদের রোগবালাই মানুষের সিমপ্যাথি পায় না বস। গল্পে ওটা বাচ্চার ক্যানসার করে দিন। সব লাইনেই বাচ্চার ক্যানসারের হেবি ডিমান্ড।’

‘রাইট!’ আইডিয়া পছন্দ হয়েছে স্যান্ডির। ‘বাই দ্য ওয়ে, আপনি অপারেট করেন কী ভাবে?’

‘গিন্নি বেরোয় ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়। আমি সাতটায়। ফাইল আর ইউনিফর্ম গুরুর বাড়িতে থাকে। আমি ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে গুরুর বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসে করে হাওড়া স্টেশনে আসি। টয়লেটে ঢুকে ইউনিফর্ম পরে বেরোই। মেক-আপও করতে হয়।’ কাজল ধেবড়ে কী ভাবে চোখের নিচে হালকা কালি আনতে হয়, স্যান্ডিকে শিখিয়ে দিল অনিল। ‘বাড়ি ফেরার সময়েও একই রুটিন। গুরুর বাড়িতে ব্যাগ রেখে বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। গিন্নি তত ক্ষণে রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। অনেক দিন বাদে আমাদের বাড়িতে আবার দু’বেলা রান্না হচ্ছে। গত রোববার চিকেনও হল। ভাবছি এ বার একটা বাচ্চা নেব।’

আলাপ হওয়ার দেড় মাসের মাথায় স্যান্ডি বলল, ‘আপনাকে একদিন লেক গার্ডেন্স যেতে হবে।’

‘কেন?’ বিনি পয়সায় পাওয়া সিগারেটে টান দিয়ে প্রশ্ন করল অনিল।

‘মেগা সিরিয়ালে নায়িকার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করছেন বিনোদ চট্টরাজ। বিনোদদা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান। বডি ল্যাংগোয়েজ, কথা বলার ধরন, পোশাক— এগুলো দেখবেন।’

‘উনি কখনও ভিখারি দেখেননি?’

‘বিখ্যাত মানুষরা রাস্তায় বেরোতে পারে না। এরা অন্য জগতের বাসিন্দা। লোকটা যেমন বড় অভিনেতা, তেমন খানদানি মেয়েবাজ। বরের কিত্তি দেখে বউ অনেক দিন পালিয়েছে।’ চিরকুটে বিনোদ চট্টরাজের ঠিকানা লিখে অনিলের হাতে ধরিয়ে স্যান্ডি বলল, ‘সামনের মঙ্গলবার বিকেল চারটের সময় দেখা হচ্ছে।’

চিরকুট পকেটে ঢুকিয়ে অনিল বলল, ‘টিএ আর ডিএ বাবদ হাজার টাকা চাই। পুরনো নোট নেব না কিন্তু!’

* * *

মঙ্গলবার দুপুর দুটো পর্যন্ত খেটে একশো টাকা রোজগার হয়ে গেল। ইউনিফর্ম আর মেক-আপ না বদলে হাওড়া ময়দান থেকে বাস ধরে শিয়ালদা স্টেশনে এল অনিল। এখানে চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে শিয়ালদা মেন সেকশনের স্টেশন চত্বর পেরিয়ে সাউথ সেকশনে ঢুকে লোকাল ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় উঠে ভয় একটু কমল। দুপুরের দিকে ট্রেন ফাঁকা। জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে শেষ করার আগেই পেরিয়ে গেল পার্ক সার্কাস আর বালিগঞ্জ স্টেশন। লেক গার্ডেন্স স্টেশনে নেমে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতে ‘লেক ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট’ দেখিয়ে দিল।

বহুতলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থতমত খায় অনিল। ছেঁড়া জামাকাপড় পরা, দাড়িওয়ালা ভিখারিকে দারোয়ান ঢুকতে দেবে তো? গেটের ফাঁক দিয়ে মুখ গলিয়ে সে মিনমিন করে বলল, ‘বিনোদ চট্টরাজের ফ্ল্যাট?’

দারোয়ানকে নির্ঘাত আগে থেকে বলা ছিল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সিঁড়ি দেখিয়ে বলল, ‘পাঁচতলা।’

পাঁচতলায় হেঁটে উঠতে হবে? অনিল রেগে গেল। ভিখারির পোষাক পরে আছে বলে লিফ্‌টে ওঠার অধিকার নেই? লিফ্‌টে চড়ে পাঁচতলায় গেল সে। ‘চট্টরাজ’ নেমপ্লেটওয়ালা ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপতে দরজা খুলে দিল স্যান্ডি। তার হাতে একতাড়া কাগজ।

বসার ঘরে ঢুকে অনিল দেখল, বিনোদ সোফায় বসে রয়েছেন। টিভি দেখার অভ্যেস নেই বলে মুখ চেনে না অনিল। তবে বুঝল, মাঝবয়সি মানুষটিকে খুব সুন্দর দেখতে। চামড়া আর চুলের নিয়মিত যত্ন না করলে এই শরীর বজায় রাখা যায় না।

বিনোদ বিয়ার খাচ্ছেন। চাট হিসেবে রয়েছে শসার টুকরো। অনিলকে দেখে সোফা থেকে উঠে হাত জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার। আপনার সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল।’

টিভির হিরোর তার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল? আপ্লুত অনিল জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসল। বিনোদ বললেন, ‘দেখুন, এটা মেগা ঠিকই, কিন্তু একটা মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা আছে। আমিও ওই জন্যে খানিকটা রিয়্যালিস্টিক অভিনয় করতে চাইছি। আমি কী বলছি আপনি বুঝতে পারছেন তো?’

‘আমাকে কী করতে হবে?’ ভয়ে ভয়ে বলে অনিল।

‘আমি আপনার কাছ থেকে সব শুনতে চাইছি। কী ভাবে এই লাইনে এলেন? ভিক্ষে করতে বেরনোর সময়ে বাড়িতে কী বলে বেরোন— এই সব আর কী! আপনি প্লিজ ঘাবড়াবেন না। এ সব কথা কেউ জানতে পারবে না। আপনার পরিচয় গোপন থাকবে।’

‘আমার বাড়ির লোক জানে না যে আমি ভিক্ষে করি।’ মাথা নিচু করে বলে অনিল।

‘তার মানে বাড়ি থেকে বেরনোর সময় আপনার কস্টিউম, মেক-আপ আর বডি ল্যাংগোয়েজ অন্য রকম থাকে,’ থুতনি চুলকোচ্ছেন বিনোদ, ‘অ্যাজ ইফ আপনি চাকরি করতে যাচ্ছেন। তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি যখন ভিক্ষে করেন তখন ক্লায়েন্টকে কী ভাবে অ্যাপ্রোচ করেন? আপনি তো স্যান্ডির কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়েছিলেন। সেটা এক বার করে দেখান।’

স্যান্ডি সোফা থেকে উঠে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয় করছে। অনিল তার সামনে দাঁড়িয়ে ফাইল নেড়ে বলল, ‘বউয়ের ব্রেনে ক্যানসার হয়েছে স্যর। অপারেশনের জন্যে অনেক টাকা লাগবে। আপনি একটু সাহায্য করুন। ভগবান আপনার ভাল করবেন।’

অনিলের ভিক্ষের অভিনয়ের মধ্যে ভিতরের ঘর থেকে কেউ এক জন বসার ঘরে ঢুকে বিনোদের পাশে বসল। স্যান্ডি পকেট থেকে একশো টাকার দশটা নোট বার করে অনিলকে দেওয়ার সময়ে নিচু গলায় বলল, ‘আপনার টিএ আর ডিএ।’

হাজার টাকা পকেটে ঢুকিয়ে অনিল স্যান্ডিকে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যর। আপনার জন্যে আমার বউটা বেঁচে যাবে।’ তার পর ঘুরে দাঁড়াল।

বিনোদ বিয়ারে হালকা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ভিক্ষে চাওয়ার এক্সপ্রেশনটা বড্ড ফ্ল্যাট লাগছে। আমি একটু অন্য রকম ভাবে করছি। আপনি গাইড করুন।’

অনিল কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটির দিকে। সাদা শিফনের শাড়ি, লাল স্লিভলেস ব্লাউজ আর লাল লিপস্টিকের ছোঁয়ায় বন্দনাকে অন্য রকম লাগছে। ফুলশয্যার রাতেও এত সুন্দর লাগেনি। বন্দনা এত দামি শাড়ি পেল কোথা থেকে? ওরও কি গুরু আছে? গুরু না গুরু-মা? তার কাছে কি ইউনিফর্ম আর মেক-আপের জিনিস রাখা থাকে?

বিনোদ বন্দনাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে এঁর কথাই বলছিলাম। বাড়ির লোক জানে যে উনি চাকরি করেন। আসলে ভিক্ষে করেন। দুনিয়াটা কী ইন্টারেস্টিং। তাই না?’

বন্দনার চোখে মরা মাছের চাহনি। সে অনিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ঠিক সেই সময়ে সাহা গ্রুপের মালিক নীরেন সাহার সঙ্গে বজরংবলী হাউজিং-এর মালিক অরুণ সুরেকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে সোনার বাংলা জুটমিলের হাতবদল হয়ে যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Beggar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE