Advertisement
০৭ মে ২০২৪

রোজ সন্ধেবেলা সূর্যে গ্রহণ লাগে

সব অফিসে হুটহাট ঢুকে পড়া যায় না। সিকিয়োরিটির লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। লিখতে হয়। এক বার খুব খারাপ কাজ করে বসেছিলাম। নাম লেখার পরেই জিজ্ঞেস করল কোথা থেকে আসছি। বিড়বিড় করে বললাম, ‘বাইরে থেকে।’ অবাঙালি লোক কী বুঝল কে জানে, আসার উদ্দেশ্য, ঠিকানা লিখতে বলল। লিখে দিলাম— ধর্মীয়। পোটালা প্যালেস, লাসা, চায়না।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সব অফিসে হুটহাট ঢুকে পড়া যায় না। সিকিয়োরিটির লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। লিখতে হয়। এক বার খুব খারাপ কাজ করে বসেছিলাম। নাম লেখার পরেই জিজ্ঞেস করল কোথা থেকে আসছি। বিড়বিড় করে বললাম, ‘বাইরে থেকে।’ অবাঙালি লোক কী বুঝল কে জানে, আসার উদ্দেশ্য, ঠিকানা লিখতে বলল। লিখে দিলাম— ধর্মীয়। পোটালা প্যালেস, লাসা, চায়না। মন দিয়ে সেটা দেখে আমাকে ছেড়ে দিল। কোনও দরকারি কাজে আসিনি আমি। আমার বন্ধু বড় চাকরি করে, তার সঙ্গে আড্ডা মারার মতলব আর কী। আর যদি একটু কফি পাওয়া যায়। সে মুম্বইতে বদলি হয়ে যাওয়ায় অফিস টাইমে আমার আর ও-রকম কোথাও যাওয়ার রইল না। ডাক্তার বা উকিলদের বাদ দিলে, যাদের কোনও অফিস নেই, তাদের এটা একটা বড় সমস্যা। কাজের সময়টায় এদের কোনও কাজ থাকে না। অন্যদের কাজ থাকায় এরা বেকার হয়ে পড়ে। আমিও এদের মধ্যেই পড়ি। তবে আমার চেনা অনেকেই অফিসার। তাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে আমার। যেতামও। একটা ছোট ঘটনার পর আর যাই না বিশেষ। আমার বন্ধুর নতুন অফিস, একুশ তলায় বসে, জানলা দিয়ে কলকাতা দেখা যায়। দেখা হতেই থমথমে মুখে বলেছিল, ‘ভাবতেও পারবি না কী চাপ, সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো আছে, দেখছে।’ এটা শোনার পর আমারও খুব অস্বস্তি হতে লাগল। কেটে পড়লাম। আর যাইনি। আজকাল আর যাইও না।

দুপুরবেলা এক জন আমাকে ফোন করে বলল ‘কী রে ব্যস্ত? আয় না এক দিন, দেখা হয় না অনেক দিন।’ চলে গেলাম। কিন্তু দেখা হল না। রিসেপশনের ফোনেই সে আমাকে বলল, ‘সরি, চেয়ারম্যান ডাকছে, তুই একটু ঘুরে আসবি?’ ‘আরে না না ঠিক আছে। আমার একটা ছোট্ট কাজও আছে এ পাড়ায়, সেরে নিই বরং’ বলে বেরিয়ে এলাম। কোথায় আর যাব? বাঁ দিকে ক্যালকাটা ক্লাব, যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে না, তা ছাড় আমার পায়ে শু-জুতো নেই। একটু এগিয়ে ডান দিকে নন্দন। গেলেই হয়। অনেকেই আসে। আড্ডা মারে। দেখা হলে কেউ জিগ্যেস করবে না, ‘আরে এখানে?’ যার মানে হল, কাজ নেই বুঝি? ইনফর্মেশন সেন্টারের পাশের গলিতে ঢুকে পড়লাম। সুলভ শৌচালয়ের সামনে চেনা এক জন, সঙ্গে এক জন, খুব ঘন হয়ে বসেছিল, আমাকে দেখেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমিও দেখলাম না, কী দরকার? এর পরেই নন্দনের সামনের রেলিং ঘেরা খোলা জায়গা। এখানেই এক বার দেখেছিলাম সত্যজিৎ রায়কে। পাজামা-পাঞ্জাবি। হাতে পাইপ। গটগট করে ঢুকে গেলেন ভেতরে। অনেক লোকের সঙ্গে আমিও গেলাম কিছুটা। উনি লিফ্‌টে ঢুকলেন, মাথাটা একটু নিচু করতে হল। দরজা ওঁর মাপে নয়। আমি আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম। এর পর কি আর দু’ঘণ্টার সিনেমা দেখা যায়?

‘আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি তুমি এসেছ বলে।’ মুখ ঘুরিয়ে দেখি অভিজিৎদা। হারিয়ে গিয়েছিল অনেক বছর আগে। চেহারায় কোনও চেঞ্জ নেই। নানা রকম কথা শুনতাম। কেউ বলত পুলিশের ইনফর্মার। কেউ বলত পাগল, অনেকের কাছে নাকি জরুরি কারণে টাকাও চেয়েছে। ‘মল্লিকা মল্লিক আজ আসছেন, জীবনানন্দ সভাগৃহে কবিতা পাঠ করবেন, শুনবে তো?’ আমি কী আর বলি! আমি ও সব বুঝি না, ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপার। ‘এসো তোমাকে কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ করাই’ বলে আমার হাতটা ধরে ফেলল। এগোতেই হল। বাঁধানো জায়গায় এক দল ছেলেমেয়ে, কলেজে পড়ে বোধ হয়, আড্ডা মারছিল। তাদের কাছে গিয়ে, ‘আলাপ করিয়ে দিই, ও হচ্ছে—’ কেউ আগ্রহ দেখাল না। ওকে চেনে বলে মনেও হল না। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। ওদের দেখিয়েই অভিজিৎদা বলতে লাগল, ‘পাগল সব, কী যে করে না, কী বলব, ওদের জন্য আমার খুবই চিন্তা হয়। তোমার সব ভাল তো?’ মাথা নাড়লাম। নানা রকম লোক ঘুরছে আশেপাশে, একটু দূরে রেস্তরাঁ। ‘তুমি কিছু খাবে? চা?’— এর মানে আমার পকেট থেকে খসবে। ‘না’ বলার সুযোগ নেই। ‘চলো চলো, এত দিন পরে এলে। আচ্ছা তোমার সেই ঝামেলাটা নিশ্চয়ই মিটে গেছে?’ তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলাম। আজ অভিজিৎদার হাতে পড়েছি। সাবধানে থাকতেই হবে। লুজ টক করা যাবে না। দেখে বুঝতে পারছি ও এখানেই আসে। একে-ওকে ধরে। অপ্রকৃতিস্থ না-ও হতে পারে। তবে অতীত-বর্তমান গুলিয়ে চচ্চড়ি করে ফেলেছে। আর তার মধ্যে বার বার নুন দিয়ে ফেলছে অন্যমনস্ক ভাবে। চায়ের দোকানের কাছে পৌঁছে আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে কোথায় যেন চলে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল এই পুরো নন্দন চত্বরটাই ওর কন্ট্রোলে রয়েছে। সব্বাইকার সঙ্গে দেখা করানো, খোঁজখবর দেওয়া নেওয়ার কাজটাও ওরই। কিছু দূরে ছাই-রঙা লম্বা চুল, নীল পাঞ্জাবি পরা এক জন মানুষ আসছেন উদাস মুখে, সঙ্গে কয়েক জন, চেনা চেনা লাগল, অভিজিৎদাও এসে গেল। ‘যোগেনদার সঙ্গে আলাপ আছে তো?’ ঠিকই তো, আর্টিস্ট যোগেন চৌধুরী। আমি তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘চলো চলো চা খাই। চা না কফি?’ মাটিতে পেতে দোকান বসেছে। জাংক জুয়েলারি আছে। হাতে আঁকা ছবি, কার্ড, প্রিন্ট করা পোস্টার ঝুলছে। রবীন্দ্রনাথ, চে গেভারা, সত্যজিতের লুক থ্রু-র ছবি। দারুণ সহাবস্থান। জীবনানন্দ, মাও আর ঋত্বিকও থাকতে পারত। নেই। ব্যাপারটা বলতেই অভিজিৎদা একেবারে থমকে গেল। অনেক ক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে রইল রবীন্দ্র সদনের দিকে, তার পর ভয়ানক ভাবে কয়েক বার মাথা ঝাঁকিয়ে খুবই কোমল গলায় বলল, ‘আছে একটা?’ দিলাম সিগারেট। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অবজ্ঞা করে তাড়িয়ে দেওয়ার স্টাইলে দেশলাইয়ের ফালতু আগুনটা হাতের হাওয়ায় নিভিয়ে দিল। মূল আগুনকে আরও লাল করে টেনে নিতে চাইল নিজের ফুসফুসের মধ্যে। অনেকখানি ধোঁয়া ছাড়ায় ওর মুখটা মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল। বলল, ‘এইটা, এগজ্যাক্টলি এই ব্যাপারটা এরা বুঝতে পারছে না। পারবেও না। পড়াশোনা নেই তো। ফাউন্ডেশনটা কাঁচা। লক্ষ করো, সবাই কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলে যাচ্ছে। কেউ কারুর কথা শুনছে না। তাও বলে যাচ্ছে। বলেই যাচ্ছে।’

এর পরেই চেনা গতে বিপ্লবের কথা আসবে। কিন্তু এল না। আলো পড়ে গেছে অনেক ক্ষণ, গাছপালা থাকায় জায়গাটা একটু বেশি অন্ধকার লাগছে। নন্দনের মাথায় স্পটলাইটগুলো জ্বলে উঠেছে, আলোর আভা চুঁইয়ে নামছে সাদা দেওয়াল বেয়ে। কমলা রঙের বলের মতো আলো চার পাশে, অদ্ভুত পরিবেশ। যেন একটা রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র। আর্ট-কালচার-জীবনবোধ প্রতিনিয়ত কারা যেন ছুড়ে দিচ্ছে সন্ধের ঘন নীল আকাশের দিকে। কলকাতার আর কোথাও তো এমন নেই। সেই জন্যই তো আসে আমার মতো লোকেরা। আর অভিজিৎদারা। কাজের লোকের জায়গাই নয় এটা। এই সব ভাবছিলাম। আমার বন্ধু ফোন করেনি আর। করার কথাও নয়। সত্যি বলতে কী, এখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না আর। বললাম, ‘তা হলে কী দাঁড়াল বলো তো? এ বারে কী হবে?’ ধাঁ করে কোনও উত্তর না দিয়ে অভিজিৎদা স্লো মোশনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। তার পর চোখে চোখ লক হয়ে গেল। বলল, ‘ব্যারিকেড দেখতে পাচ্ছ কি? না, পাচ্ছ না। পাবেও না। কিন্তু আছে। সেটা পেরোতে হবে। সাহস চাই।’ সামনে একটা টিকিট কাউন্টার, ধাপে ধাপে ছেলেমেয়েরা বসে আছে, যেমন থাকে। একটা দেওয়ালের মধ্যে গোল কাট আউট। কমলা আলোয় ভাসছে চার পাশ। ভেতরে গোল কালো ছায়া। যেন সূর্যে গ্রহণ লেগেছে। রোজ সন্ধেবেলা লাগে। অভিজিৎদা এগিয়ে গেল ওটার দিকে। তার পর দু’হাত দিয়ে কাল্পনিক অনেক জলকে দু’পাশে সরিয়ে দিয়ে টপকে চলে গেল ভেতরে। টাল সামলাতে পারল না। ধড়াম করে পড়ে গেল কমলা অন্ধকারে।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Subhamoy Mitra travel office mumbai phone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE