তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
মহাভারতের আদলে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন ‘নবভারত’। ‘আদলে’ কথাটা ভুল হল। চিরন্তন মহাকাব্যের অনুকরণ-অনুসরণ নয়, আসলে লিখতে চেয়েছিলেন উনিশ ও বিশ শতকের ভারতের উত্তরণের কাহিনি। মহাভারতের মতোই, এই ‘নতুন’ ভারতেও তো কত ঘটনার ঘটা, কতশত চরিত্রের সমাবেশ! তাদের জীবন ও কীর্তি দেশকে উঠিয়েছে সভ্যতার উচ্চাসনে। এই আধুনিক ভারতকথা লেখা হোক, চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিজের লেখায় প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এই মহাগ্রন্থের। ‘...শতবর্ষের ইতিহাস ও উপাখ্যান নিয়ে মহাভারতের মত নবভারত রচিত হোক। বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে বিভিন্ন পর্ব।’ বোঝাই যাচ্ছে, বইটি হবে বিপুলায়তন। লিখেছিলেন, ‘এ বিরাট কর্ম একজনের নয়— ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রতিনিধিমণ্ডল নিয়ে বিচার করে এক একজনের উপর এক এক পর্বের ভার দেওয়া হোক।...নায়ক স্থির হোক। শেষ স্থির হোক।’
এ লেখা যখন লিখছেন তারাশঙ্কর, তখন বিশ শতকের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে। ভারত স্বাধীন। মহাত্মা গাঁধী নিহত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধান্তে যেমন মহাভারতের ইতি, তেমনই মহাত্মার জীবনাবসানে নতুন ভারতকথার মহানাটকীয় ইতি, মনে হয়েছিল ‘গণদেবতা’-র লেখকের। সঙ্গে সঙ্গেই বলছেন, কী করেই বা বলি শেষ। কারণ দেশভাগ, অসংখ্য মানুষের ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার ঘটনাও যে ঘটে গিয়েছে এরই মধ্যে। বহু সার্থকতার মধ্যে এই জ্বলজ্বলে অসার্থকতাটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছে, সাফল্য-ব্যর্থতার এই নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই বয়ে চলবে ভারতজীবন। এই দ্বন্দ্ব, এই অসমাপ্তিও ‘নবভারত’-এরই অংশ। এক-একটি প্রদেশের এক জন করে লেখক যদি সত্যিই লেখেন একটা করে পর্ব, তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘এই মহাকাব্যের একটি অংশ লেখার ইচ্ছা আমার’।
এই ‘ইচ্ছা’র পিছনেও এক অন্য পটভূমি। জীবনভর বিস্তর লেখালিখির পরেও আসলে যে বইটা, যে একক অনন্য দুর্দান্ত বইটা লেখার ইচ্ছে মনের মধ্যে থাকে লেখক মাত্রেরই, সেই বই লেখার প্রসঙ্গেই তারাশঙ্করের এত কথা। প্রত্যেক লেখকের মধ্যেই থাকে একটা ‘যে বই লিখতে চাই’ সিনড্রোম। যে বই লিখলে আমার জীবন পূর্ণ, সার্থক হবে। যে বইয়ে ‘বর্তমান জগতের পটভূমিতে চরম ও পরম-সত্যকে উদ্ঘাটিত করতে হবে’। যা লিখলে আসবে খাঁটি পরিতৃপ্তি। তারাশঙ্কর বলছেন, ‘নবভারত’ তাঁর সেই ‘লিখতে চাওয়া’ বই। তিনি কল্পনা করেন, ‘একখানা নূতন কাগজ টেনে নিয়ে যত চমৎকার করে আমার সাধ্য আমি লিখব— নবভারত, বঙ্গপর্ব-রচয়িতা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’।
কিন্তু কেন লেখা হল না সেই বই? তারাশঙ্কর বলছেন তাঁর পড়া একটা বিদেশি ছোটগল্পের কথা। সুপণ্ডিত এক লেখক ঘোষণা করলেন, চিরস্মরণীয়, মহৎ এক বই লিখবেন তিনি। নতুন ঘর হল, নতুন কাগজ-কলম— বই লেখা হবে বলে। ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি হলেন লেখক। দিন যায়। স্ত্রী এসে খাবারটুকু দিয়ে যান, দেখেন, রাশি রাশি বই স্তুপীকৃত পড়ে, বই লিখবেন বলে বই পড়ছেন লেখক স্বামী। মাস গড়ায়, উৎসুক সবাই জানতে চায়, কদ্দূর এগোলো? স্ত্রী বলেন, এই তো, শিগগিরই শেষ হবে। বছর ঘোরে, স্ত্রী দেখেন, আর বই পড়ে থাকে না মেঝেতে, পড়ে থাকে শুধু রাশি রাশি কাগজ, ছেঁড়া, দলা পাকানো। এক দিন ভারী কী একটা পড়ার শব্দে দৌড়ে এসে স্ত্রী দেখেন, লেখক পড়ে আছেন মেঝেতে। মৃত। সারা দেশ ভেঙে পড়ে বাড়িতে। কোথায় সেই ‘মাস্টারপিস’? সবাই আবিষ্কার করে, ঘর ভরা শুধু সাদা কাগজ। কেবল একটায় লেখা একটিমাত্র শব্দ— ‘কল্পনামৃত’! নীচে লেখক হিসেবে ওঁর নাম। ব্যস, এইটুকুই।
আসলে যে বই লিখতে চাই, তা তো লেখা হয় না কখনও। তাই ‘নবভারত’ও লেখা হয়নি। ‘জীবন শেষ হবে, সেদিন সকলে ছুটে আসবেন বঙ্গপর্বের জন্য, খুঁজে দেখবেন; পাবেন শুধু শেষ লেখা কাগজ একখানি— তাতে লেখা আছে নবভারত বঙ্গপর্ব-রচয়িতা তারাশঙ্কর— বাকি কাগজগুলি সব সাদা— সব সাদা— সব সাদা।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy