Advertisement
E-Paper

ক্যামেরার মৃত্যু

কঙ্কালসার শিশু আর ক্ষুধার্ত শকুনের ছবি তুলে পেয়েছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। অতঃপর অপরাধবোধ, অবসাদ, মৃত্যু। কঙ্কালসার শিশু আর ক্ষুধার্ত শকুনের ছবি তুলে পেয়েছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। অতঃপর অপরাধবোধ, অবসাদ, মৃত্যু।

সম্রাট মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:০০
শিল্পী: আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার।

শিল্পী: আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার।

মার্চ, ১৯৯৩। দক্ষিণ সুদানের ঊষর প্রান্তর। চাবুক রোদ, গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া বাতাস। টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসছে একরত্তি এক জীবন্ত কঙ্কাল। মেদ-মাংসের বদলে হাড়ের উপরে লেপটে থাকা চামড়ার সান্ত্বনা পুরস্কার। দুর্বল পা কাঁপছে থরথর। হঠাৎ মাথা নিচু করে মাটিতে বসে পড়ল বছর তিনেকের শিশুটি।

একটু দূরেই দাঁড়িয়ে এক যুবক। দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্রসাংবাদিক কেভিন কার্টার। হাতে ধরা এসএলআর ক্যামেরা শিশুটির দিকে তাক করলেন তিনি। অভুক্ত, শীর্ণকায় আফ্রিকান শিশু তো লোভনীয় ‘সাবজেক্ট’। কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়েছেন, হঠাৎ দেখলেন, শিশুটির ঠিক পিছনে নিঃশব্দে এসে নেমেছে এক শকুন। পায়ে পায়ে এগোচ্ছে তার দিকে। আবার ক্যামেরা তাক করলেন কেভিন। ক্ষুধার্ত, বেপরোয়া শকুন তখন শিশুটির আরও কাছে। কেভিন এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরাটাই লাঠির মতো করে শূন্যে ঘোরালেন কয়েক বার। শকুনটি প্রথমে ভ্রুক্ষেপ করল না, কেভিন আরও এগিয়ে যেতে অনিচ্ছায় রণে ভঙ্গ দিল। শিশুটি উঠল, ফের শুরু করল হাঁটা।

পেশাদার সাংবাদিকের আবেগপ্রবণ হওয়ার অবকাশ থাকে না। দাঙ্গা, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা— খুব সামনে থেকে দেখেছেন কেভিন। তবু ওই ছবিটা তোলার পর গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল একটা কষ্ট। চোখে জল। একটার পর একটা সিগারেট খেলেন।

বহু ‘এক্সক্লুসিভ’ ঝুলিতে, কিন্তু দুর্ভিক্ষের সঙ্গে সেটাই প্রথম পরিচয় কেভিনের। মানুষের দুর্দশা যে এত ভয়াবহ হতে পারে, ধারণা ছিল না তাঁর। সুদানে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। সঙ্গী দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ। মানুষকে ওই ভাবে মরতে দেখে কেভিন এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, শিশু মেয়েটির খোঁজ নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি তাঁর। সে কোথায় গেল, জানার চেষ্টা করেননি।

২৬ মার্চ, ১৯৯৩। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হল কেভিন কার্টারের সেই ছবি। ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’। চার দিকে তোলপাড়। হাজার হাজার চিঠি আর ফোন আসতে শুরু করল দফতরে। সবার প্রশ্ন, শিশুটির পরিণতি কী হল? শকুনেই কি খেল তাকে? না কি নিরাপদ কোনও আশ্রয়ে পৌঁছতে পেরেছিল সে?

শিল্পী: আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার।

কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলেন কেভিনকে। কেভিন জানালেন, তিনি শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটি উঠে হাঁটতেও শুরু করেছিল। কিন্তু ত্রাণশিবির পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল কি না, তিনি জানেন না। কেভিনের উত্তর-সংবলিত বিশেষ ‘এডিটর্স নোট’ ছাপা হল কাগজে। পাঠকের ক্ষোভের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হল। কেভিন শিশুটিকে ওই অবস্থায় ফেলে কী ভাবে চলে এলেন, প্রশ্ন তুললেন পাঠকেরা। অন্যান্য কাগজের সম্পাদকীয়তেও কেভিনের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ নিয়ে কটাক্ষ করা হল। কেভিন এক বার বলেছিলেন, সেই সময় সুদানের ওই অঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স মহামারির আকার নিয়েছিল। বিদেশি সাংবাদিকদের বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন স্থানীয় কোনও মানুষকে স্পর্শ না করেন। বলাই বাহুল্য, তাঁর এই যুক্তি কেউ মানতে চাননি। সেন্ট পিটার্সবার্গ টাইমস পরিষ্কার লিখেছিল, ‘মেয়েটির ওই অবস্থা, আর তার সামনে এক জন ক্যামেরার লেন্স অ্যাডজাস্ট করছেন একটা ভাল ফ্রেম পাওয়ার জন্য! ওই শকুনের সঙ্গে ওই লোকটির কি কোনও তফাত আছে?’

কেভিন বুঝলেন, এ ছবিটা তাঁর পিছু ছাড়বে না। যেখানেই যান, সেই এক প্রশ্ন। উত্তর দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। যত দিন যায়, অবসাদ তীব্রতর হতে থাকে। অপরাধবোধ আর অনুতাপের চোরকাঁটায় ভিতরটা রক্তাক্ত। ছটফটে যুবকটি দিনভর অন্যমনস্ক।

পরের বছরের গোড়াতেই চমক। পুলিৎজার পুরস্কার ঘোষিত হল। ‘ফিচার ফোটোগ্রাফি’ বিভাগে বিজয়ীর নাম কেভিন কার্টার! অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেলেন ৩৩ বছরের যুবকটি। কিন্তু, যে দু’টি প্রাণীর জন্য তাঁর এই প্রাপ্তি, সেই ক্ষুধার্ত শকুন আর সেই কঙ্কালসার শিশুটি যে শান্তি দিচ্ছে না তাঁকে!

১৯৯৪ সালের এপ্রিলে কেভিনের পুলিৎজার পাওয়া, আর ওই মাসেই ছবি তুলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন তাঁর বন্ধু কেন উস্টারব্রোক। সেই কেন, কেভিনের ‘ব্যাং ব্যাং ক্লাব’-এর অন্যতম সদস্য, যুদ্ধ বা গোলাগুলির মধ্যেও গিয়ে ছবি তুলতে যার হাত কাঁপত না এতটুকু! ম্লান হয়ে গেল কেভিনের পুরস্কার জয়ের আনন্দ। ফের ডুবে গেলেন অবসাদে।

তিন মাস বাদে জোহানেসবার্গের কাছে পার্কমোর এলাকায় নিজের গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেল কেভিনকে। মৃত। গাড়ির ধোঁয়া বেরনোর নলের সঙ্গে আর একটি পাইপ জুড়ে গাড়ির জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার পরে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছিলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইডে মৃত্যু।

রেখে গিয়েছিলেন একটি সুইসাইড নোট। তাতে লেখা: আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। জীবনের যন্ত্রণা সব আনন্দকে এতটাই ম্লান করে দেয় যে, আনন্দ বলে কিছু অনুভব করা যায় না। আমি অবসাদে ডুবে গিয়েছি। চারপাশে বড় দৈন্য... খুনের পর খুন, লাশের পাহাড়, মানুষের রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা, অভুক্ত ও জখম শিশু, বন্দুক-পাগল উন্মাদ, খুনি পুলিশ আর জল্লাদের দল যেন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি চললাম বন্ধু কেনের সঙ্গে দেখা করতে, যদি ভাগ্যে থাকে।

Kevin Carter South African photojournalist Depression কেভিন কার্টার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy