Advertisement
০৭ মে ২০২৪
খু দ কুঁ ড়ো

পায়ে আশি টাকার জুতো!

১৯৪২-৪৩ সালে আশি টাকা এখনকার কত টাকা হবে, তা আমার জানা নেই বটে, কিন্তু এটা জানি যে, তখন কাটিহারে এক সের (কেজি নয়) মাংসের দাম ছিল আট আনা। বড় একটি পেতলের কলসি ভরা ভাগলপুরি গরুর দুধ এক টাকা। এবং আমার বাবা এক জন প্রবলপ্রতাপ টি আই হিসেবে রেল থেকে একশো বা সোয়াশো টাকা বেতন পেতেন। এবং সেটা অনেকের মতে বেশ মোটা বেতন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:১২
Share: Save:

১৯৪২-৪৩ সালে আশি টাকা এখনকার কত টাকা হবে, তা আমার জানা নেই বটে, কিন্তু এটা জানি যে, তখন কাটিহারে এক সের (কেজি নয়) মাংসের দাম ছিল আট আনা। বড় একটি পেতলের কলসি ভরা ভাগলপুরি গরুর দুধ এক টাকা। এবং আমার বাবা এক জন প্রবলপ্রতাপ টি আই হিসেবে রেল থেকে একশো বা সোয়াশো টাকা বেতন পেতেন। এবং সেটা অনেকের মতে বেশ মোটা বেতন। আর এটাও আবছা স্মরণে আছে যে, আমাদের দৈনিক বাজারের খরচ এক টাকা পাঁচ সিকের বেশি ছিল না। আমি আবার ততটা গবেট নই যে, এই পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করে বলব যে, সেই আমলটা খুব সস্তার আমল ছিল। টাকার অবমূল্যায়ন নানা কারণেই হয়। তাতে ‘তখন সস্তা ছিল, এখন আক্রা’ এমনটা মনে করার কারণ নেই।

যাই হোক, বিশুমামার এই কাহিনিতে এই বাজারদরের একটা ভূমিকা আছে। বিশুমামা ছিলেন অকৃতদার, আমার মায়ের চেয়ে পাঁচ-ছ’বছরের ছোট এবং ছিলেন লালমণিরহাট স্টেশনের রেলের ইয়ার্ড মাস্টার। আমার মামারা প্রায় সকলেই ভিতু প্রকৃতির মানুষ, ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলেন। আমি জেনেটিক্যালি মামাদের ভিতু স্বভাবটিই পেয়েছি। আমার আট জন মামার মধ্যে রামমামা, নিরুমামা আর জিষ্ণুমামাই যা একটু ডাকাবুকো ছিলেন। বিশুমামা মাঝেমধ্যেই কাটিহারে চলে আসতেন তাঁর মেজদি, অর্থাৎ আমার মায়ের কাছে। আমার মামারা প্রায় সকলেই ভালমানুষ গোছের, বিষয়বুদ্ধিহীন, একটু বেশিই সোজা-সরল। ফলে দাদামশাইয়ের রেখে যাওয়া বিশাল বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের হাতছা়ড়া হয়ে গিয়েছিল।

বিশুমামার আরও একটা ব্যাপার ছিল। মা বা ভাই-বোন— কারও মৃত্যুসংবাদ সহ্য করতে পারবেন না বলে তিনি কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন না। শুধু আমাদের সঙ্গেই রাখতেন, তা-ও রেলতুতো সম্পর্কটা ছিল বলেই।

বিশুমামা আমার অন্যান্য মামার মতোই বাবুগিরির ধার ধারতেন না। কাজের সময় রেলের পোশাক পরতেন, বাকি সময় ধুতি আর জামা। পায়ে একজোড়া সস্তা চপ্পল। যখন আমাদের বাড়ি আসতেন, তখন ভাগ্নে-ভাগ্নিদের জন্য নিয়ে আসতেন সস্তার মিলিটারি বিস্কুট। মিলিটারিদের জন্য তৈরি সেই সব মোটা মোটা বিস্বাদ বিস্কুট মিলিটারিরাও খেত কি না, সন্দেহ।

এক বার বিশুমামা এমন কাণ্ড করলেন যে, গোটা কাটিহার চমকে গেল। ভোরবেলা বিশুমামা এসেছেন। পরনে সেই মলিন ধুতি আর জামা, কিন্তু দু’পায়ে চকচক করছে এক জো়ড়া নতুন বুটজুতো। সেই জুতো দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। কেন না, মামা কবুল করলেন সেই জুতোজোড়ার দাম নাকি আশি টাকা। শুনে মায়ের তো ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মায়ের যে কী বকুনি মামাকে! তোর আক্কেলটা কী বল তো? এমনিতে তো কাছাকোঁচার ঠিক নেই, ন্যালাখ্যাপা মানুষ। অত দামি জুতো কিনলি কার বুদ্ধিতে? ও তো চোরে-ডাকাতে কেড়ে নেবে। আমার বাবা কাঠবাঙাল। লাইন থেকে ফিরে ঘটনা শুনে এবং জুতো দেখে তাঁরও চোখ কপালে, এইটা করছস কী রে বিশ্বনাথ? পেটেন্ট লেদারের বিলাতি জুতা পায়ে পইরা ঘুরতাছস? তাও ধুতি আর জামার লগে! তর অবস্থা তো দ্যাখতাছি, সর্বাঙ্গে উড়ে খৈল মাগ্গে মাখে বিষ্ণুতৈল!

আশি টাকার জুতোর কথা যে-ই শোনে, সে-ই তাজ্জব হয়ে যায়। আমাদের বাংলোয় বাবার দেওয়া এক পার্টিতে বড় এক রেলের অফিসারের বউ একশো টাকা দামের শাড়ি পরে এসেছিলেন, যা দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। সেইটেই আমার দেখা একটা দামি জিনিস। তার পরই বিশুমামার জুতো।

মামা অবশ্য জুতোর গৌরবে খুব একটা গৌরবান্বিত নন। বরং তাঁকে খানিকটা তটস্থ আর অপ্রতিভই দেখাচ্ছিল। কোনও এক বিলিতি জুতোর দোকানে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় কিনে ফেলেছেন। কেনার পর বোধহয় তাঁর মনস্তাপও হচ্ছিল। কিন্তু সাহেবপাড়া থেকে ঝেঁটিয়ে লোক আসতে লাগল আশি টাকা দামের জুতো দেখার জন্য। আমি আমার বন্ধুদের ডেকে আনলাম। সুতরাং বাড়িতে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। আমি তখন প্রবল উত্তেজিত। কারণ মামা আমার, সুতরাং তাঁর জুতোর ওপর আমারও যেন আংশিক অধিকার।

তবে নিরপেক্ষ বিচারে জুতোজো়ড়ার তেমন আলাদা বৈশিষ্ট্য বা বাহার ছিল না। আর পাঁচটা জুতোর মতোই। একটু চকচকে, এই যা। সে বার যে ক’দিন মামা আমাদের বাড়িতে ছিলেন, জুতোজোড়াকে দ্রষ্টব্য হিসেবে তোলা তোলা করে রাখা হল।

এর পরের বার মামা যখন এলেন, তখন দেখি সেই দামি জুতো অনেকটাই মলিন, জেল্লা উধাও। মামা বললেন, কী করব বল? ইয়ার্ডে ধুলো-কাদায় ঘুরে ডিউটি করতে হয়। পরের বার যখন আবার এলেন, তখন আশি টাকার জুতো মহিমা হারিয়েছে। ছাল উঠে গেছে। পালিশ হয়নি বহু দিন, সোল ক্ষয়ে গেছে অনেকটা। ক্রমে ক্রমে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে হয়ে জুতোজোড়া বছরখানেকের মধ্যেই বুড়ো হয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibasariya Srisendu Mukherjee Shoe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE