Advertisement
E-Paper

হংসরাজ আমার ষোলো নম্বর ছবি, লোকে ভাবে ওটাই প্রথম!

প্রথম ছবিতে আমি ছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটবেলার চরিত্রে। তখন আমি বছর পাঁচেকের। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। এক দিন বাবার সঙ্গে গেছি সিইএসসি-র ভিক্টোরিয়া হাউসে।

অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
‘হংসরাজ’ ছবির দৃশ্য

‘হংসরাজ’ ছবির দৃশ্য

প্রথম ছবিতে আমি ছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটবেলার চরিত্রে। তখন আমি বছর পাঁচেকের। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। এক দিন বাবার সঙ্গে গেছি সিইএসসি-র ভিক্টোরিয়া হাউসে। ওখানেই প্রথম সলিল দত্তর সহকারী বিজনদা আমায় দেখেন এবং বাবাকে বলেন, সলিলদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটবেলার চরিত্রের জন্য একটা ছেলে খুঁজছেন। আপনার ছেলেকে ভীষণ ভাল মানাবে। আপনি কি ওকে দেবেন? বাবা একটু সময় চেয়ে নিলেন। তার পর বাড়িতে কথাবার্তা বলে আমরা গেলাম টেকনিশিয়ান‌্স স্টুডিয়োতে। সলিল দত্তর ঘরে যাওয়ামাত্রই আমি সিলেক্টেড হয়ে গেলাম। সেটা ১৯৬৬ সাল।

ছবির নাম ‘প্রস্তরস্বাক্ষর’। শুটিং শুরু হল একটা গানের লিপ দিয়ে। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন শিপ্রা বসু। গানটা ‘সূয্যিমামা কেমন আছ’। ওইটুকু বয়সে শুটিং কী, বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে গান রেকর্ডিংয়ের দিন আমাকে পরিচালক ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মনে আছে, শিপ্রামাসি আমায় দেখেই একটা ক্যাডবেরি দিলেন। আমার প্রথম শটটাই ছিল আউটডোর। গরুমহিষানী-তে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দৌড়তে দৌড়তে একটা টিলার ওপর পা রেখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে গাইতে হবে, ‘সূয্যিমামা কেমন আছ, কোথায় তোমার বাড়ি’। পরিচালক আমাকে দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিলেন। আর প্রথম শটেই ‘ওকে’।

তখন সৌমিত্রমামারও খুব কম বয়স। দারুণ চেহারা। দেখতাম, সময় পেলেই তিনি বেডিং পেতে ব্যায়াম করতেন। নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। আমার মা ভীষণ ভাল গান করতেন। এখনও করেন। আমার গানের শিক্ষকও তিনি। শুটিং শেষ হলেই সন্ধ্যা রায় মা’কে অনুরোধ করতেন লোকসংগীত গাইবার জন্য। তখন আউটডোরগুলো এত সুন্দর হত যে, বাড়ি এসে ভীষণ মনখারাপ করত। শুটিংয়ের পর গানবাজনা, আড্ডা খুব মিস করতাম। দ্বিতীয় ছবির আউটডোর ছিল দার্জিলিং। আর সেখানেই প্রথম উত্তমকুমারের সঙ্গে আলাপ। দার্জিলিঙে ওঁরা যে হোটেলে ছিলেন, সেখানে এক দিন প্রোডাকশন থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল আলাপ করাতে। ফায়ারপ্লেসের আগুনের এক দিকে উত্তমকুমার বসে, অন্য দিকে সুপ্রিয়া দেবী। আমাকে আলাপ করানো হল এই বলে যে, এই ছেলেটি অভিনয় করছে। ও খুব ভাল গানও করে। সুপ্রিয়া দেবী আমাকে কাছে ডেকে বললেন, একটা গান করো তো! ফোক গাইলাম। অনেক গান শুনিয়েছিলাম সে দিন। তার পর থেকেই ওঁরা আমার ‘মামা’ আর ‘সুপ্রিয়ামাইমা’।

এই ছবিগুলো করতে করতেই ‘হংসরাজ’। আমার ষোলো নম্বর ছবি। কিন্তু ওটা আমাকে এতটাই জনপ্রিয় করেছিল যে, আগের ছবিগুলোর কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেছে। হংসরাজে প্রথমে আমাকে গান গাইতে ডাকা হয়েছিল। বনশ্রী সেনগুপ্ত আমাকে ফোন করে বলেন, একটা বাচ্চাদের জন্য ছবি হচ্ছে। তার জন্য সুধীনদা (দাশগুপ্ত) একটা নতুন গলা খুঁজছেন। তুই একটু সুধীনদার সঙ্গে দেখা কর। গেলাম সুধীনদার বাড়ি। বাড়ি গিয়ে গানটানও তোলা হল। কিন্তু কিছু টেকনিক্যাল কারণে আমি গান থেকে বাদ পড়ে যাই। মার্কেটিংয়ের দিক থেকে মনে করা হয়েছিল যে, নতুন শিল্পীদের দিয়ে গান গাওয়ানোটা রিস্ক হয়ে যেতে পারে। তাই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের দিয়ে কাজটা করানো হবে। তাই, সে জায়গায় আরতি মুখোপাধ্যায় গাইলেন। সে রেকর্ডিংও টেকনিশিয়ান্‌স স্টুডিয়োতে হল। কিন্তু স্কোরিং-এ আমি বেশি ক্ষণ থাকতে পারিনি। চোখে জল চলে আসছিল। যে গানটা আমায় তোলানো হয়েছে, সেই গান অন্য কেউ গাইছে শুনে বড্ড কষ্ট হয়েছিল। পরবর্তী সময় পরিচালক অজিত গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বলেন, হংসরাজের জন্য তো সে রকম কাউকে পাচ্ছি না। তুই এই চরিত্রটায় অভিনয় কর। কিন্তু আমার এত অভিমান হয়েছিল যে, সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু মা বোঝালেন, গান থেকে তো বাদ পড়লি। অভিনয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নে। রাজি হলাম। হংসরাজ করব বলে খমক বাজানো শিখলাম। সাঁতার জানতাম না। তা-ও শেখানো হল। আর, পরেরটা ইতিহাস।

এই ছবিকে ঘিরে অনেক স্মৃতি। হংসরাজের টিয়া আসলে আমার নিজের বোন। স্বর্ণালী। হ‌ংসদাদা বর যে তারি/ টিয়া চলে শ্বশুরবাড়ি। লোকে তো আর জানত না, টিয়া আমার বোন। আর হংসরাজের পর আমি সুপারস্টার। ফলে রাস্তায় বোনকে নিয়ে বের হলে মাঝেমধ্যেই টিটকিরি শুনতাম, ‘কী রে অরিন্দম! এই বয়সেই মেয়ে নিয়ে বেরোচ্ছিস!’ তার পর থেকে বোনের স্বভাবই হয়ে গেল, কোনও গেট টুগেদার-এ আমার সঙ্গে থাকলেই ও বেশি করে ‘দাদা, দাদা’ বলে কথা বলত। সে স্বভাব এত দিনেও বিশেষ বদলায়নি।

এই ছবি শুটিংয়ের সময় এক বার মহা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। ছবির শেষের দিকে প্রতিযোগিতায় গান গাইতে দেওয়া হবে না বলে হংসরাজকে ছাদের ওপর আটকে রেখেছে ডনি। ওই শটটা নেওয়ার সময় এক জন গুন্ডা আমায় কাঁধে তুলে রেখেছে। আর ডনি ‘অ্যাই চুপ কর, চুপ কর’ বলে চেঁচামেচি করছে। হঠাৎ ও শটটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে বলে আমায় মারল এক সপাট চড়। ‘ঠাস’ করে বিকট একটা আওয়াজও হল। বেমক্কা ভাবে চড়টা আমার চোখের ওপর এসে পড়ে। আমি শটটা শেষ করলাম ঠিকই। কিন্তু তার পরই চোখ চেপে বসে পড়লাম। চোখ ফুলে লাল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে চা-পাতার গরম সেঁক দেওয়া হল, যাতে ফোলাটা একটু কমে, আর পরের শটগুলো করতে পারি। এ দিকে ডনির তখন কী অনুশোচনা! আমি ভেজিটেব্‌ল চপ খেতে ভালবাসতাম বলে অনুশোচনার ঠেলায় ও তাড়াতাড়ি সে-সব আমার জন্য কিনে আনল।

হংসরাজ রিলিজের পর একটা খুব সুন্দর ঘটনার কথা মনে আছে। উজ্জ্বলাতে তৃতীয় দিন, একটা রবিবার। তখন আমি ‘সুদূর নীহারিকা’ বলে একটা ছবি করেছি। সেখানে আমার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্য। উনি সে দিন আমার বাড়ি এসেছিলেন। হল-এ ওঁকে নিয়ে আমার হংসরাজ দেখতে যাওয়ার কথা। শো-এর শেষে যখন বেরোচ্ছি, তখন আমাকে দেখে উজ্জ্বলার সামনেটা স্তব্ধ হয়ে যায় জ্যামে। আমার জনপ্রিয়তা দেখে রাধামোহনবাবু তখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চোখ বুজলে আমি এখনও ওঁর সেই হাসিমুখটা দেখতে পাই।

তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার চলচ্চিত্র পুরস্কার দিত। সিদ্ধার্থশংকর রায় মুখ্যমন্ত্রী। এক দিন রেডিয়োতে খবর শুনছি। শুনলাম চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। নামগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ শুনি শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে হংসরাজ ছবির জন্য মাস্টার অরিন্দম। কী যে লাফিয়েছিলাম সে দিন! সমস্যা হল, হংসরাজ শুটিং হয়েছিল ১৯৭৩-৭৪ সালে। কিন্তু ছবিটা রিলিজ করতে ভীষণ ঝামেলা হয়। কোনও স্টারকাস্ট নেই যে-ছবির, সেই ছবি কেউই নিতে চাননি। অনেক কাঠখ়ড় পুড়িয়ে ’৭৬ সালের অগস্ট নাগাদ ছবিটি মুক্তি পায়। ফলে, তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে যখন শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পীর পুরস্কার নিতে উঠছি, তখন আমার গোঁফের রেখা বেরিয়ে গেছে।

এ বছর হংসরাজের চল্লিশ বছর পূর্তি। সেই উপলক্ষে আমাদের শিল্পীদের একটা গেট টুগেদার ছিল। বসন্ত আর আমাদের মধ্যে নেই। বাকিরা ছিলেন। সেখানে পুরনো কথাগুলো খুব আলোচনা হচ্ছিল। সে দিনের ডনি আজ পুলিশ অফিসার। সামু ইউনিয়ন কার্বাইড-এর বড় অফিসার। আর আমার অভিনয় জীবন এ বছর পঞ্চাশ পার করল।

arindam.ganguly@yahoo.co.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy