Advertisement
১৭ মে ২০২৪

প্রেমের দিন আর শিবপুজোর রাত্রি

দুই উৎসবে নেই কোনও বিরোধিতা। সন্ত ভ্যালেন্টাইনের নামে আপত্তি থাকলে হিন্দুত্ববাদীরা আগামী বুধবারকে মদন-রতি দিবস নামেও ডাকতে পারে। শিবই তো মদনকে ভস্ম করেন এবং পুনর্জন্ম দেন।দুই উৎসবে নেই কোনও বিরোধিতা। সন্ত ভ্যালেন্টাইনের নামে আপত্তি থাকলে হিন্দুত্ববাদীরা আগামী বুধবারকে মদন-রতি দিবস নামেও ডাকতে পারে। শিবই তো মদনকে ভস্ম করেন এবং পুনর্জন্ম দেন।

জহর সরকার
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিই সেই সময়, যখন বসন্ত ইউরোপে পাড়ি দেয়, তুষারকে গিয়ে বলে, এখন তোমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে; আর তার পরেই ফের ভারতে ফিরে আসে সসম্মানে। দু’টো উৎসবেরও মরশুম এটা, খ্রিস্টানদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে আর হিন্দুদের শিবরাত্রি পালিত হয় এই সময়েই। উৎসব দু’টি সাধারণত সতর্ক থাকে যাতে এর সঙ্গে ওর দেখা না হয়ে যায়, কিন্তু এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি— একই দিনে দু’টি উৎসব পড়েছে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা, আর পঞ্জিকামতে রাত্রি ১২।৪২।৩৯ মধ্যে শ্রীশ্রীশিবরাত্রিব্রত ও পূজা।

শিবরাত্রির দিনে হিন্দুরা মুখ্যত উদ্‌যাপন করে থাকেন শিবের বিয়ের উৎসব, কেননা এ দিনেই শিব পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন বলে কথিত। খ্রিস্টান চার্চ কিন্তু মধ্য-ফেব্রুয়ারির ভালবাসার উৎসবটিকে নিয়ে খানিক বিব্রত। প্রাচীন রোমানদের ‘লুপারকালিয়া’ নামের এই উৎসবকে বহু শতাব্দী ধরে গির্জাতন্ত্র দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। রোমানদের ওই উৎসবে নারী-পুরুষের যৌন স্বাধীনতার উদ্‌যাপন হত। দুই লিঙ্গের মানুষের অবাধ মেলামেশা স্বাভাবিক ভাবেই চার্চের চোখে ছিল চরম অনৈতিক। ‘জুনো ফেব্রুয়াটা’, যে দেবীর উদ্দেশে এই ‘প্রেম-জ্বর’ উৎসর্গীকৃত ছিল, চার্চ সেই দেবীকেও অস্বীকার ও বর্জন করে। অবশ্য পুরোপুরি পারেনি। বারবারা ওয়াকার লিখেছেন, ‘চার্চ সেই দেবীর পরিবর্তে নিয়ে এল এক শহিদ পুরুষের মিথ, তিনিই সন্ত ভ্যালেন্টাইন।’ ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় নিয়ে মতান্তর আছে। একটা মত বলে, তিনি ছিলেন এক পবিত্র, সুদর্শন রোমান যুবা, যিনি নিজের প্রিয়তমার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। একটা উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্র কী ভাবে নারী থেকে পুরুষ হয়ে গেল, তা লক্ষ করার মতো বিষয়। সমস্ত ধর্মেরই একটা চড়া দাগের পুরুষতান্ত্রিক রং আছে। তারই প্রভাবে নারী-পুরুষের মানুষী প্রেমের সম্পর্কটিকেও একটু বেশি শ্রদ্ধার, পুজো-পুজো রূপ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত বৈষ্ণব ও উত্তর ভারতের বহু কবির কথা, যাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, রাধা-কৃষ্ণ আসলে বিবাহিত দম্পতি। পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল ধর্মবিশ্বাসগুলির কাছে ‘ভালবাসা’ ব্যাপারটা সব সময়েই সমস্যার, বিশেষ করে যদি সেই ভালবাসা বৈধ বিবাহ, জাতি বা শ্রেণির বাইরে ঘটে যাওয়ার মতো স্পর্ধা দেখায়। দক্ষের যজ্ঞে শিব-পার্বতীর ট্রাজেডি কী করে ভুলি, ভালবেসে বিয়ে করার জন্য তাঁদের কতটা মূল্য চোকাতে হয়েছিল! শিবরাত্রি পালনের প্রথাটি গত দু-তিন শতকে— ব্রিটিশদের হাতে মুসলমান শাসকের পরাজয়ের পরে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার পর— সুদৃঢ় হয়েছে। শিবরাত্রির দর্শনটি এমন: বিয়ে ব্যাপারটা এতই গুরুতর ও জটিল যে এটা বাবা-মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল, তাঁরা দেবদেবী, জাতপাত, কোষ্ঠী ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁদের লক্ষ্মী মেয়েদের জন্য (যারা কিনা পুজো-উপোস ইত্যাদি করে) শিবের মতো বর খুঁজে আনবেন।

একই সঙ্গে আমরা দেখি, ইতিহাস ও কিংবদন্তির হাত ধরে সামাজিক, ভদ্রজনোচিত সম্মানের ধারণা কী ভাবে ভারতে ‘কাম’ ও ‘রতি’-র মতো বেয়াড়া চরিত্রকে এবং ইউরোপে ‘ইরোস’, ‘কিউপিড’, এমনকী ‘প্রায়াপুস’কেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কামদেব যেমন শুধু শিবের সঙ্গেই সম্পর্কিত নন, শিবপুরাণ মতে তাঁর যোগ আছে ব্রহ্মার সঙ্গেও, ব্রহ্মাই তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। ঋগ্বেদ, অথর্ববেদেও কামদেবের উল্লেখ আছে; বিষ্ণুপুরাণ মতে তিনি নারায়ণের অংশ, ভাগবতপুরাণ বলছে তিনি কৃষ্ণের এক রূপ। এ থেকে বোঝা যায়, তাঁর অস্তিত্ব ও প্রতীকবাদকে হিন্দুধর্মের প্রামাণ্য মতবাদগুলিও অস্বীকার করতে পারেনি। যে পুরাণগুলির নাম বললাম, যদি তাদের রচনাকাল দেখি তা হলে দেখা যাবে সেগুলি রচিত হয়েছে আড়াই হাজার বছর ধরে; খেয়াল করলে দেখব, কাম বা মদন নিয়ে চর্চা ভালই ছিল, ইন্দ্র বা বরুণের মতো তিনি হঠাৎ মানুষের পুজোর মঞ্চ থেকে বিদায় নেননি। আর কী আশ্চর্য, সেই সুদর্শন রোমান যুবা যাঁকে খ্রিস্টানরা ‘ভ্যালেন্টাইন’-এর রূপ দিলেন, তাঁরই মতো, কামদেবকেও কল্পনা করা হয়েছে এক রূপবান পুরুষ হিসেবে। তাঁর গাত্রবর্ণ শ্যাম, হাতের ধনুটি তৈরি ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, তাতে মধুকরের আনাগোনা। তাঁর তূণীরে সুরভিত পঞ্চশর, অশোক-মল্লিকার মতো পাঁচ রকমের ফুল দিয়ে বানানো। কোকিল, গুঞ্জরিত অলি, মৃদুমন্দ মলয়পবনের মতো বসন্ত-অনুষঙ্গ সঙ্গে নিয়ে তিনি আসেন। আরও অবাক করা ব্যাপার, হিন্দু ও গ্রিকো-রোমানের মতো বিস্তর দূরত্বের ব্যবধানে থাকা দুই সভ্যতায় ভালবাসার দেবতার প্রতীকটি একই— তিরধনুক। গ্রিকরা প্রেমের দেবতার নাম দিয়েছিল ইরোস, রোমানরা— কিউপিড। বস্তুত, প্রাচীন ইউরোপে কিউপিড আবির্ভূত হয়েছিলেন ডানাওয়ালা এক পুংদণ্ড রূপে, অনেক পরে রেনেসাঁর সময়কার শিল্পভাবনা তাঁকে নতুন এক রূপ দান করে— এক শিশু দেবদূত, ছোট্ট, মিষ্টি তিরধনুক নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় সে। প্রেমের তির-বেঁধা হৃৎপিণ্ড এখন ভালবাসার বিশ্ববিদিত অভিজ্ঞান, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে এই প্রতীক আর ছবি-সম্বলিত কার্ড বিক্রি করে এক-একটি সংস্থা লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করে। ভারতের কথায় ফিরে আসি, ইদানীং দেখতে পাচ্ছি ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে জনবহুল স্থানগুলিতে নারী-পুরুষ যুগলের উপর নজরদারি চালাচ্ছে উগ্র মতাদর্শবাদীরা, যারা নিজেদের ধর্মের শেকড়ই জানে না। দিনটার নাম পালটে ‘কাম-রতি দিবস’ দিলে হয়তো এই দুর্বলমনা মানুষগুলো খানিকটা নরম হবে, কে বলতে পারে!

আমার ধারণা, বৈষ্ণবরা ভালবাসার নানান সংকটের দিক আত্মস্থ করেছিলেন রাধাকৃষ্ণ ও বসন্তের মাদকতাময় হোলি উৎসবের মধ্য দিয়ে, আবার তাঁদের প্রতিযোগী শৈবরা বাসনার বিষয়টি সামলেছিলেন পৌরুষপূর্ণ দেবতা শিবের মধ্য দিয়ে— সেই শিব, যাঁর নিজেরও রসগল্পসম্ভার কম নয়। কিন্তু সমাজ তো শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ, এ সব ছাড়া চলতে পারে না। মনে করা হয়ে থাকে, কামদেবকে শিবের শাস্তিদান আসলে অসংযতদের শিক্ষা দেওয়ারই নামান্তর। মৎস্যপুরাণে আছে ‘মদনভস্ম’ বা ‘কামদহন’-এর আখ্যান, যেখানে গভীর ধ্যানে মগ্ন শিবকে ছলাকলায় প্রলুব্ধ করার অপরাধে শিব কামদেবকে ভস্মীভূত করেন। হিন্দুধর্ম প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ বৈপরীত্যকে বাঁধবার এক প্রয়াস, আর এই আখ্যানও তার ব্যতিক্রম নয়, কারণ কামদেবের ছলাকলা দিয়ে শিবকে ভোলানোর চেষ্টা নাকি আসলে পবিত্র এক কর্তব্য সাধন! অন্য সব দেবতা মিলে যুক্তি করেই তাঁকে শিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যাতে শিব-পার্বতীর মিলন সম্ভব হয়, জন্ম নিতে পারে সুপারহিরো সুপুত্র কার্তিকেয়, এক ও একমাত্র যিনি বধ করতে পারেন ত্রিলোকত্রাস, অজেয় তারকাসুরকে। সুতরাং এক অর্থে কামদহন নয়, শিবরাত্রি নামের ধর্মীয় উৎসব ও তার ব্রত-উপবাস-আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই কামনা-বাসনার বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করা হল। আখ্যানটির পরের পর্বেও বৈপরীত্যের চমক। মদনদেব মৃত, তাঁর স্ত্রী রতি হাহাকার করছেন। তার ফলে আর ফুল ফোটে না, পাখি ডাকে না। নতুন জীবন আসে না। সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে মদনের স্ত্রী রতির অনুরোধে শিব মদনকে পুনরুজ্জীবিত করলেন, তবে কায়াহীন রূপে। তাই কামদেবের আর এক নাম অনঙ্গ বা অতনু। বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে প্রেমের বিচরণ, আবার মানবপ্রকৃতিও কামপ্রভাবে তাড়িত। প্রসঙ্গত, শৈব ধর্ম যখন ভারতের বাইরে প্রচারিত হয়, কামদেব এবং অনেক চমকপ্রদ আখ্যান তার সঙ্গেই রফতানি হয়। জাভার হিন্দুরাও দ্বাদশ শতকে তাঁদের নিজস্ব ‘স্মরদহন’ কাব্যে মদনভস্ম ও তার পুনরুজ্জীবনের ঘটনা উদ্‌যাপন করেন। কাম ও তাঁর সঙ্গিনী রতিকে কাকাউইন কবিতায় ডাকা হয় কামজয় ও কামরতি নামে। পরবর্তী কালে ইন্দোনেশিয়ার ওয়াইয়াং-আখ্যানের পুতুলনাচেও কাম আর রতির সগর্ব সদর্প উপস্থিতি।

গ্রিসেও এক দেবতা পুজো পেতেন শিবের মতোই, শিবলিঙ্গের সমতুল্য প্রতীকে। তিনি ইরোস-এর ভাই, নাম প্রায়াপুস। মনে হয়, প্রায়াপুসের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখনকার তুরস্ক থেকে; রোমান সাম্রাজ্যে তাঁকে ‘বণিকদের দেবতা’ হিসেবেও পুজো করা হত। খ্রিস্টধর্ম সব পেগান দেবদেবীদের সরিয়ে দেওয়ার, বা সন্ত হিসেবে জবরদখল করে নেওয়ার পরেও গ্রামীণ মানুষের মধ্যে এই দেবতাটির পুজোর চল থেকে গিয়েছিল। একই রকমের আরও লিঙ্গ-দেবতার উপস্থিতি পাই গ্রিসের ‘হারমিস’ ও রোমান ‘মিউটুনাস টিউটুনাস’ দেবতার মধ্যে। এঁদের কাজ ছিল বিবাহ-অনুষ্ঠানে সন্তুষ্টিবিধান। তারও আগে, মিশরীয়রা পুজো করতেন ‘আইসিস’ ও ‘মিন’-এর, নরওয়ের মানুষের আরাধ্য ছিলেন দেবতা ‘ফ্রের’। বলকান দেশগুলিতে চালু ছিল ‘কুকেরি’-র আরাধনা, জাপানেও আছে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’-এর মন্দির ও প্রতীকোপাসনা। ওয়ালিস বাজ-এর লেখায় স্পষ্ট পাওয়া যায়, ইউরোপে ‘সপ্তদশ শতক অবধি বিশালাকায় পুং-প্রতীককে সন্ত জ্ঞানে পুজো করা হত।’ তাঁর লেখায় সুদীর্ঘ এক তালিকাও মেলে। স্যর উইলিয়াম হ্যামিলটন আঠারোশো শতকে ‘কসমো’ নামের এক পুংপ্রতীকধর্মী সন্তের পূজনবিধির বর্ণনা দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বোমাবিধ্বস্ত ইংলিশ চার্চগুলি আবার গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন ‘রয়্যাল কমিশন অন হিস্টোরিক্যাল মনুমেন্টস’ মাটির নীচে বহু লিঙ্গমূর্তি খুঁজে পেয়েছিল। তাই শিবরাত্রির দিনে বা শ্রাবণ মাস-ব্যাপী শিব-আরাধনার রকমসকম দেখে ভারতে-আসা ইউরোপীয়রা যে অভিঘাত ও বিস্ময়ে অভিভূত হতেন, তার খুব একটা কারণ আছে বলে মনে হয় না।

প্রাচীন এক সভ্যতার ধারক হিসেবে হিন্দুধর্ম মানুষের সমস্ত রকমের প্রয়োজনের প্রতি দুর্দান্ত সহনশীলতা দেখিয়েছে। এটাই দুঃখের যে আজ এই সহিষ্ণুতার গায়ে আঁচড় পড়ছে। প্রাচীন ভারত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিল। সেই সহিষ্ণুতা আজ কারও কারও পছন্দসই নয়, এটাই দুঃখের। প্রাচীন ভারত জীবনকে ছুপিয়ে নিয়েছিল উৎসবের রঙে, পরিণত মানসিকতায় তার উদ্‌যাপন করেছিল খোলাখুলি, অলজ্জ ভাবে।

ছবি: কুনাল বর্মণ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE