Advertisement
E-Paper

অবাক বিষপান

জলে হাত দেবেন না। আমি চমকে চার পাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে এ কার কণ্ঠস্বর? আবার জলে হাত দিতেই, ফের সতর্কবাণী— জলে হাত দেবেন না। ও জলে বিষ আছে। আমি চিৎকার করে উঠি— কে আপনি? কেনই বা আপনি এই পুকুরের জল খেতে বারণ করছেন? তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

সুমিত তালুকদার

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০০:২৫
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

জলে হাত দেবেন না।

আমি চমকে চার পাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে এ কার কণ্ঠস্বর? আবার জলে হাত দিতেই, ফের সতর্কবাণী— জলে হাত দেবেন না। ও জলে বিষ আছে। আমি চিৎকার করে উঠি— কে আপনি? কেনই বা আপনি এই পুকুরের জল খেতে বারণ করছেন? তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

— সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ গল্পের মতো। তাই না?

— ঠিক তাই। আমি কি পুকুর চুরি করছি? কারও বাঁধা পুকুর? সামান্য জল। তাও পান করতে পারব না? আমি ফের জল খাওয়ার জন্য হাত দিতে যাই পুকুরে। ভাঙা গলায় গর্জে ওঠে পুনরায় সতর্কবাণী— জলে হাত দেবেন না। এই নিয়ে পর পর তিন বার সাবধান করে দিলাম। এ বার আপনার মর্জি, জল পান করবেন কি না। আমিও রেগে গিয়ে জানতে চাই, কিন্তু কেন কেন কেন?

— ও জলে বিষ মেশানো আছে।

— কাছেপিঠে কোনও নোটিস বোর্ডও নেই, যাতে লেখা আছে— বিষাক্ত জল। পান করিবেন না। ফলিডল মেশানো আছে নাকি মশাই?

— এ বিষ তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।

— ধ্যাৎ, ইয়ার্কি মারবেন না। ফলিডলে মাছ মরে শুনেছি। আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ। আমি মরব না।

— তার মানে আপনি আমার নিষেধ শুনবেন না? আমিও নাছোড়বান্দা। সামনে টলটলে নির্মল জল। নোংরা আবর্জনা শ্যাওলা আগাছার লেশমাত্র নেই পুকুরে। তবে কী মরীচিকা? আমি লোকটির সাবধানবাণী উপেক্ষা করে দু’হাত ভরে জল পান করতে যাই। তৃষ্ণায় আমি আর পারছি না। ভাঙা গলায় এ বার তার চূড়ান্ত সতর্কবাণী— আপনি নির্ঘাৎ মরবেন। ঠিক আমার মতো...।

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করি, ঠিক আমার মতো মানে কী? আপনি কি আমায় ভয় দেখাতে চাইছেন? ভয় পাওয়ার বান্দা আমি নই। আমি এক সময় হেড কনস্টেবল ছিলাম। ডান্ডা মেরে তাবড় তাবড় চোর-ডাকাতকে ঠান্ডা করে দিয়েছি। আমি ভয় পাব আপনাকে? সাহস থাকে তো ওই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমার মুখোমুখি হন। দেখি আপনার হিম্মত! আমার নাম হনুমান প্রসাদ...। লোকটা আমার কথায় বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে রসিকতা করে বলে, আপনি হনুমান হন কিংবা জাম্বুবান। এটা আপনার রামরাজত্বও নয়। এটা হল এ যুগের দূষণরাজত্ব। দূষণের দগদগে বিষাক্ত ক্ষতচিহ্ন সারা দেহে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আমার শরীরে মেদ-মজ্জা-মাংস নেই। শুধুই হাড়ের কঙ্কাল। ভূত ভেবে নির্ঘাৎ ভয় পাবেন।

— ওরে বাবা ভূত। কী সাংঘাতিক আপনি মশাই। একটু থেমে তিন বার রামনাম জপ করে বলি, ধ্যাৎ, কেন হেঁয়ালি করছেন। সেই প্রথম থেকে এমন সব ভয় ধরানো কথাবার্তা বলছেন মশাই। পুলিশ কখনও ভূতের ভয় পায়। আমি হেড কনস্টেবল হনুমানপ্রসাদ সেনশর্মা। আমার ডান্ডার ঘায়ে চোর-ডাকাত বাঘে-গরুর মতো এক ঘাটে জল খেত। অথচ আজ আমি সামান্য জলের জন্য ছটফট করছি। একটু জল পাই কোথাই? আপনাদের এই গ্রামে এই পুকুর ছাড়া টিউবওয়েল, মায় একটা কুয়ো পর্যন্ত নেই!

— সব আছে, কিন্তু বিষাক্ত। পানের অযোগ্য। আজ আকাশে বিষ। বাতাসে বিষ। পাতালেও বিষ। আমরা আজ হলাহলপুরীতে বাস করছি। কেউ বাঁচবে না। সবাই আমার মতো...। আমি তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলি, হেঁয়ালি ছেড়ে ঝেড়ে কাশুন তো মশাই। আপনাদের গ্রামের এমন ভয়ঙ্কর দশা হল কী করে?

— আর্সেনিক।

— কী ঘটেছিল!

— বিশ্বাস করুন আর্সেনিক দূষণে আজ আমাদের গ্রামের সমস্ত জলাশয় দূষিত, বিষাক্ত। পানীয় জল বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। জলের আর এক নাম জীবন। কিন্তু এ গাঁয়ে জলের আর এক নাম মরণ। গত বছর ৫ জুন এ গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেছে। শুধু আমি থেকে গেছি যক্ষের মতো এ পুকুর পাহারা দেওয়ার জন্য। সাবধান করে দেওয়ার জন্য, যাতে কেউ ভুল করেও এ পুকুরের জল পান না করে। তা হলে নির্ঘাৎ আমার মতো...।

তার কথা শেষ হয় না। দেখি চার দিক হঠাৎ কালো করে অন্ধকার নেমে আসে। পুকুরটাকে এখন ভয়ঙ্কর কোনও দৈত্য বলে মনে হয়, যেন আমায় গিলে খাবে। পুকুরের ধারের ঝোপটা সামান্য নড়ে ওঠে। মনে হয় আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটা বেরিয়ে এসে স্বমূর্তি ধারণ করবে। কেমন দেখতে? মনে মনে রামনাম জপতে থাকি। এক সময় পুলিশ ছিলাম। ডান্ডা মেরে চোর ডাকাত ঠান্ডা করেছি। এখন চোরের মতো চুপিচুপি পালাতে পারলে বাঁচি। হঠাৎ ভাঙা গলায় লোকটির কঠিন কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, আমাকে দেখবেন না, কেমন দেখতে? আর্সেনিকের শহিদ।

আমি ‘ভূত ভূত’ বলে পড়িমরি করে ছুটতে থাকি। অন্ধকারে এবড়োখেবড়ো মাঠে হঠাৎ কিছুতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। তার পর আর কিছু মনে নেই। মনে হয় জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরতে দেখি একটা চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে শুয়ে আছি। আমায় ঘিরে কতকগুলি উৎসাহী মানুষের মুখ। তাদের মধ্যে এক জন জানতে চায়, ওই ভূতুড়ে গ্রামে কেন গিয়েছিলেন? আমি তাদের কথার সদুত্তর দিতে পারি না। অসহ্য যন্ত্রণায় থুতনি চেপে বিড়বিড় করে বলি, এক গ্লাস জল দেবেন। কাল থেকে এক বিন্দু জলের আশায় ছটফট করছি। লোকটি জবাবে বলে, জল পাবেন কোথায়? এখানকার প্রায় অধিকাংশ গ্রামের জল আর্সেনিক দূষিত। সবাই পালিয়েছে। এই আমরা ক’জন বোতল খেয়ে কোনওক্রমে টিকে আছি। আমি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলাম— বোতল মানে?

— মিনারেল ওয়াটার দাদা। বোতলে মিনারেল ওয়াটার। বাজারে খুব চলছে। খোলো আর ঢালো। আপনি এখন অসুস্থ এবং তৃষ্ণার্ত। আগে এক বোতল গলায় ঢালুন। আমি চাতক পাখির মতো মিনারেল ওয়াটার বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, প্লাস্টিক বোতলে আবার ভূত নেই তো? বোতলবন্দি ভূত।

sumit talukdar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy