Advertisement
২১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৫...

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

পিকনিক পিকনিক পিকনিক। আগের রাত থেকে ঘুম নেই। সেই সকাল ছ’টায় লাক্সারি বাস আমাদের বাড়ির সামনে থেকে নিয়ে যাবে ডায়মন্ড হারবার, সেখান থেকে অল্প দূরেই একটা বাগানবাড়ি। অনেক গাছপালা, বিশাল মাঠ আর বেজায় আনন্দ। অনেকে যাবে, এটুকুই জানতাম।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

পিকনিক পিকনিক পিকনিক। আগের রাত থেকে ঘুম নেই। সেই সকাল ছ’টায় লাক্সারি বাস আমাদের বাড়ির সামনে থেকে নিয়ে যাবে ডায়মন্ড হারবার, সেখান থেকে অল্প দূরেই একটা বাগানবাড়ি। অনেক গাছপালা, বিশাল মাঠ আর বেজায় আনন্দ। অনেকে যাবে, এটুকুই জানতাম। তারা ঠিক কারা আর কী সূত্রে আলাপ, সে সব নিয়ে মাথা খাটানোর চেয়ে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট মাথার কাছে নিয়ে শোয়াটা অনেক বেশি জরুরি মনে হয়েছিল। নিশ্চয়ই অনেক খেলা হবে আর বাসে কমলালেবু আর ডিমসেদ্ধ খাওয়া হবে এ সব ভেবে আমি ছোট্ট ছাগলছানার মতো উত্তেজিত আর শিহরিত। সকালে বাস আসতেই আমি, দিদি, বাবা, মা তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। মনে তো হয়েছিল সবাই খুব ওয়েলকাম করল। দু’একটা পরিবার ছাড়া বিশেষ কাউকে চিনতে পারলাম না। কিন্তু তাতে কী? আমার বয়সি অনেক ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। যেমন হয়, সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল কোন ক্লাস, কোন স্কুল। আলাপ মোটামুটি জমেই গেল বলে মনে হল। এবং ভোরের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই প্যাকেট খুলে কেক, ডিমসেদ্ধ আর কমলালেবু পাওয়া গেল।

বাস থেকে নেমে আমরা ছোটরা প্রথমে কিছুটা এ দিক ও দিক খানিক দৌড়ে নিলাম। মজা হচ্ছে, মজা হচ্ছে ভেবে। তার পর থেকে দেখি স্ক্রিপ্ট বদলাচ্ছে। যার সঙ্গেই খেলতে যাই দেখি পাশ কাটিয়ে যায়। ব্যাডমিন্টন র্যাকেট নিয়ে সঙ্গ দিতে গেলে, সেই দল ছেলেমেয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়, কিংবা বলে: পরে খেলব। অথচ অন্যদের সঙ্গে খুব খেলে আর মজা করে। পড়ে থাকি শুধু আমি আর দিদি। কিছু ক্ষণ বাদে দিদি আমায় বলে, ‘চল, অন্য দিকে যাই। ও দিকটা ঘুরে আসি। এখন খেলতে হবে না।’ আর আমি বলি, ধুর, বড় বড় গাছ আর কত দেখবি, অনেক পুকুর তো দেখেছি। চল না, সবাই খেলছে, আমরাও খেলি। এই বলে জোর করে আবার ‘আমি খেলব’ বলে দলে ভিড়তে আসি। এবং আবারও কেউ আমায় খেলতে নেয় না।

আমি ব্যাপারটা কিছু বুঝতেই পারি না। দুপুরে খাওয়ার ডাক পড়ে। আমাদের পাশে আরও দুজন আমাদের বয়সি ছেলেমেয়ে বসেছে। হঠাত্‌ দেখি অন্য একটা দিদি তাদের ডেকে নিচ্ছে, ‘অ্যাই, এ দিকে বসবি আয়। ওরা বাংলা মিডিয়াম।’ দিদির চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে, মায়ের মুখটা কালো। আর আমি ব্যাটা হতভম্ব বুঝেই উঠতে পারি না, তাতে আমাদের দোষ কী? কেন সে জন্য আমাদের পাশে বসে কেউ খাবে না? খাওয়ার পর দিদি আমায় জোর করে ওর পাশে বসিয়ে রাখে। তত ক্ষণে ইংলিশ মিডিয়াম-বাংলা মিডিয়ামে জাতপাত তফাতটা বুঝতে পারছি। ওরা গোল হয়ে বসে হইহই করে গল্প করছে। আমি কিন্তু ওদের সব গল্প জানি। ওরা টিনটিন বলছে, আমি জানি। ওরা অ্যাসটেরিক্স বলছে, আমি জানি। মাইকেল জ্যাকসন বলছে, তা-ও জানি। কিন্তু আমি ম্লেচ্ছ, আমি বাংলা মিডিয়াম। দিদি আমায় হাত ধরে নিয়ে গেল একটা পুকুরধারে। কিছু ক্ষণ বসে থাকলাম গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে। আমি ফ্যালফ্যাল করে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর নাকটা লাল হয়ে আছে।

সূর্য ডুবে আসছে। মা আমাদের ডাকাডাকি করছে। আমার পাশে পড়ে রয়েছে র‌্যাকেট আর এক্কেবারে নতুন একটা শাট্ল কক।

amisanchari@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE