Advertisement
E-Paper

এভারেস্টের মমি

শেরপারা বললেন, দাবি না মিটলে এ বছর আর এভারেস্টে যাবেন না। তবে পথ দেখাবেন কারা? বছরের পর বছর যাঁদের দেহ বরফে অবিকৃত হয়ে পড়ে আছে, সামিটের পথে? সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়সবুজ বুট’ হল এভারেস্টে ওঠার পথে শেষতম ও নবীনতম পথনির্দেশিকা। শেষতম উচ্চতার কারণে, এভারেস্টে ওঠার উত্তর-পূর্ব পথের শেষ প্রান্তে, প্রায় ৮৫০০ মিটার উঁচুতে এক চুনাপাথরের গুহায় এর অবস্থান। আর নবীনতম, কারণ, ১৯৯৬ সালের আগে এই লাইটহাউসটির পত্তন হয়নি। তার আগে এ রকম পথনির্দেশিকার কথা ভাবাই যায়নি।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

সবুজ বুট’ হল এভারেস্টে ওঠার পথে শেষতম ও নবীনতম পথনির্দেশিকা। শেষতম উচ্চতার কারণে, এভারেস্টে ওঠার উত্তর-পূর্ব পথের শেষ প্রান্তে, প্রায় ৮৫০০ মিটার উঁচুতে এক চুনাপাথরের গুহায় এর অবস্থান। আর নবীনতম, কারণ, ১৯৯৬ সালের আগে এই লাইটহাউসটির পত্তন হয়নি। তার আগে এ রকম পথনির্দেশিকার কথা ভাবাই যায়নি। একটাই কারণ, ১৯৯৬-ই ছিল এভারেস্টের ইতিহাসে চরম বিপর্যয়ের বছর। সব মিলিয়ে ১৫ জন পর্বতারোহী মারা যান সেই বছর। তার মধ্যে মে মাসের ১০-১১ তারিখেই মারা যান আট জন। দক্ষিণ-পূর্বের পথে পাঁচ জন, আর উত্তর-পূর্বে তিন জন।

উত্তর-পূর্বের অভিযানটি ছিল ইন্দো-টিবেটিয়ান বর্ডার-পুলিশের। অভিযানের একদম শেষ পর্যায়ে দলে ছিলেন ছ’জন। চূড়ার একদম কাছাকাছি পৌঁছে দলটি তুষার-ঝড়ের কবলে পড়ে। তিন জন আর না এগিয়ে ফিরে আসেন। বাকি তিন জন, সুবেদার সেওয়ান্ত সামানলা, ল্যান্স নায়েক দোর্জি মোরুপ, হেড কনস্টেব্ল সেওয়াং পালজোর, থামেননি। তার পর ঠিক কী ঘটেছিল সেটা খুব স্পষ্ট নয়। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ রেডিয়ো মারফত ওই তিন জন শৃঙ্গজয়ের খবর জানান। নীচের ক্যাম্পে শুরু হয় উৎসব। ওই তিন জন লাদাখি এভারেস্ট চুড়োয় রেখে আসেন প্রার্থনার পতাকা, ধর্মীয় অনুষঙ্গের ধাতব ফলক। দলনেতা সামানলা উপাসনার কারণে শৃঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ থেকে যান বলে শোনা যায়। সেই ছিল তাঁর শেষ উপাসনা। বাকি দুজন নামতে শুরু করেন নীচে। সাতটা নাগাদ ঝড় তীব্রতর হয়। রেডিয়ো-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাম্প-দলের বাকি সদস্যরা উদ্বিগ্ন চোখে দেখেন দুটি হেডল্যাম্পের আলো। তারা ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসছে। কিছু দূর নামার পর, দূর থেকে তাঁরা দেখেন, উল্কাপতনের মতো একটি আলো গড়িয়ে পড়ে যায়। তার পর তুষার-ঝড়ের মধ্যে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়।

তিন জনের কেউই আর ফিরে আসেননি। ওই একই সময়ে একটি জাপানি দল এভারেস্টে উঠছিল। ওঠার রাস্তায় তাদের সঙ্গে দোর্জির দু’বার দেখা হয়েছিল। এক বার ওঠার সময়। তখন দোর্জির ফ্রস্টবাইট হওয়া হাতে কোনও গ্লাভ্স ছিল না। সেফ্টি ক্লিপ খুলতে অসুবিধে হচ্ছিল। জাপানি দলটি তাঁকে সাহায্য করে সামনে এগিয়ে যায়। সামানলা তত ক্ষণে মারা গেছেন। ওই দলটিই তাঁর দেহ খুঁজে পায় শৃঙ্গের দ্বিতীয় ধাপের কাছাকাছি। ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় বার দেখা হয় দোর্জির। দোর্জি তখনও অতি ধীরে এগোচ্ছিলেন। তিনি নিজে-নিজেই ক্যাম্পে পৌঁছতে পারবেন, এই আশাটুকু রেখে দলটি তাঁকে দ্বিতীয় বারের জন্য টপকে যায়। দোর্জির দেহ অনেক পরে পাওয়া যায় ছয় নম্বর ক্যাম্পের কাছাকাছি।

পালজোরের সঙ্গে জাপানি দলটির দেখা হয়েছে কি না, স্পষ্ট নয়। তবে এক শেরপা জানান, তাঁকে শেষ বারের মতো জীবন্ত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল শৃঙ্গের কাছাকাছি কোনও এক জায়গায়। ক্লান্ত, কাহিল এবং প্রলাপতাড়িত। সঙ্গে নিয়ে আসা যায়নি বলাই বাহুল্য। তার পর কী হয়েছিল জানা নেই। তবে, প্রলাপতাড়িত ও একাকী পালজোর ওই তুষারঝড়ের রাতে সম্ভবত আশ্রয় নিয়েছিলেন ছোট্ট এক চুনাপাথরের গুহায়। শীতে জমে সেই রাতেই তাঁর মৃত্যু নয়। ক্লান্ত মানুষের পাশ ফিরে থাকার এক অতি পরিচিত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে দেখা যায় তাঁর শরীরকে। ওই গুহাতেই। পায়ে ছিল উজ্জ্বল সবুজ রঙের কোফ্ল্যাচ বুট।

এভারেস্টের চুড়ো থেকে নামিয়ে আনা যায়নি পালজোরের শরীর। ওই উচ্চতা থেকে কোনও দেহ নামিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। আজও সেটি ওখানেই আছে, ওই চুনাপাথরের গুহাতেই। ওখানে শরীর পচে না। মানুষ চটপট মারা গেলেও মৃতদেহ প্রায় অবিনশ্বর। এভারেস্ট শৃঙ্গচূড়ার একটু আগে, সবুজ বুট-পরা দিকচিহ্ন হয়ে পালজোর ওখানে আজও পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। অবিকৃত। সবুজ বুট পরা তাঁর দেহটিই, এভারেস্টে ওঠার নবীনতম এবং শেষতম দিকচিহ্ন, যার নাম ‘সবুজ বুট’। উত্তর-পূর্ব পথ ধরে যাওয়া যে-কোনও সফল এভারেস্ট-পথযাত্রীই তাঁকে দেখতে পান। আজও। আর তাঁকে দেখতে পেলেই তাঁরা টের পান, আর একটুখানিই যেতে হবে, তাঁরা পৌঁছে গেছেন এভারেস্টের চুড়োর একদম কাছে, ৮৫০০ মিটার উচ্চতায়।

এভারেস্টে ওঠার পথে ৮০০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় দ্বিতীয় যে মানুষটি নরদেহের আকারে দেখা দিয়ে গেছেন অভিযাত্রীদের, তাঁর নাম ফ্রান্সিস আরসেন্তিয়েভ। তিনিই হলেন প্রথম আমেরিকান মহিলা, যিনি অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়া এভারেস্ট জয় করেন। সেটা ১৯৯৮ সালের ঘটনা। মে মাসের ২২ তারিখে কোনও রকম অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়া ফ্রান্সিস আর তাঁর স্বামী সের্গেই এভারেস্টের চুড়োয় পা রাখেন। দিনের আলো চলে যাওয়ায় সে রাতে তাঁরা আর নামতে পারেননি। এবং কোনও কারণে কোন কারণে, এখন তা আর জানার উপায় নেই দুজনে আলাদা হয়ে যান। সের্গেই ক্যাম্পে ফিরে আসেন পরের দিন সকালে। ফ্রান্সিস ফেরেননি। স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে, অক্সিজেন আর ওষুধ-টষুধ নিয়ে আরেক বার ওই বিপজ্জনক উতরাই ধরেন সের্গেই। কয়েকজন উজবেক অভিযাত্রী এই ফিরতি পথে তাঁকে দেখতে পান। শেষ বারের মতো। স্ত্রীর সঙ্গে সের্গেই-এর আর দেখা হয়েছিল কি না, জানা যায় না।

ফ্রান্সিসের কী হয়েছিল সেটা নানা বর্ণনা থেকে একটু-আধটু জানা যায়। উজবেক অভিযাত্রীরা ২৩ তারিখ ফ্রান্সিসকে প্রায় অর্ধচেতন অবস্থায় দেখতে পান। ফ্রস্টবাইট আর অক্সিজেনের অভাবে চলৎশক্তিরহিত। তাঁরা মহিলাকে সামান্য কিছুটা নীচে নামিয়ে আনেন। কিন্তু নিজেদের ক্লান্তি আর অক্সিজেনের অভাবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ফেলে রেখেই তাঁদের নীচে নেমে আসতে হয়। পর দিন সকালে ব্রিটিশ, দক্ষিণ আফ্রিকান এবং কিছু উজবেক অভিযাত্রী ঠিক ওই একই জায়গায় ফ্রান্সিসকে দেখতে পান। মহিলা তখনও জীবিত। নিজেদের অভিযান বাতিল করে ফ্রান্সিসকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মহাভারতের আমল থেকেই এই মহাপ্রস্থানের উচ্চতায় যে একবার পড়ে যায়, তাকে ফেলেই আসতে হয়। অভিযাত্রীরা নেমে আসেন, আর ফ্রান্সিস ওখানেই মারা যান শীতে জমে। গাইডিং রোপ তখনও কোমরে বাঁধা। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ। সের্গেই-এর তুষার-কুঠার পাওয়া যায় পাশেই। সের্গেইকে পাওয়া যায় না।

এক বছর পরে, এক অভিযানে পাহাড়ের খানিকটা নীচে পাওয়া যাবে সের্গেই-এর দেহ। সম্ভবত স্ত্রীকে উদ্ধার করতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ‘সবুজ জুতো’র মতো, ফ্রান্সিসও প্রকাশ্য রাস্তায়, কোমরে গাইডিং রোপ নিয়ে শুয়ে থাকবেন প্রায় দশ বছর। অভিযাত্রীরা চলাফেরার পথে নিত্য তাঁকে দেখতে পাবেন। নিস্তব্ধ ঐশ্বরিক নিসর্গের মধ্যে ফেলে আসা মানুষকে বারবার দেখা বোধহয় একটু পীড়াদায়ক। তাই ২০০৭ সালে এই অবিনশ্বর দেহকে নামিয়ে আনার জন্য একটি বিশেষ অভিযানের আয়োজন করা হবে, যার নাম ‘তাও অফ এভারেস্ট’। কিন্তু সেখানেও বাদ সাধবে আবহাওয়া। তাই মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরে সামান্য পারলৌকিক অনুষ্ঠানের পর স্রেফ একটু নীচে এনে পাহাড়ের আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হল ফ্রান্সিসের দেহ। এভারেস্টে ওঠার রাস্তায় এখন আর তাই চট করে ফ্রান্সিসের দেখা মেলে না। কিন্তু সের্গেই আর ফ্রান্সিস ওখানেই আছেন, এখনও। একসঙ্গে না হলেও কাছাকাছিই। সেই উচ্চতায়, যেখানে দেহ পচে না।

সবুজ বুটের দিকচিহ্নের পাশে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আর এক দুঃসাহসী। এডমন্ড হিলারির দেশের এক একলা অভিযাত্রী, তাঁর নাম ডেভিড শার্প। কোনও দল, কোনও সাহায্যকারীর সঙ্গ ছাড়াই, নিউজিল্যান্ডের এই তরুণ এভারেস্টে ওঠার চেষ্টা করেন ২০০৬ সালে। সম্পূর্ণ একা একা। তাঁর সঙ্গে কোনও রেডিয়ো ছিল না। সে জন্য তাঁর অভিযানের সম্পূর্ণ কোনও বিবরণও জানা যাবে না। শুধু এইটুকু জানা আছে যে, মে মাসের এক রাতে একলা শার্পকে দেখা যায়, সবুজ বুটের ঠিক পাশে। বিধ্বস্ত ও বিপন্ন। নিউজিল্যান্ডের আর এক অভিযাত্রী মার্ক ইনগ্লিস, যিনি দুটি পঙ্গু পা নিয়ে (অন্য এক দুর্ঘটনায় পা দুটি কেটে বাদ দিতে হয়েছিল) এভারেস্ট অভিযান করেছিলেন, তিনি জানান, সে দিন রাত একটা নাগাদ এভারেস্টে ওঠার পথে তিনি শার্পকে আবিষ্কার করেন। শার্প তখনও বেঁচে। কিন্তু রাতে কোনও রকম সাহায্য করা কঠিন বলে তিনি শার্পকে ফেলে রেখেই শৃঙ্গের দিকে রওনা হন। ইনগ্লিসের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, সে দিন এভারেস্ট থেকে ওঠা ও নামার পথে অন্তত ৪০ জন অভিযাত্রী দলহীন শার্পকে ওই অবস্থায় দেখেন। কিন্তু কেউই সে ভাবে সাহায্য করেননি। অন্য আর এক অভিযাত্রীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, বেশ কিছু ঘণ্টা পরে, এভারেস্ট থেকে নামার পথে তাঁকে কয়েকজন সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন। অক্সিজেন দেওয়া হয়, তুলে দাঁড় করানোরও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কোনও কাজ না হওয়ায় তাঁরা অন্তিম পরিণতির কথা ভেবে কেঁদে ফেলেন। তার পর শার্পকে ওখানেই ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। এর ন’ঘণ্টা পরে এভারেস্ট থেকে নামার পথে এক লেবানিজ অভিযাত্রী তাঁকে আবার দেখতে পান। তখনও শার্পের শরীরে প্রাণ ছিল।

সেই দিন বা পরের দিন ঠান্ডায় জমে গিয়ে শার্প ওখানেই মারা যান। সবুজ বুটের প্রায় গা-ঘেঁষা দূরত্বে পাওয়া যায় প্রায় অবিকৃত, তাঁর জমে যাওয়া মৃতদেহ। শার্পকে সাহায্য না করে শৃঙ্গজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে তীব্র সমালোচনা করেন এডমন্ড হিলারি। ইনগ্লিস বলেন, তিনি দলনেতাকে রেডিয়ো-মেসেজে জানিয়েছিলেন বিপন্ন শার্পের কথা। দলনেতা তাঁকে বলেন, মৃতপ্রায় মানুষটিকে সাহায্য করার কোনও মানেই নেই। যদিও দলনেতা ব্রাইস পরে এই ধরনের কোনও রেডিয়ো-মেসেজের কথা অস্বীকার করেন। ইনগ্লিসও বলেন, তিনি মনে করতে পারেন, কোনও এক মেসেজ করেছিলেন। কিন্তু কাকে করেছিলেন, কী কথা হয়েছিল, এ ব্যাপারে স্মৃতি তঞ্চকতা করতেই পারে। কারণ, ওই উচ্চতায় স্মৃতি ঠিকঠাক কাজ করে না।

উচ্চতা অনেক কিছুকেই বদলে দেয়। ইনগ্লিস এখন পাহাড় থেকে নেমে এসেছেন নীচে, দুনিয়ার নানা জায়গায় মোটিভেশনাল টক দেন। অতীতকে ফেলে এসে, অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে কী করে শৃঙ্গ জয় করতে হয়, সে সব নিয়ে বক্তৃতা দেন দেশে-বিদেশে। পাহাড়ের নিয়ম কিন্তু অন্য রকম। ওখানে শরীর পচে না। ওখানে অতীত জমে থাকে, অবিকৃত। বছরের পর বছর। বহু বছর পর ম্যালরি-কে পাওয়া গেল এই তো সে দিন। যাঁদের এখনও পাওয়া যায়নি, তাঁরাও আছেন, নিঃসন্দেহে দিনের আলোর গভীরে।

এ বছর এভারেস্ট-জয়ের ষাট বছর হল। সেই জয়পতাকা ওড়াবার অনেক আগে থেকেই, বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এভারেস্টে ওঠা অথবা নামার পথে। এঁদের বেশির ভাগেরই শরীর পড়ে আছে পর্বতের কোনও না কোনও খাঁজে। কেউ চোখের সামনে, কেউ চোখের আড়ালে। ফ্রান্সিসের মতো কাউকে টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছুটা আড়ালে। সবুজ বুট-এর মতো অনেকেই শুয়ে আছেন ল্যান্ডমার্ক হয়ে। সকলেই অবশ্য শুয়ে আছেন এমন নয়। এক অভিযাত্রী আধশোয়া অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন, বরফের চাঙড়ে হেলান দিয়ে। কোনও কারণে বরফ সরে গেছে, শক্ত দেহ ঠিক ওই অবস্থাতেই আছে। দেখলে মনে হয়, যে-কোনও মুহূর্তে উঠে পড়তে পারেন। যারা উপর থেকে পড়ে মারা গেছেন, তাঁরা আছেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে, যেন খেলার মাঝে কোনও পোজে ‘ফ্রিজ’ হয়ে গেছেন। কেউ পাশ ফিরে, যেন ঘুমোচ্ছেন, গা থেকে শুধু সরে গেছে কম্বল। কোনও কোনও শরীরের গায়ে স্নেহভরে অভিযাত্রীরা ঢেকে দিয়ে যান বরফ। যেন ভুল করেও না গলে যায়। বিগত এক শতাব্দীতে এভারেস্ট হয়ে উঠেছে এক মৃতের পাহাড়। বছরের পর বছর ধরে দুঃসাহসীরা যে পাহাড় ডিঙিয়ে উঠে যান উপরে, আবার নেমে আসেন শরীরের স্তূপ টপকে।

পাহাড়ে সব কিছুই অন্য রকম। সমতলে আমরা কত কিছুকেই পাশ কাটাই। ট্রেনের জানলা থেকে ছুড়ে ফেলি বাতিল ওয়াটারবট্ল। ট্রাংক থেকে ছুড়ে ফেলি পুরনো বিছানাবালিশ, লুকোনো প্রেমপত্র। আদর করতে গিয়ে ঘাড় মটকে দিই নরম বুলবুলির। চোখের সামনে ট্রেনে-কাটা-পড়া লোকের ছটফটে শরীরকে ছেড়ে রেখে প্রেমিকার হাত ধরে সিধে চলে যাই নন্দন। সে-সব হারিয়ে যায়। সবই চোখের আড়ালে চলে যায় এক দিন। আবার ফুল ফোটে গাছে। আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি দেখা যায় অন্য কারও বাড়ি। গজিয়ে ওঠে স্কাইস্ক্র্যাপার, ধু-ধু মাঠে নতুন রানওয়ে। কিন্তু পাহাড়ে পাশ কাটানো সহজ নয়। এভারেস্টের উচ্চতায় সব কিছুই বদলে যায়। এখানেও অক্সিজেনের অভাব, যুদ্ধজয়ের তাড়া। শৃঙ্গজয়ের তাড়নায় লোকে ফেলে রেখে যায় অচেনাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ফেলে রেখে আসতে হয় সঙ্গীকে। কিন্তু তফাত এই যে, এখানে কেউ হারায় না। এখানে ক্ষত চিরসবুজ। মৃতদেহ চিরভাস্বর। ওঠার রাস্তায় যাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে ছেড়ে এলাম, ফেরার পথে তার সঙ্গে আবার দেখা হবে। ফুল ছিঁড়ে ফেলার যন্ত্রণা থেকে যাবে অক্ষত। সমস্ত ফেলে আসা সঙ্গীরা, চেনা ও অচেনা মানুষরা, ঠিক যে-ভাবে ছেড়ে এসেছিলাম, অবিকল সেই একই ভাবে রক্ষিত হয়ে থাকবে পাহাড়ে, প্রকৃতির মহাফেজখানায়। কী ভাগ্যিস জীবনে এ রকম ঘটে না! ট্রেনে-কাটা-পড়া যে শরীরকে ছেড়ে এসেছিলাম, সে যদি রোজ চলাফেরার রাস্তায় আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে থাকে, গণপিটুনির থ্যাঁতলানো লাশ যদি খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় মর্নিং-ওয়াকে পীড়া দেয়, কী সাংঘাতিক!

bsaikat@gmail.com

everest mummy sherpa rabibasariyo probondho saikat bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy