Advertisement
০৯ মে ২০২৪
দূরত্ব

কুড়িয়ে বাড়িয়ে বার্লিন

১৯৭৬। ব্ল্যাকবোর্ডে গ্রাফ ইক্যুয়েশন অমুক তমুক... এক দিন ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে দিলাম লাফ। উড়তে উড়তে মনে পড়ছিল কী পাগলের মতো প্রেমে পড়েছিলাম ইকনমিক্সের, কিন্তু একঘেয়েমির ধাক্কায় সব প্রেমই যেমন চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়, তেমনই হল। নীচে তাকিয়ে দেখি হাওড়া ব্রিজ, পিলপিল করে চলেছে ট্রাম বাস মানুষ, আরও নীচে বয়ে চলেছে সারাৎসার গঙ্গা।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

১৯৭৬। ব্ল্যাকবোর্ডে গ্রাফ ইক্যুয়েশন অমুক তমুক... এক দিন ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে দিলাম লাফ। উড়তে উড়তে মনে পড়ছিল কী পাগলের মতো প্রেমে পড়েছিলাম ইকনমিক্সের, কিন্তু একঘেয়েমির ধাক্কায় সব প্রেমই যেমন চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়, তেমনই হল। নীচে তাকিয়ে দেখি হাওড়া ব্রিজ, পিলপিল করে চলেছে ট্রাম বাস মানুষ, আরও নীচে বয়ে চলেছে সারাৎসার গঙ্গা।

ইকনমিক্সের মোটা মোটা বইগুলো নিয়ে সোজা কলেজ স্ট্রিট। হুস করে সেগুলো বিক্রি করা হয়ে গেল। হাতে যা এল তাতে কয়েক মাস চলে যাবে, কিছু জমিয়েছিলাম ডকুমেন্টারি করে, একটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড আছে, কয়েক ভরি তো হবেই... তবু একটা চিনচিনে মনখারাপও ছিল। কবিতা, ইকনমিক্স আর সিনেমা— সিনেমাকে ধাওয়া করতে গিয়ে কোনও নারীকেই বলব বলব করে আর বলে উঠতে পারলাম না, ‘ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার’। এখন হাতে রইল পাঁচ নয়, দুই— কবিতা আর সিনেমা। ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া চেনাজানা সব্বাইকে বললাম, মালকড়িওয়ালা কাউকে পাওয়া যাবে? একটা সিনেমা বানাব। ফাটাফাটি একটা গল্প পড়েছি ‘এক্ষণ’-এ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দূরত্ব’। চার-পাঁচ পাতার গল্প, আড়াইখানা চরিত্র আর... কলকাতা।

ছ’মাস কেটে গেল। শ্যুকনো মুখ আরও শ্যুকনো হল, মাথার চুল আরও পড়ে গেল। এক দিন মাঝরাত্রে এলেবেলে পা ফেলে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ ল্যাম্পপোস্ট ঝুঁকে এল কানের কাছে। ফিসফিস করে বলল, সোনার পাথরবাটি না খুঁজে যা আছে তাই দিয়ে শ্যুরু করে দে। কথাটা মনে ধরল। স্ক্রিপ্ট-জাতীয় একটা কিছু লেখাই ছিল, পর দিন থেকে সেটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসলাম। তার পর এক দিন কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পাওয়া গেল, ধারধোর করে যা জোগাড় হল তাই নিয়ে কাজও শ্যুরু হয়ে গেল। সঙ্গে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে সদ্য পাশ-করা ক্যামেরাম্যান রণজিৎ রায় আর এডিটর মৃন্ময় চক্রবর্তী। কারওরই ফুল-লেন্থ ছবি করার অভিজ্ঞতা নেই। লাভলক প্লেস-এ থাকতেন শান্তি চৌধুূরী, ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার আর সত্যজিৎ রায়ের রমরমে বন্ধু। একতলা জুড়ে অফিস, এডিটিং রুম, দু-তিনখানা অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা যার সবগুলোই ভাড়া খাটে। শান্তিদা ছ’টার পর আর চা-কফি খেতেন না, যা খেতেন তাতে হৃদয় ক্রমশই বড় হতে থাকত। সময় বুঝে এক দিন গিয়ে ধরলাম। ক্যামেরা চাই, পয়সা নেই। উনি বললেন, ‘ধুর, পয়সাফয়সা কে চায়! সব ক্যামেরা নিয়ে যাও। ফাটিয়ে দেওয়ার মতো একটা ছবি করো... চলে-টলে?’ তার পর একটু থেমে বললেন, ‘কিছু না খেয়েই মানিক যে কী করে এমন ছবি করে! কত চেষ্টা করলাম কিন্তু... ঋত্বিকটা গুছিয়ে খায়... আজকাল নাকি সকাল থেকেই... অথচ ‘সুবর্ণরেখা’র মতো ক’টা ছবি হয়েছে বলো?’

পর দিন সকালে শান্তিদার ফোন, ‘একদম বিনা পয়সায় পাবে না। কিছু তো দিতেই হবে।’ রফা একটা হল, আর আমি শ্যুটিং শ্যুরু করে দিলাম। রাস্তায়, ঘাটে, অলিতে গলিতে, এর বাড়ি তার বাড়ি, দাদার প্যান্ট, মামার শার্ট, বউয়ের শাড়ি, কানের দুল, টেবিল ল্যাম্প, বিছানার চাদর! রাস্তাঘাটপার্ক তো বাদই দিলাম এমনকী অচেনা ঘরবাড়িসিঁড়িও কোনও পয়সা চায়নি। বাড়িতেই রান্নাবান্না হত, ডিমের ঝোল, ডাল, আলুভাজা। আমার ভগ্নিপতি দুলাল রায় অফিস ছুটি নিয়ে ট্রামে করে লাঞ্চ নিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতেন। মম, মমতাশংকর, মাঝে মাঝে কোকাকোলা খেতে চাইত। আট আনায় এক বোতল, কিন্তু তাতেই দুলালবাবুর মুখ ভরা বর্ষার মেঘ। শ্যুটিং সেরে ভাবতে বসি কাল কার কাছে হাত পাতব, খাওয়ার টাকাটুকু তো লাগবেই।

অসামান্য অভিনয় করেছিল মম। প্রাণ ঢেলে কাজ করেছিল প্রদীপও। মম-র বাবা হয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। একটা এন.জি হলেই বুক ধড়ফড়, তিনটে হলে হৃৎপিণ্ড প্রায় স্তব্ধ হওয়ার জোগাড়। বিজনদা বললেন, ‘ঠিক হচ্ছে তো? কিছু বলবেন?’ ঠিক লাগছিল না এটা ঠিক কিন্তু বিজনদাকে বলার মতো বুকের পাটা আমার ছিল না। পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন, বললেন, ‘বলুন তো কী চাইছেন?’ বলতেই হল।

শ্যুটিং শেষ হল, ডাবিং শেষ হল আর বিজনদাও হঠাৎ চলে গেলেন। রাত জেগে ছবির সঙ্গে সংলাপ মেলানোর কাজ চলছে। আমার ঠাকুরদার বয়সি মুভিওয়ালা মেশিন। আমি বাইরে সিগারেট টানছি, হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে মৃন্ময় এসে পাশে দাঁড়াল, ‘বিজনদার ডায়ালগ ট্র্যাকটা ছিঁড়ে গেল।’ পয়সা নেই তাই প্রিন্ট না করিয়ে সরাসরি সাউন্ড নেগেটিভ নিয়েই ডায়ালগ মেলাচ্ছিলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি ফর্দাফাঁই হয়ে দুমড়ে মুচড়ে মেশিনটার মধ্যে আটকে আছে বিজনদার গলা। আমারও কান্না পাচ্ছিল। অন্য কাউকে দিয়ে ডাব করিয়ে ওই গলা, ওই ভাবে বলা তো আর পাওয়া যাবে না। কান্না থামিয়ে মৃন্ময় আমার নিঃশব্দ মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক কাণ্ড শ্যুরু করল। নেগেটিভের টুকরো একটা একটা করে জুড়ে আবার ট্র্যাকটা তৈরি করল ও। পজিটিভ বের করে দেখলাম, সব ঠিক আছে।

ফাইনাল মিক্সিং শ্যুরু হল। ছবি আর ডায়ালগ ট্র্যাক আছে, বাকি সমস্ত শব্দ সরাসরি টেপরেকর্ডার থেকে যাবে। চিফ রেকর্ডিস্ট শ্যামসুন্দরবাবুর চোখ কপালে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে রাজি করালাম আমরা। দিনের শেষে খুশি হয়ে বললেন, পয়সা নেই তো কী? চলুন এ ভাবেই চালিয়ে দেব। কিন্তু বিধি বাম। পরের দিন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে এন টি ওয়ান-এর হত্তাকত্তা মেহতাজি। বললেন, এ সব চলবে না। সব ট্র্যাক ফিল্মে প্রিন্ট করিয়ে আনুন। নইলে কাজ বন্ধ। এ দিকে ধার দেওয়ার সব লোক শেষ। বাড়িতে আর এক রত্তি সোনাও নেই যে বেচব। তা হলে আর ছবি হল না। আবার ইকনমিক্স-ই পড়াতে হবে... শালা বইগুলোও সব বেচে দিলাম। হঠাৎ দেখি অজয় কর আসছেন। এন টি ওয়ান-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরসদের এক জন। এই ভাবে কাজ হচ্ছে শ্যুনে ওঁর চোখও ছানাবড়া। বললেন, ‘এ ভাবে শেষ করতে পারবেন তো?’ আমি মাথা নাড়লাম, মৃন্ময় মাথা নাড়ল আর মাথা নাড়লেন টেপরেকর্ডার থেকে যিনি এফেক্ট, মিউজিকের আউটপুট দিচ্ছিলেন, তিনি। অজয়বাবু বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি মেহতাকে বলে দিচ্ছি। আপনারা কাজ করুন।’ অসামান্য মানুষ ছিলেন। সেই সময় এ রকম আরও মানুষ ছিলেন যাঁদের সহমর্মিতা না পেলে ‘দূরত্ব’ হতই না, যেমন, চাঁদ, অনিরুদ্ধ লাহিড়ী, ছোটগল্পকার অরূপরতন বসু, বন্ধু আয়ান রশীদ খান। ছবি তো হল কিন্তু মাথার ওপর অনেকটা ঋণের দায়, আর টাকা না মেটালে এন টি ওয়ানও ফিল্ম ছাড়বে না। ফিল্ম-পাগল আয়ান নিয়ে গেল আর এক ফিল্ম-পাগলের কাছে— বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সদ্য মন্ত্রী। শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদ থেকে যে টাকা পেলাম তাতে ধার-দেনা মিটল।

সেটা বোধহয় ইন্ডিয়ান প্যানোরামার প্রথম বছর। ‘দূরত্ব’ দেখানো হচ্ছে দিল্লির মাভলাঙ্কার হল-এ। কী ভাবে যেন অনেক কিছু রটেছে। হঠাৎ দেখি সত্যজিৎ রায় ঢুকছেন। আমি গিয়ে ঠিক ওঁর পিছনের সিটে বসলাম। উনি ছবি দেখছেন আর আমি দেখার চেষ্টা করছি ওঁকে। কে নেই সে দিন হল-এ! দেশি-বিদেশি সমস্ত মানুষ। ছবির শেষে কারও সঙ্গে কথা না বলেই পালিয়ে গেলাম দিল্লির রাস্তায়। রাতে হোটেলে ফিরে এম এস সথ্যু-র সঙ্গে দেখা, বললেন: কোথায় ছিলেন? মানিকদা তো শ্যুধু আপনার কথাই বলে গেলেন, বললেন অসম্ভব পোয়েটিক ফিল্ম। মিডিয়াও ছিল তখন অন্য রকম। মানিকদার অভিব্যক্তি সব কাগজের প্রথম পাতাতেই বেরিয়েছিল। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক চলচ্চিত্র উৎসবের ডিরেক্টররা ‘দূরত্ব’ চাইছেন আর আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মানিকদার কাছে গেলাম, বললেন, ‘বার্লিন ইজ বার্লিন।’ ‘দূরত্ব’ নিয়ে দেশ ও বিদেশ জুড়ে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম তা আমার স্বপ্নের অধিক ছিল। দেশি-বিদেশি বেশ কিছু পুরস্কার জুটল ‘দূরত্ব’র কপালে।

এখনও আয়নার দিকে তাকালে দেখতে পাই সেই পাগল যুবাকে, এখনও আবার ডিমের ঝোল বয়ে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে পারি ইউনিটকে, এখনও ছুঁতে পারি সিনেমার প্রতি সেই তীব্র ভালবাসাকে। এটাই গোপনে লুকিয়ে রাখা নিজের জন্য নিজেকে দেওয়া আমার পুরস্কার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE