Advertisement
১৬ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১

কয়েদিরা

কেউ দশ বছর ধরে জেলের ভিতর, কেউ আরও বেশি। কেউ ‘লাইফার’। কেউ বহু কাল জেলে কাটিয়ে এখন বাইরে। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা। বিকাশ মুখোপাধ্যায়অনুমতি পেতে খুব একটা দেরি হল না। বিশাল ফটকের এক পাশের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকলাম। রাইফেল কাঁধে সান্ত্রি এক রকম অভ্যর্থনাই জানালেন, কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘একে সাহেবের ঘরে নিয়ে যাও।’ তার আগে হাজিরা খাতায় আমার নামধাম ইত্যাদি লেখা সারা।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

অনুমতি পেতে খুব একটা দেরি হল না। বিশাল ফটকের এক পাশের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকলাম। রাইফেল কাঁধে সান্ত্রি এক রকম অভ্যর্থনাই জানালেন, কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘একে সাহেবের ঘরে নিয়ে যাও।’ তার আগে হাজিরা খাতায় আমার নামধাম ইত্যাদি লেখা সারা।

সুবেশ ছেলেটি আমার কাছে এল। ‘চলুন।’ বিশাল ঘরটায় ঢুকলাম। সাহেব আমাকে বসার চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে আর এক জনকে ডাকলেন, ‘এঁর চায়ের স্পেসিফিকেশনটা জেনে নাও।’ ‘বিনা চিনি’ বলতেই ছেলেটি বলল, ‘তা হলে তো নোনতা বিস্কুট।’

সাহেব আরও এক জনকে নাম ধরে ডাকলেন। খুব সুপুরুষ, ঝকঝকে এক যুবক এল। ‘মেলটা চেক করো তো, আর এই মেলটা করো।’ সাহেবের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ছেলেটি দ্রুত কম্পিউটারের কাজ সারল। ‘স্যর, এই দুটো মেল আছে, আর ওটা পাঠিয়ে দিলাম।’ প্রিন্টগুলো স্যরের টেবিলে রেখে দিয়ে সে ঘরের বাইরে চলে গেল।

তত ক্ষণে চা এসে গেছে। সাহেব অর্থাত্‌ জেল সুপার বললেন, ‘আপনি দীর্ঘমেয়াদি কয়েদিদের কথা শুনতে এসেছেন তো? এরা তিন জনই তাই।’

‘আমি ভেবেছিলাম স্টাফ!’

‘এরা সাধারণ স্টাফেদের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী। আর এদের তো বাস ধরার তাড়া নেই।’

জেল সুপারের সঙ্গে সে দিন অনেক কথা বলেছিলাম। সেগুলো মাঝে মাঝে বলব। আর বলব সেই মানুষদের কথা, যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কেউ কেউ বছরের পর বছর এক ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছেন এক জীবনের অনেকটা সময়।

আপন মনে ক্রমাগত কথা বলে যান মহিমা নস্কর। ‘আমার কেসটা কেউ দেখছে না, সই-সাবুদ হয়ে গেল... কোনও খবর নেই, তোমরা কেউ খবর জানো?’ লোয়ার কোর্টে সাজা হয়ে যাওয়ার পর কেসটা এখন হাইকোর্টে। তাঁর আরও আক্ষেপ, ‘ছেলেটার সঙ্গেও দেখা হয় না। একসঙ্গে ধরে নিয়ে এল, একসঙ্গে রাখল না।’ পঞ্চাশ পেরনো মহিমা এক দশকেরও আগে ছেলের সঙ্গেই সাজা পেয়েছিলেন। ছেলে এক জেলে, তিনি অন্যত্র। স্বামী অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে। বাড়ি থেকে দেখতে আসেন শুধু বৃদ্ধা মা। এক ঠোঙা জিলিপি নিয়ে আসেন। জিলিপি খেতে ভীষণ ভালবাসেন মহিমা। তবে সবগুলো একা খান না, সঙ্গীদের দেন। আর আপশোস করেন। ‘ছেলেটাকে যদি হাতে করে দিতে পারতাম।’

বৃদ্ধা মা-র সঙ্গে তারজালের এ দিক থেকে কথা বলার সময় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, মানুষটার (স্বামী) শরীর কী রকম, ছেলে কেমন আছে? প্রথম প্রশ্নের জবাবে, ‘একই রকম’ বললেও, ছেলের কথায় দুজনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তাঁদের চোখে জল দেখে মায়ের পাশে দাঁড়ানো এই লেখকের চোখেও জল আসে। মহিমা জানতে চান, ‘গিছিলে, যারা সই করে নে গেল, তাদের কাছে?’ সই করে নেওয়ার লোকেরা হলেন গরিব কয়েদিদের জন্য কাজ করা ‘লিগাল এড’ কিংবা ‘এনজিও’। মা নির্বাক। ওপর দিকে মুখ তুলে আবার বিড়বিড় করেন মহিমা নস্কর, ‘ভগমান যে কবে চোখ তুলে চাইবেন...কবে যে বাড়ি যাব!’

ভগবানের চোখ তুলে চাইবার ভরসায় অনেক দিন সংশোধনাগারে আছেন কল্পনা বিশ্বাস, মাধবী বৈরাগী কিংবা মালতী মণ্ডল। নিকটজনকে হত্যার আসামি হয়ে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে জেলে ঢুকেছিলেন মালতী। দশ বছর পেরিয়ে গেছে। ছেলে এখন জেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে পড়াশোনা করে। সংশোধনাগার সব সময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রথম যে দিন একটি জেলের সুপারের কাছে গিয়েছিলাম, সে দিন দেখেছিলাম তিনি এক জন ইউ টি (আন্ডার ট্রায়াল)-এর ডব্লুবিসিএস পরীক্ষায় বসার প্রার্থনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ‘রেকমেন্ড’ করে পাঠাচ্ছেন।

সকলেরই একই জিজ্ঞাসা: ‘কবে বাড়ি যাব?’

‘বাড়ি যাব, বাড়ি যাব’ করতে করতেই জেল হাসপাতালের সিঁড়িতে পড়ে মারা গিয়েছিল আমিনা খাতুন। আমিনার দেহটা যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সকলে হাউহাউ করে কেঁদেছিল। অনেক দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে কি নিবিড় আত্মীয়তা হয়ে যায়? হয়তো তাই। তবে অন্য রকম বন্ধুত্বও হয়। যেমন হয়েছিল, দাদুর বাড়ি ডাকাতি করানো কেসের আসামি রিক্তা বসু (পরিবর্তিত নাম) আর বাবার সই জাল করে মেয়াদ খাটতে আসা সন্ধ্যাতারা রায়ের (পরিবর্তিত নাম) মধ্যে। জেলের মধ্যে আলাদা জায়গায় থাকলেও, দুজনে দেখা হলেই আছাড়ি-পিছাড়ি ব্যাপার। সন্ধ্যাতারা যদি কখনও কারও সঙ্গে বেশি কথা বলে ফেলত, দেখলেই রিক্তা তাকে আঁচড়ে-কামড়ে একশা করত। সন্ধ্যাতারার মা মারা গেলে তাকে প্যারোলে যেতে বাধা দিয়েছিল রিক্তা। তাদের যেখানে-সেখানে শারীরিক মেশামেশি আটকাতে অনেক চেষ্টা করেছেন সঙ্গীরা, কিন্তু পারেননি।

প্রথম দিন জেল সুপারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ভেতরের মানুষদের তো যৌন চাহিদা আছে, সেগুলোকে আপনারা কী চোখে দেখেন?’ উনি বলেছিলেন, ‘প্যারোলে পাঠানোর একটা কারণ এটা। পরিবারের সঙ্গে গিয়ে থেকে আসতে পারে। এখানে নিয়ম মেনে থাকলে আমরা প্যারোলে পাঠাই।’

সে দিন রিক্তা-সন্ধ্যা ঘটনা আমার জানা ছিল না, তাই এ ক্ষেত্রে তাঁরা কী করেন সেটা জানতে চাইনি। এখন এরা বাইরে। এদের থেকে কিছু কমবয়সি শিল্পা মান্না সব দিক থেকে আলাদা। গত বছর জেল থেকে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করে মাধ্যমিক পাশ করেছে। কারা-কর্তৃপক্ষ তার ওপর খুবই সহানুভূতিশীল, তাই তার তেমন কোনও সমস্যা নেই। শুধু বয়ফ্রেন্ডের জন্য মন খারাপ। সঙ্গীদের বলে, ‘আমার ফাঁসি, যাবজ্জীবন যা হওয়ার হোক, ও যেন ভাল থাকে।’ সে আদৌ দোষী কি না তার কিন্তু কোনও ঠিক নেই। আচ্ছা, তার বয়ফ্রেন্ড তার সঙ্গে দেখা করতে আসে? কে জানে!

‘কয়েদিরা আপনাদের কাছে দোষ স্বীকার করে?’ প্রশ্ন করেছিলাম উত্তরবঙ্গের এক জেলার সংশোধনাগারের সুপারকে। তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো বলে কখনও। কিন্তু আমরা শুনে কী করব? তা ছাড়া কেউ যখন আমাদের চার দেওয়ালের মধ্যে আসে, আমরা তার ক্রাইমটা দেখি না। তার বিচার সমাজ করবে, কোর্ট করবে, আমরা কে? আমাদের দায়িত্ব দেখভাল করার, যতখানি সুযোগ-সুবিধা আইন অনুযায়ী দেওয়া যায়, দেওয়ার। আর হ্যঁা, সংশোধন করার। তার পর যখন যার মেয়াদ শেষ হওয়ার, হয়ে যাবে।’

‘মেয়াদ শেষে নিজের এলাকায় গিয়ে কী করব? ভদ্দরলোকেরা এড়িয়ে যাবে, দূর থেকে ফিসফিস করে আলোচনা করবে, আর গুন্ডা-বদমাশরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। মার্কামারা হয়ে যাব। তার পর এক দিন এখানে ফিরে আসতে হবে। তার চেয়ে এই বেশ ভাল আছি।’ এক দমে কথাটা বলে যায় শুনু (পরিবর্তিত নাম)। পাশে দাঁড়িয়ে ওর দাদা বলেন, ‘ও এমনই। বেরিয়ে কোথায় যাবে তা হলে?’ ‘তোমাকে তো বলেছি, বেকসুর খালাস হলে বুক ফুলিয়ে যাব।’

‘আচ্ছা, এখানে থাকতে থাকতে কারুর কথা মনে পড়ে তোমার কষ্ট হয়? তুমি তো গ্রামের ছেলে। সেখানকার মানুষজন, পথঘাট, পুকুর, খেলার মাঠ, সে সব কথা মনে হয় না? তুমি তো ভাল ফুটবল খেলতে।’ আমি একদমে বলে যাই।

‘আপনি ওই যে পথঘাটের কথা বললেন না, ওগুলোর কথা একটুও মনে রাখতে চাই না। আমার পথ বলতে জেলের ভেতরের রাস্তা, মানুষজন বলতে যাদের সঙ্গে থাকি। হ্যঁা, এখানেও ফুটবল খেলি।’

বেড়ে যাওয়া শহরে প্রোমোটারের কাছে কাজ করতে এসে জমিদখলের মারামারি খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গারদে ঢোকা শুনু এ বার একটু বিষণ্ণ।

‘শুনেছি, তুমি প্যারোল চাও না?’

‘এখানে যত ক্ষণ সেলে থাকি না, তত ক্ষণ কাজ করি। কাজ করতে আমার ভাল লাগে। তা ছাড়া, সাহেবদের ব্যাভার ভাল। আর প্যারোলে বাড়ি গিয়ে কী করব? বাড়ির অনেকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, বাকিদের খবরও পাই। এমনকী গাই বিয়োলেও খবর পাই। তা হলে বাড়ি যাওয়ার কী দরকার? আশপাশের লোকজন আমাকে চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো দেখবে বলে?’

‘কেউ মারা গেলে?’

‘এখনও অবধি নিজের কেউ যায়নি। জানেন তো, দুলুদা (কল্পিত নাম) বলে এক জন আছে ভেতরে। আপনজন মারা গেলেও প্যারোল চায়নি। বলেছিল, লোকটাই চলে গেল, কাঁধ অবধি দিতে পারলাম না, আর শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে যাব?’

‘বাইরের পৃথিবী কী ভাবে আসে তোমার কাছে? নাকি সে ব্যাপারে কোনও ইন্টারেস্ট নেই?’

‘এখানে টিভি আছে, আমরা সব খবর রাখি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, অনেক অনেক খারাপ লোকেরা বাইরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

‘তার জন্যে রাগ হয়?’

‘রাগ হয়ে কী হবে? আমাদের কাছের লক-আপের ‘লাইফার’ আজাদ (পরিবর্তিত নাম) দিনের বেলায় চুপচাপ থাকে। টিভি দেখে, অনেককে দেখে মাথা ঝোঁকায়। রাত্তিরে সেলে ঢুকলেই আলাদা, অন্য রকম হয়ে যায়। চেঁচায়, গালাগালি দেয়।

‘কাকে দেয়?’

‘যাদের জন্যে ঢুকেছে।’

আজাদ ‘লাইফার’। মানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। প্রথম দিনের আলাপে জেলার সাহেব বলেছিলেন, ‘লাইফার দু’রকমের। একটা মৃত্যু অবধি কারাদণ্ড, আর একটা চোদ্দো বছর পর ‘রিভিউ’। চোদ্দো বছর জেলে থাকার সময় তার ব্যবহার কেমন ছিল তা খতিয়ে দেখা। শুধু তাই নয়, অনেক সম্ভাবনা বিবেচনা করা। সে সব বিচার করেন জেল কর্তৃপক্ষ, সরকারের কমিটি আর ‘লাইফার’-এর এলাকার পুলিশ। ছাড়া পাওয়ার পর ব্যক্তিটি যদি নিজের এলাকায় ফিরে যায়, সেখানে কোনও বড় রকমের ঝামেলা হতে পারে কি না, বদলা নেওয়ার জন্যে কেউ বা কারা অপেক্ষা করে আছে কি না, মূলত সেইগুলো আলোচনা করে নেওয়া হয়। মানুষটাকে সংশোধন করে আমরা তো আর তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না।’

দশ বছর জেলে বিচারাধীন থাকবার পর লোয়ার কোর্টে সদ্য ‘লাইফার’-এর সাজা পাওয়া মধ্য-তিরিশের শুভনারায়ণের সঙ্গে দেখা হয় আর এক সংশোধনাগারে। সশ্রম দণ্ড হিসাবে জেল অফিসের কাজ। যদিও সেটাকে তিনি সাজা বলে মনে করেন না। খুশিমনে সেটা করেন একদা মিষ্টির দোকানের মালিক শুভ। রাজনীতি করতেন, দলের যুবনেতা ছিলেন। যে দিন গ্রেফতার হন, সে দিনই পার্টি বহিষ্কার করে।

‘ছাড়া পেলে আবার রাজনীতি করবেন?’ আমি বলি।

‘হ্যাঁ।’

গ্রেফতার হওয়ার ক’দিন আগে দার্জিলিং থেকে ‘হানিমুন’ করে ফিরেছিলেন। ভালবাসার বিয়ে টিকেছিল মাত্র কয়েক মাস। জেলে থাকার প্রথম দিকেই ডিভোর্স।

‘আপনার খারাপ লাগেনি?’

‘হ্যাঁ। তবে ওকে আমি দোষ দিই না।’

‘এখান থেকে বের হলে আবার বিয়ে করবেন?’

‘না, শুধু মা-বাবার দেখাশোনা করব।’

‘তার কথা ভাবেন?’

‘মোমেন্টগুলোর কথা।’

‘দার্জিলিঙের স্মৃতিগুলো?’

‘সব মিলিয়ে। দোকানের কাজ কম থাকা দুপুরে একটু নির্জন রাস্তায় হাঁটা। কোনও কোনও দিন রেললাইনের ধার দিয়ে দুজনে...ধুস্।’

‘জেলের ভেতরের রাস্তায় হাঁটার সময়, এ সব কথা ভাবেন?’

‘পাশে হেঁটে যাওয়া নিজের ছায়াকে মাঝে মাঝে... ছাড়ুন এ সব কথা।’

‘আর মা, বাবা?’

‘ভাবলেই অসম্ভব কষ্ট হয়। কান্না আসে।’

‘কী করেন তখন? ভগবানকে ডাকেন?’

‘আকাশের দিকে তাকাই। ছোটবেলায় যেমন করতাম, তেমনই। আকাশে মেঘ থাকলে তার মধ্যে বাঘ-সিংহ-কুমির খুঁজি। অন্য সময় অফিসের কাজে আরও বেশি মন ডুবিয়ে দিই। এখানে অফিসের স্যরদের খুব ভাল ব্যবহার। আমার মতো আরও দু-এক জন আছে অফিসে, জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন...’

জেল সুপার বলেছিলেন জেলের মধ্যে কাজে ডুবে থাকার সময় অনেক জায়গা আছে। এখানে হ্যান্ডলুম আছে। জামাপ্যান্ট, কার্পেট, বাসনপত্তর বানানো হয়, মোমবাতি-ফিনাইল ইত্যাদিও নিয়মিত ভাবে তৈরি হয়।

দমদম জেলে এক সময় কম্বল তৈরি হত। তা ছাড়া জেলের বিশাল রান্নাঘর, হাসপাতাল। সে সব জায়গায় যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করেন এই সব মানুষেরাই। সাংস্কৃতিক কাজকর্মও হয়।

তবুও কাজে ডুবে থাকতে থাকতেই কষ্ট হয় বইকী। শুভ আকাশের দিকে তাকান, আজাদ চিত্‌কার করেন আর শুভর সঙ্গে একই জায়গায় থাকা, একদা বাম নেতা বিশ্বজ্যোতি বসু কষ্ট হলে এবং কষ্ট না হলে আবৃত্তি করেন, বই পড়েন। খবরের কাগজে পড়েছিলাম তিনি এখন গীতা পড়ছেন, তাই সেটা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘এখন মন দিয়ে বোদলেয়র পড়ছি।’

‘ফরাসিতে?’

‘আপনিও যেমন। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ। ওঁর মহাভারতও আমি পড়ি।’

‘কেমন আছেন আপনি, ভেতরের এই ক’বছর?’

‘এখানে কোনও অসুবিধা নেই। থাকা-খাওয়া সাধ্যমত চলাফেরা করা সব কিছু ঠিকঠাক এবং সময়মত।’

‘আর?’

‘কোমরে মাঝে মাঝে ভীষণ ব্যথা হয়। ওটা সঙ্গী করেই এখানে ঢুকেছি। তবে বাড়িতে থাকতে ছিল না। ২০০৪-এর এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখে গ্রেফতারের সময় এক আজন্ম বামপন্থী কর্মীকে বামপন্থী সরকারের পুলিশের হ্যঁাচকা টানের ফসল।’

‘বাইরে বেরনোর পর রাজনীতি করবেন?’

‘না।’

‘আপনার মার্ক্স লেনিন...’

‘তাঁরা হৃদয়ে যেখানে আছেন, সেখানে থাকবেন।’

‘টিভি দেখেন?’

‘জেলে সব রকম বন্দোবস্ত আছে।’

‘৩৪ বছর শাসনক্ষমতায় থাকার পর...’

‘শেষ ক’বছর তো পুলিশের স্যালুট আর সুযোগসন্ধানী চামচাদের নিয়ে বসে থাকা, একে যদি শাসন করা বলেন...’

‘২০১১ আর এই ’১৪-তে আপনার কষ্ট হয়নি?’

‘যা পাওনা, তাই পেয়েছে।’

‘আপনার এই অবস্থার জন্যে কাউকে দায়ী করেন?’

‘মানুষই মানুষকে দুঃসময় এনে দেয়/ মানুষই মানুষকে সুসময় এনে দেয়।’ পাবলো নেরুদা’র অনুবাদ আবৃত্তি করেন বিশ্বজ্যোতি।

যে সেলে থাকেন বিশ্ববাবু, সেখানে লোক কম, তেমন হইচই নেই। তবুও মাঝরাতে জেগে উঠে মা, স্ত্রী ও ছেলের কথা ভাবেন।

‘আমার ছেলের ডাকনাম আকাশ। আমি দিয়েছি অয়ন্তন। নামের মানে খুঁজতে যাবেন না। অয়ন্তন আইন পড়ছে... দেখা যাক... আমার মা-টা না বড্ড কষ্ট পাচ্ছে, এক বার আমার বাড়িতে যাবেন আপনি, দেখে আসবেন কেমন বাড়ি আমাদের। আমাকে না ‘চোর’ আর ‘চরিত্রহীন’ বলেছিল। ওই কথা দুটো আমাকে কুরে কুরে খায়।’ প্রত্যয়ী মানুষটিকে এত ক্ষণে বিষণ্ণ লাগে।

সহবাসিন্দা এক জনের কাছে শুনলাম, জেল-রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শঙ্খ ঘোষ আবৃত্তি করেন বিশ্বজ্যোতি। আর সুমনের গান। (এই সাক্ষাত্‌কার নেওয়ার মাসখানেক পর তিনি জামিন পেয়ে গিয়েছেন।)

জেলের গেট থেকে বেরিয়ে আমি ভাবি, অনেক বছর ফাটকের ভেতরে থাকার পর বাইরে আসা কোনও মানুষের সঙ্গে যদি একটু কথা বলা যায়, তা হলে খারাপ হয় না। তাই ১৩ বছর জেলে থাকার পর বেকসুর মুক্তি পাওয়া অপরাজিতা বসুর কাছে যাই। মুনমুন নামেই তিনি বেশি পরিচিত।

‘প্রথম দিন সংশোধনাগারের ভেতরে ঢোকাটা মনে করতে পারেন?’

‘ভোলে নাকি কেউ। এক সেলে একা। তার আগে সেলটা মোটু মা পরিষ্কার করে দিয়েছিল।’

‘মোটু মা?’

‘রীতা মণ্ডল। তখন ফাঁসির আসামি ছিলেন, পরে যাবজ্জীবন হয়। সেলে ঢোকার আগে সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি খুলে দিতে হয়েছিল। সেটাই নিয়ম। দড়ি বাঁধা কিছু পরা থাকবে না। বাড়ি থেকে রাত্রিবাস নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটাই পরনে। বাইরে গার্ড মীরাদি, নামটা পরে জেনেছিলাম, এ দিক থেকে ও দিক করছেন। ভেতরে টিমটিমে আলো, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ‘রাজর্ষি’ খুলে সারারাত বসে ছিলাম।’

‘জেলের মধ্যের বাথরুম?’

‘তখন বিচ্ছিরি ছিল, এখন ঠিকঠাক, তার ওপর টাইল্স লাগানো।’

‘আচ্ছা, সব মিলিয়ে ও রকম একটা পরিবেশে ঢুকে দম আটকে যেত না?’

‘প্রথম প্রথম ভাবতাম ছাড়া পেয়ে যাব। তার পর ২০০৩-এর ১৮ সেপ্টেম্বর আলিপুর স্পেশাল কোর্টে সাজা শোনার পর ভেঙে পড়ি।’ আর আস্তে আস্তে বাইরের পৃথিবীটা আমার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। এক বার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। যা হোক, জেল হাসপাতালে কাজ করতে করতে ধাতস্থ হই। পরে নাটক করেছি, নাচ শিখিয়েছি, ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়িয়েছি।

‘ছোট ছোট বাচ্চা।’

‘বেশির ভাগ বাংলাদেশিদের। বহু বাংলাদেশি সাজা পেয়ে ভেতরে আছে। তা ছাড়া মাদক চোরাচালানি, মেয়ে পাচারকারী এ সব।’

‘সকলে একসঙ্গে থাকতেন?’

‘হ্যাঁ, তবে যে যার মতো।’

‘আচ্ছা, ছাড়া পাওয়ার পর বাইরের লোকজন আপনাকে কী ভাবে গ্রহণ করেছে?’

‘বছর চোদ্দো পরে ছাড়া পেলেও বেকসুর শুনে পাড়ার লোকেরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন।’

‘এখন কী করছেন?’

‘এনজিও-র কাজ। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলেন, সুপ্রিম কোর্টেও আমার বিরুদ্ধে আপিল খারিজ হওয়ার পরও কিন্তু কোথাও গেলে প্রথমে সেই এক প্রশ্ন আপনার কেসটা তো ওই ছিল...তাই না...’

কৃতজ্ঞতা: ঈশিতা চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খশুভ্র দাশগুপ্ত।

mallikabikash@yahoo.co.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE