Advertisement
E-Paper

খুদ কুঁড়ো

তারা ছিল বর-বউ। কিন্তু তারা যে বর-বউ, এটা তারা নিজেরাই জানত না। রাখালের বয়স সাত-আট আর পুতুলের চার-পাঁচ। আমাদের মস্ত উঠোনে প্রায় রোজই সাত-আট জন বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলতে আসত। ছোটাছুটি, ছোঁয়াছঁুয়ি, চোর-চোর, এক্কা-দোক্কা বা যা হোক কিছু।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুমিত্র বসাক।

ছবি: সুমিত্র বসাক।

তারা ছিল বর-বউ। কিন্তু তারা যে বর-বউ, এটা তারা নিজেরাই জানত না। রাখালের বয়স সাত-আট আর পুতুলের চার-পাঁচ।

আমাদের মস্ত উঠোনে প্রায় রোজই সাত-আট জন বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলতে আসত। ছোটাছুটি, ছোঁয়াছঁুয়ি, চোর-চোর, এক্কা-দোক্কা বা যা হোক কিছু। দাদু কাছারিতে বেরিয়ে যাওয়ার পরে তারা আসত। কারণ দাদু ছিলেন রাশভারী মানুষ, হই-হট্টগোল পছন্দ করতেন না।

ময়মনসিংহে তখন মাঠঘাটের অভাব ছিল না। তবু বাচ্চারা যে আমাদের উঠোনে বা বারবাড়িতে খেলতে আসত তার একটা কারণ ছিল। ঠাকুমা প্রায় রোজই বাচ্চাদের ডেকে বাতাসা বা মুড়ির মোয়া, নাড়ু, ফলের টুকরো, কিংবা কাঁঠালপাতায় চাল-কলামাখা ছোট দলা দিতেন। ওই বয়সে তখন ওই সব খাবার ছিল যেন অমৃত।

আমাদের বাড়ির পিছন দিকে, পগার পাড়ে পাশাপাশি দুটি দীনহীন ঘরে দুটি পরিবার থাকত। পুতুলের বাবা ভট্চায বামুন, আর রাখালরা বাঁড়ুজ্যে। দুটি পরিবারে খুব ভাবসাব। পালে-পার্বণে, দোল- দুর্গোত্‌সবে তারা আমাদের বাড়ি আসত। কত কাজ করে দিয়ে যেত।

রাখালের হিরো ছিল সাইকেল মিস্তিরি মিজানুর। বড় রাস্তায় ললিতের মুদিখানার পাশেই তার সাইকেল সারাইয়ের চালাঘর। রাখাল ফাঁক পেলেই সেইখানে গিয়ে মন দিয়ে টিউবের লিক সারানো থেকে শুরু করে সব কিছু দেখত। জিজ্ঞেস করলেই বলত, বড় হয়ে সে সাইকেলের মিস্তিরি হবে। একটা ভারী ছোটখাটো স্কুলে সে পড়ত। বইখাতা জুটত না বলে এর-ওর-তার বাড়িতে গিয়ে পড়ে আসত।

পুতুল দেখতেও যেন পুতুল। টুলটুলে মুখ, ফরসা রং, কোঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ ছিল আর অবাক চাউনি।

রাখাল আর পুতুল যে বর-বউ, তা আমরা জানতাম না। ওরাও জানত না। দঙ্গলের মধ্যে দুজনেই খেলতে আসত আমাদের উঠোনে।

ফিসফাস একটু ছিলই। জানাজানি হতে আরও একটু সময় লেগেছিল। তবে খবর ছড়িয়ে পড়াতে খুব একটা হইচই পড়ে যায়নি। ছিছিক্কারও নয়।

রাখালকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, হ্যঁা রে, পুতুল কি তোর বউ? রাখাল ঠোঁট উলটে বলত, দূর, ও তো ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে! পুতুলকে জিজ্ঞেস করলে পুতুল একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকত, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারত না। কিন্তু বুঝুক না বুঝুক, পুতুল রাখালের ফাইফরমাশ খাটত সারা দিন। আর যেখানে রাখাল সেখানেই পুতুল। রাখাল মাছ ধরছে তো পাশে খালুই নিয়ে বসে আছে পুতুল। রাখাল নারকোল পাড়তে গাছে উঠেছে তো নীচে নারকোল কুড়োতে পুতুল মোতায়েন। রাখাল ঘুড়ি বানাতে বসল তো আঠার ভাঁড় নিয়ে সেখানে পুতুল মজুত। রাখালের জ্বর হল তো শিয়রে বসে পুতুল। ওই বয়সেও কিছু না বুঝেও কি কিছু বুঝতে পারত পুতুল? নইলে ওই আনুগত্য কেন?

এ দুটি ছোট্ট বর-বউকে নিয়ে পাড়ায় ঠাট্টা-মশকরাই হত। আবার অনেকে মুগ্ধ হয়ে দেখত।

কী হত কে জানে? লায়লা-মজনু, রোমিয়ো-জুলিয়েট কত প্রেমের গল্পই তো আমরা জানি। কিন্তু আড়ে আড়ে ঝড়-তুফান থাকে, বাধাবিপত্তি আসে।

এক দিন রাত পোহাতেই সেই মহাসংকট এসে দরজায় দাঁড়াল। অবিশ্বাস্য, বাক্রোধকারী সেই সংকট, পার্টিশন, দেশভাগ! কী যে তোলপাড় হুলস্থুল পড়ে গেল তা বলার নয়। তখন কে কাকে দেখে, কে কাকে সামলায়, কে কার খোঁজ রাখে! চার দিকে পালাই-পালাই রব।

কে কোথায় ছিটকে গেল কে জানে! আমাদের একান্নবর্তী এককাট্টা পরিবারটাই তো চার ভাগে ভাগ হয়ে চার জায়গায় ছত্রখান হয়ে পড়ল। সেই ডামাডোলে রাখাল বা পুতুলের কথা মনে থাকার ব্যাপারই তো নয়।

প্রায় পঁচিশ বছর পর বনগাঁয়ে একটা সভা করতে গিয়ে বৈকুণ্ঠ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। সভা থেকেই ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। ছোট পাকা বাড়ি। সেই আগের দারিদ্র নেই, আবার বড়লোকও হয়ে যাননি। দুই ছেলে চাকরি করে। ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পুতুলের বিয়ে হয়নি। যখন দেশ ছেড়েছিলেন তাঁরা তখন পুতুলের বয়স ছিল আট-নয় বছর। এখন তেত্রিশ-চৌত্রিশ। রং তত ফরসা নেই আর, তবে মুখে লাবণ্যটুকু আছে। সেই বড় বড় চোখ, একটা স্কুলে পড়ায়।

কাকা, পুতুলের বিয়ে দেননি কেন?

কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, কী করে দিই? নিজে মন্ত্রপাঠ করে এক বার দিয়েছিলাম। ধর্মভ্রষ্ট হব না? তবু হয়তো চাপে পড়ে দিতাম। কিন্তু পুতুলই রাজি নয়। রাখালদের অনেক খোঁজ করেছি। পাইনি। এক জন বলল, ওরা কানপুরে চলে গেছে। কানপুর তো অনেক দূরের পাল্লা। কী করি বল তো?

কানপুরে গিয়ে খোঁজা সহজ ছিল না, তবে আমি নরেশজ্যাঠার শরণাপন্ন হই। নরেশজ্যাঠা একমাত্র দেশের লোকের খোঁজখবর রাখতেন, শুনেই বললেন, রাখাল? আরে রাখাল না, অর আসল নাম মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি, হ্যায় তো এখন তালেবর লোক, আইএএস অফিসার, দিল্লিতে পোস্টেড।

মৃগাঙ্কর নাগাল পাওয়া শক্ত হল না, একটু তত্‌পরতার পর ট্রাঙ্ক কল করে তাকে ধরলাম। প্রথমে ফোন ধরল তার সেক্রেটারি, তার পর রাখাল।

রুনুদা, আপনি?

কেমন আছিস?

ভাল আছি দাদা।

বিয়ে করেছিস?

হ্যাঁ তো, দুটো ছেলেও হয়েছে।

একটু ধানাই পানাই করার পর জিজ্ঞেস করি, হ্যঁা রে, পুতুলকে তোর মনে আছে?

থাকবে না? কী যে বলেন! ক্যাম্পে ক্যাম্পে কত খঁুজেছি তাকে! তার পর বড়মামার কাছে কানপুরে চলে গেলাম, আর খোঁজ পেলাম না। আপনি কি তার কোনও খবর জানেন দাদা?

না রে। কে কোথায় ছিটকে গেছে।

যদি খবর পান আমাকে জানাবেন?

জানাব।

পৃথিবীর সব ঘটনাই যদি আমাদের মনের মতো করে শেষ হত, তা হলে জীবনটা ঠিক যাপনযোগ্য হত না। তাই পুতুলকে রাখালের বা রাখালকে পুতুলের খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই।

sirshendu_m@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy