Advertisement
E-Paper

চেনা গল্প অচেনা মোচড়

কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই বিজয়ার অফিসে চলে গিয়েছিল নরেন। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা তো ওকে হাঁকিয়েই দিচ্ছিল প্রায়। বার বার একই কথা, ম্যাডাম জরুরি মিটিঙে আছেন। ভাগ্যিস রিসেপশনের সামনে নলিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! নলিনীর মামা দয়ালবাবুর অপারেশন করেছিল নরেন। নলিনী তখন রোজই প্রায় তার ক্লিনিকে আসত। সেই সময়ই আলাপ। বিজয়ার কথাও ও তখনই শুনেছিল। বিজয়া রায়। রে কেমিকালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকালস-এর নতুন মালকিন। দয়ালবাবু তো এই কোম্পানিরই চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই বিজয়ার অফিসে চলে গিয়েছিল নরেন। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা তো ওকে হাঁকিয়েই দিচ্ছিল প্রায়। বার বার একই কথা, ম্যাডাম জরুরি মিটিঙে আছেন। ভাগ্যিস রিসেপশনের সামনে নলিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! নলিনীর মামা দয়ালবাবুর অপারেশন করেছিল নরেন। নলিনী তখন রোজই প্রায় তার ক্লিনিকে আসত। সেই সময়ই আলাপ। বিজয়ার কথাও ও তখনই শুনেছিল। বিজয়া রায়। রে কেমিকালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকালস-এর নতুন মালকিন। দয়ালবাবু তো এই কোম্পানিরই চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বিজয়ার বাবার আমল থেকেই আছেন। নলিনী বলেছিল, দয়ালবাবুর চিকিত্‌সার সমস্ত খরচ কোম্পানি দিচ্ছে। বিজয়ার স্পেশাল অর্ডারে। নইলে বিলাসবাবু তো দয়ালকে ভিআরএস-ই ধরিয়ে দিত!

বিলাসবাবু, মানে বিলাসবিহারী। কোম্পানির এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। বিলাসের বাবা রাসবিহারীবাবুর অবশ্য এই কোম্পানিতে স্টেটাসটা ঠিক কী, তা নলিনী পুরোটা জানে না। তবে দয়ালবাবু অসুস্থ হওয়ার পর বিজয়া যখন নলিনীকে তার পার্সোনাল সেক্রেটারির চাকরিটা দিল, তাতে নাকি রাসবিহারীবাবুর বেজায় আপত্তি ছিল। রাসবিহারীর অনেক পরামর্শই নলিনীকে শুনে চলতে হয়। তার কারণ শুধু এই নয় যে, রাসবিহারীদের সলিসিটর ফার্ম দু-পুরুষ ধরে এই কোম্পানির মামলা-মোকদ্দমার ঝক্কি সামলাচ্ছে! আসলে বিজয়ার বাবা বনমালী আর রাসবিহারী ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন। অফিসে কান পাতলে শোনা যায়, রাসবিহারী না থাকলে বনমালীর ব্যবসা এত বড় হত না। তা ছাড়া কোম্পানিতে নাকি রাসবিহারীর মোটা শেয়ারও আছে, এবং বিলাসের সঙ্গে বিজয়ার বিয়েটা হয়ে গেলেই গোটা কোম্পানিই রাসবিহারীর মুঠোয় চলে আসবে।

বিলাসের মতো ও রকম একটা গোমড়ামুখো, বেরসিক, গোঁয়ারগোবিন্দ লোককে বিজয়া ম্যাডাম সহ্য করেন কী করে, নলিনী ভেবে পায় না। মনে তো হয় উনি বিলাসবাবুকে পছন্দই করেন! দুজনে একসঙ্গে মাঝেমধ্যে অফিস থেকে বেরিয়েও যান! সে দিন নরেনবাবু যখন এলেন, তখনও বিলাসই তো ম্যাডামের চেম্বারে ছিল। কিন্তু নরেন ডাক্তার কেন বিজয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য এতটা ব্যস্ত হয়ে উঠল, নলিনী সেটা জানতে পারেনি। সে এটাও জানত না, প্রেসিডেন্সিতে বনমালী, রাসবিহারীদের আর বন্ধু ছিলেন জগদীশ। ওদের মতো বড়লোক নন। তবে কেমিস্ট্রির দুরন্ত ছাত্র। চাইলেই বিদেশ যেতে পারতেন। কিন্তু বনমালীর অনুরোধে রে কেমিকালস-এর আর অ্যান্ড ডি-র দায়িত্ব নেন। কোম্পানির সবচেয়ে চালু তিনটে প্রোডাক্ট জগদীশেরই মগজের দান। অনেক বড় বড় কোম্পানির অফার ছিল, কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে জগদীশ যাননি। বনমালী বলেছিলেন, প্রোডাক্ট-পেটেন্ট তাঁর নামে লিখে দিলে জগদীশকে পার্টনার করবেন। করেননি। উলটে রাসবিহারীর উকিলি বুদ্ধির চালে তাঁকে চোর বদনাম নিয়ে কোম্পানি এবং শহর ছাড়তে হয়েছিল। জগদীশের তখন স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলেটা খুব ছোট। তাঁরা কোথায় গেলেন, কী হল, কেউ খবর রাখেনি। রাসবিহারী কানাঘুষো শুনেছিলেন, সেই ছেলে নাকি বিলেত থেকে ডাক্তারির মস্ত মস্ত ডিগ্রি নিয়ে এই কলকাতাতেই ফিরেছে!

‘কোম্পানির টাকা মেরে পালানো’ বাবার সেই ‘চোর-বৈজ্ঞানিক’ বন্ধুর কথা বিজয়াও শুনেছিল। গঙ্গার ধারে একটা রিসর্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিজয়া যখন সেই গল্প নরেনকে শোনাচ্ছিল, তখন বাতাসে ওড়া তার খোলা চুল আলতো ঝাপটা দিচ্ছিল নরেনের চোখেমুখে। আচ্ছা, বিজয়া চুলে কী হেয়ার-স্প্রে দেয়? কী মিষ্টি গন্ধটা! নরেন হাত বাড়িয়ে বিজয়াকে অনেকটা কাছে টেনে নেয়। ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে লম্বা চুমু খায়। সে দিন দুপুরে রিসর্টের বিছানায় নরেনের বুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, ওর এক দিনের দাড়ি না-কামানো গালে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বিজয়া আদুরে গলায় বলছিল, ‘মাল্টিস্পেশালিটি ক্লিনিক দুটোর জমি কেনার পুরো টাকাটা আমি তোমার অ্যাকাউন্টেই ট্রান্সফার করে দিচ্ছি সোনা! আর তুমি যে পুরনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারটা টেকওভার করেছ, ওটাও আমরা কিনে নিচ্ছি! যন্ত্রপাতিগুলো তো ভালই আছে বললে!’ বিজয়াকে এক ঝটকায় চুমু খায় নরেন ‘বিলাসবাবু পুরোটা জানেন তো?’ ‘বিলাস এখানে কী করবে?’ বিজয়ার গলায় তাচ্ছিল্য! ‘আমাদের এই নতুন হসপিটাল বিজনেস-ভেঞ্চার পুরোটা দেখবে তুমি। তোমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস আর কাকে করব!’ বিজয়া নরেনের গালে ছোট্ট কামড় দেয়!

মাস তিনেক পরে ‘বনমালী রায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এর শুভ উদ্বোধনের দুদিন আগে রাসবিহারী ফোন করে জানালেন, নরেনকে কিছুতেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না! নলিনী ক’দিন ছুটি নিয়েছে। অগত্যা বিলাসকে নিয়েই ছুটল বিজয়া। সেন্টারটা ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সিকিয়োরিটি গার্ড চাবি খুলে দিয়ে জানাল, হপ্তাখানেক আগে ‘ডাক্তারবাবু’ নিলাম ডেকে সমস্ত যন্ত্রপাতি, ফার্নিচার বেচে দিয়ে গেছেন। বিজয়া ওই ফাঁকা ঘরের ধুলোর মেঝেয় বসে পড়ছিল, বিলাস ধরে ফেলল। বিজয়া বিলাসের বিশাল কাঁধে মাথা রাখে। ফেরার রাস্তায় বিজয়ার চোখের জলে বিলাসের শার্টের হাতা ভিজে গেল! আরও ক’দিন পর, ক্যুরিয়ারে একটা চিঠি এল বিজয়ার নামে। নরেন লিখেছে: আমি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে গেলুম। নলিনীও আছে আমার সঙ্গে। কাউকে বিশ্বাস করে ঠকতে কেমন লাগে, এটা বোধহয় রে কেমিকালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকালস-এর জানা দরকার ছিল।

পুনশ্চ: আমার বাবার নাম জগদীশ মুখোপাধ্যায়। তুমি আমার পাসপোর্টে দেখেছিলে। খেয়াল করোনি। বিলাসবাবুকে বিয়ে কোরো। ঠকবে না!

sanajkol@gmail.com

santanu chakraborty rabibasariya golpo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy