Advertisement
১১ মে ২০২৪

জা স্ট যা চ্ছি

থেমে আছে তো আছেই। অনেক ক্ষণ ধরে। অথচ এই রাস্তায় কেউ থামতে চায় না। হর্ন বাজিয়ে, ইঞ্জিনের আর্তনাদকে পাত্তা না দিয়ে, কোনও দিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো পেরিয়ে যেতে চায়। কখনও কোথাও কিছু হলে, গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টের মতো, হুড়মুড় করে সব গাড়ি, সব বাস এসে পড়ে সেখানে। তার পর দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। নিরুত্তাপ অসহিষ্ণুতায় সবাই অপেক্ষা করে সিটে বসে। কিছু ক্ষণ পরে সেটা সয়ে যায়। তখন চোখ পড়ে আশেপাশে।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৪
Share: Save:

থেমে আছে তো আছেই। অনেক ক্ষণ ধরে। অথচ এই রাস্তায় কেউ থামতে চায় না। হর্ন বাজিয়ে, ইঞ্জিনের আর্তনাদকে পাত্তা না দিয়ে, কোনও দিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো পেরিয়ে যেতে চায়। কখনও কোথাও কিছু হলে, গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টের মতো, হুড়মুড় করে সব গাড়ি, সব বাস এসে পড়ে সেখানে। তার পর দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। নিরুত্তাপ অসহিষ্ণুতায় সবাই অপেক্ষা করে সিটে বসে। কিছু ক্ষণ পরে সেটা সয়ে যায়। তখন চোখ পড়ে আশেপাশে। এই যেমন আমি দেখতে পাচ্ছি অনেক দূর অবধি মরা সবুজের জমি। ওখান থেকে তাজা কপি তুলে ভ্যান-রিকশা’য় চড়িয়ে রাস্তা পারাপার চলছে। যে দিকে যাচ্ছে সে দিকে কংক্রিটের ধুলো ভরা এবড়োখেবড়ো জমির ওপর চড়চড় করে বেড়ে উঠছে নিষ্প্রাণ বাক্স-বাড়ি। লোহার তৈরি ভারা জড়িয়ে আছে তাদের গায়ে। ছাদে জিরাফের মতো ক্রেনের গলা ঝুঁকে দেখছে কতটা নীচে বাকি সব কিছু। এই বাড়িগুলোর সব ঘর বিক্রি হয়ে যাবে। হয়তো গেছেও, তৈরি হওয়ার অনেক আগে। শুনেছি, সব ঘরে গৃহপ্রবেশ হয় না।

এত ক্ষণ একটা গুরগুরে কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম, এ বার সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তার মানে বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে। প্রচুর গাড়ির ছাদের সারি কিছুটা লাইনে, কিছুটা বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে আছে সামনে, যতটা দেখতে পাচ্ছি। লালও নয়, সবুজও নয়, ঘাবড়ে গিয়ে ট্র্যাফিক লাইটটা হলুদ হয়ে চমকে চমকে উঠছে একটু দূরে। তারও পরে, বাঁকের মুখটায় কী হচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। নেমে পড়লাম বাইপাসে। কোথাও বিশেষ যাওয়ার ছিল না আমার। পেরোতে হয়, তাই সবার মতো আমিও পেরোচ্ছিলাম এই লম্বা রাস্তাটা। একটু হাঁটতেই খেয়াল হল, মেলা বসেছে। ভালই হল।

হাতে গড়া নানা রকম জিনিস নিয়ে লোকজন এসেছে সব রাজ্য থেকে। অনেকের জায়গা হয়েছে বড় ঘরে, জেলার নাম লেখা আছে তাতে। বেশির ভাগ খোলা আকাশের নীচে, জাস্ট বসে পড়েছে। সব মিলিয়ে হাতে তৈরি শিল্পের বাগান যেন, তার মধ্যে দিয়ে দিব্যি প্ল্যানহীন রাস্তা, অলিগলি তৈরি হয়েছে, হেলেদুলে যাতায়াত করছে সবাই। আমি ছাড়া প্রায় সকলেই আগ্রহ নিয়ে কিছু না কিছু খুঁজছে। কেউ কেউ কিনছেও। ঘর সাজানোর জিনিসই বেশি। খেলনাও আছে নানা রকম। খেলনা কোনও কাজে আসে না আমাদের, যাদের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু কিনতে ইচ্ছে করে। ভেজাল নেই ধরে নিয়ে একবাক্স পাটালি কিনলাম আমি, রেখে দিলাম ঝোলা ব্যাগে। খাবার জিনিসও শিল্প, ভেবে মহা আনন্দ হল।

বিকেলের রোদটা নরম হয়েছে, পড়েছে শ’য়ে শ’য়ে নানা রঙের বড় বড় চোখে তাকানো রং-করা প্যঁাচাদের মুখে। দিনাজপুরের মুখোশ, বাঁকুড়ার ঘোড়াদের গায়ে। কলপটা বোধহয় পুরনো হয়েছে, খেয়াল নেই অস্বাভাবিক কালো চুলের গোড়ায় শনের মতো সাদা বেরিয়ে পড়েছে, এমন এক জন উবু হয়ে বসেছেন, দর করছেন বড় মাটির জালার। সাদা রং করা, গায়ে একটু অপটু হাতে তুলি দিয়ে ফাটলের আভাস আঁকা আছে, যেন মার্বেলের তৈরি। তর্জনগর্জন কানে এল, ‘ইটালিয়ান মার্বেলের চেয়েও বেশি দাম চাইছ তো, দেড়শো লাস্ট দিচ্ছি।’ যার জিনিস সে অসহায় ভাবে এ দিক ও দিক দেখছে, কিছু বলছে না। বাজে মাটির মাল বেচছ, এত দাম চাইলে হবে? ভাবলাম বলি, আপনারই বা এত কীসের আঠা? বললাম না, অন্য দিকে এগোলাম। ব্যাগ থেকে এক টুকরো পাটালি ভেঙে মুখে পুরলাম।

ধানের শীষ, মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি গয়না দেখলাম অকারণে। দোকানিরা আমাকে গুরুত্ব দিল না, মোবাইলে কথা বলতে লাগল। এর পরে অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঠের, বেতের চেয়ার, সোফা রয়েছে দেখে এগোলাম। কেউ কেউ বসে দেখছে, গদি নেই যদিও। সুযোগ বুঝে আমিও সিংহাসনের মতো বড় চেয়ারে বসে মিছিমিছি পরখ করতে লাগলাম। খচমচ আওয়াজ হল। দামও জিজ্ঞেস করলাম। দোকানি বলল, ভাল মোড়া নেবেন? আমি উঠলাম না, উত্তরও দিলাম না। হাতলে হাত রেখে দেখলাম কেমন লাগে। এই যে বেশ বসে আছি, কিচ্ছু করার নেই, ভাবার নেই, আশেপাশে কিচ্ছুই ঘটছে না, ঘটবেও না, একজোড়া বাবা-মা পপকর্ন কিনছে, বাচ্চাকে দেয়নি, সে চেঁচামেচি করছে, এক সায়েব রঙিন ড্রাই ফ্লাওয়ারের ফাঁক দিয়ে একটু দূরের ঘোমটা দেওয়া গ্রামের মহিলার ছবি তুলছে এই সব দেখত দেখতে নজর পড়ল অন্য আর এক দিকে। উঠে পড়লাম। ওটা আমি অনেক দিন ধরে খুঁজছি। আমাদের ছোটবেলার জিনিস, পাওয়া যাচ্ছে তা হলে।

ক্যালাইডোস্কোপ। কার্ডবোর্ডের টিউবের মধ্যে তিনখানা লম্বা কাচ আর কিছু ভাঙা রঙিন চুড়ির টুকরো। চোখে লাগিয়ে ঘোরালেই খুরখুর করে আওয়াজ আর নিত্যনতুন নকশা, প্রত্যেক বার আলাদা আলাদা। এক জন, বয়স হয়েছে, এক হাতের লাঠিতে ভর দিয়েছেন। অন্য হাতে চোখে লাগিয়ে বার বার ঘুরিয়ে দেখছেন। আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে খালি চোখে দূরে তাকাচ্ছেন। অদ্ভুত লাগল। চার পাশে রঙিন দৃশ্য, মানুষজনের ঘোরাফেরা, জীবনের নানা আর্টিস্টিক জিনিসপত্রের বন্যা বইছে। আর খেলনা দূরবিনের গোল স্ক্রিনে নিজের হাতে তৈরি অথচ নিয়ন্ত্রণহীন বদলে যাওয়া নকশা। দুইয়ের মধ্যে কোনও মিল পাচ্ছেন কি উনি? পেতেই পারেন, অনেক দিন ধরে দেখছেন দুনিয়াটা। কাছে যেতেই, যেন অনেক দিনের চেনা, এমন ভাবেই আমাকে বললেন, ‘আমার কাছে কার্ল জাইস-এর একটা বাইনোকুলার আছে, আগে দেখতাম খুব, চোখটা যাওয়ার পর আর কাজে আসে না ওটা দেব আপনাকে। কিন্তু এটা বড় ভাল, সব বেশ দেখতে পাচ্ছি, আগে যা দেখতাম, একেবারে সেই সব।’ উনি নিশ্চয়ই ওঁর শৈশবে ফিরে গেছেন, অল্প সময়ের জন্য, খেয়ালই নেই কাকে কী বলছেন।

ওঁর দেখাদেখি আমিও চেয়ে নিলাম একটা, চোখে লাগিয়ে ঘোরাতে লাগলাম, আকাশের দিকে মুখ তুলে। সেখানে শুধু বিকেল ফুরোনোর ধূসর রং। ওঁর মতোই চোখ সরাতে লাগলাম মাঝে মাঝে। খালি চোখে ঝলমলে মেলার সীমানা পেরিয়ে চোখে পড়তে লাগল বিশাল বাড়ির খাঁচাগুলো। তার নীচে এখনও ট্র্যাফিক জ্যাম হয়ে আছে কি না কে জানে। ফের চোখ লাগালাম কাচে। একটার পর একটা নকশা উঠছে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ভাবতে দোষ নেই কোনও, এক দিন হেলিকপ্টারের দাম পড়ে যাবে, কিনব তখন। উড়ে যাব ওই ক্রেনটার কাছে। তার আগে অবশ্য মেলাটাও কিনে ফেলতে হবে, সবটা। আর্টিস্টরা আসবে। লোকজনও আসবে, কিন্তু সব ফ্রি। যার যা খুশি নেবে। বাচ্চা পপকর্ন পাবে। মোড়ার বদলে সিংহাসনে বসতে কোনও বাধা থাকবে না। যদিও জানি, এমন হলে, এতই মজা হবে যে কেউ কোনওটাই বেছে উঠতে পারবে না। দাম দর ফুরিয়ে গেলে দোকানি, খদ্দের সবাই হাসতে থাকবে সারা ক্ষণ। আর আমি একা এক বার বাইনোকুলার আর এক বার ক্যালাইডোস্কোপ চোখে লাগিয়ে দেখব নীচে, এই সব দারুণ ব্যাপারস্যাপার। সব পেয়েছি, সব দিয়েছির দুনিয়ায় আমিও নিশ্চিন্ত থাকব। আর পাটালির টুকরো মুখে পুরব মাঝে মাঝে।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhamoy maitra anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE