Advertisement
২১ মে ২০২৪

নক্ষত্র রায়ের ম্যাজিক

টুবলু ইস্কুলে সব সাবজেক্টেই ভাল নম্বর পায়, একমাত্র অঙ্ক ছাড়া। এই বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না তার। পাশও করে কোনও রকমে। আর, বাবা-মা’র কাছে বকুনি খায়। বাড়িতে যিনি টুবলুকে পড়াতে আসেন, তিনি খুব ভাল অঙ্ক জানেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সকলেই অঙ্কে আশির ঘরে নম্বর পায়, কিন্তু হলে কী হবে, এই সাবজেক্টটায় টুবলু কিছুতেই সড়গড় হতে পারছে না। টুবলুর এখন ক্লাস সেভেন। বাবা বলছিলেন, এখন থেকে যদি অঙ্কে ভাল নম্বর না পাস, সায়েন্স নিয়ে পড়বি কী করে!

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

জয় সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

টুবলু ইস্কুলে সব সাবজেক্টেই ভাল নম্বর পায়, একমাত্র অঙ্ক ছাড়া। এই বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না তার। পাশও করে কোনও রকমে। আর, বাবা-মা’র কাছে বকুনি খায়। বাড়িতে যিনি টুবলুকে পড়াতে আসেন, তিনি খুব ভাল অঙ্ক জানেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সকলেই অঙ্কে আশির ঘরে নম্বর পায়, কিন্তু হলে কী হবে, এই সাবজেক্টটায় টুবলু কিছুতেই সড়গড় হতে পারছে না। টুবলুর এখন ক্লাস সেভেন। বাবা বলছিলেন, এখন থেকে যদি অঙ্কে ভাল নম্বর না পাস, সায়েন্স নিয়ে পড়বি কী করে! টুবলু মনে মনে ভাবে, সায়েন্স নিয়ে কি সকলকে পড়তেই হবে? সে যদি আর্টস নিয়ে পড়ে, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে! অন্যান্য সাবজেক্টে সে তো বেশ ভাল নম্বরই পায়। কিন্তু বাবা তা বুঝলে তো!

ক’দিন হল টুবলুদের বাড়ির একতলায় এক জন নতুন ভাড়াটে এসেছেন। সঙ্গে একগাদা বই। ভদ্রলোক একাই থাকবেন। বাবা বলছিলেন, উনি নাকি কলকাতার একটা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ফিজিক্স পড়ান। এখন গবেষণা করছেন। নিজের বাড়িতে লোকজনের ভিড়ে অসুবিধে হচ্ছে, তাই কলেজ ছুটি নিয়ে এই আধা মফস্সলে এসে কিছু দিন নিরিবিলিতে গবেষণা করতে চান।

সে দিন ভদ্রলোক টুবলুদের বাড়ি এসেছিলেন, বাবার কাছে কী একটা দরকারে। ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। টুবলু মা’র কাছে শুনেছে ওঁর নাম, নক্ষত্র রায়। খুব মিশুকে ভদ্রলোক। সোফায় বসেই টুবলুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন দুটো টিনটিনের বই। বললেন, ‘এই নাও। তুমি তো টিনটিনের বইয়ের খুব ভক্ত। এ দুটো ছাড়া টিনটিনের সব বই-ই তো পড়ে ফেলেছ।’

টুবলু অবাক হয়ে গেল। টিনটিনের সব বই-ই প্রায় ওর পড়া হয়ে গিয়েছে, শুধু এই দুটোই বাকি ছিল। কিন্তু নক্ষত্রকাকু কী করে জানলেন? টুবলু বলল, ‘আমি টিনটিনের ভক্ত কী করে জানলেন, কাকু?’

‘হুঁ-হুঁ, আমি সব জানতে পারি’, নক্ষত্র রায় মুচকি হাসলেন।

বাবাকে ভাড়ার অগ্রিম টাকা দিলেন তিনি। তার পর চা-টা খেয়ে কিছু ক্ষণ গল্প করলেন বাবার সঙ্গে।

টুবলু অঙ্কে দুর্বল শুনে নক্ষত্রকাকু বললেন, ‘তুমি এই রবিবার আমার কাছে এসো, তোমাকে অঙ্ক শেখাব’, তার পর টুবলুর বাবাকে বললেন, ‘ওকে আমি অঙ্কে একেবারে তুখোড় করে দেব, দেখবেন।’

রবিবার সন্ধেবেলা অঙ্কের বই আর খাতা নিয়ে নক্ষত্র রায়ের কাছে গেল টুবলু। নক্ষত্রকাকু তাকে কয়েকটা অঙ্ক কষতে দিলেন। অনেক ক্ষণ ধরে টুবলু করল সেগুলো। দুটো ভুল। একটা ঠিক।

নক্ষত্রকাকু ভাল করে দেখলেন অঙ্কগুলো। তার পর বললেন, ‘এ দুটো ভুল করলে কেন? পাটিগণিতের খুব সহজ অঙ্ক দিয়েছিলাম তোমাকে।’

টুবলু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘কী ভাবে করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কাকু।’

‘ঠিক আছে, আমি একটা ম্যাজিক করে দেব। দেখবে, এর পর থেকে আর অঙ্ক ভুল হবে না। পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি সব কিছুতে তুমি একশোয় নব্বই-পঁচানব্বই পাবে’, নক্ষত্রকাকু হাসলেন।

টুবলু অবাক হল। বলল, ‘ম্যাজিক করে?’

‘হ্যাঁ, তবে কথাটা বলতে পারবে না কাউকে। এমনকী, বাবা-মাকেও নয়।’

‘ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু কী ম্যাজিক?’

‘দেখাচ্ছি। তুমি চোখ বুজে দাঁড়াও।’

টুবলু চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। নক্ষত্রকাকু তাঁর মাথার উপর হাত রাখলেন। দু’তিন সেকেন্ড পরই কী রকম একটা শক খাওয়ার মতো অনুভূতি হল টুবলুর। সারা শরীরে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল যেন। চমকে গিয়ে এক বার চোখ খুলেই আবার বন্ধ করল। দেখল, নক্ষত্রকাকু তার মাথায় হাত রেখে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।

মিনিট দুয়েক পর নক্ষত্রকাকু বললেন, এ বার চোখ খোলো, টুবলু।

টুবলু চোখ খুলল। কী রকম যেন ঝিমঝিম করছিল শরীরটা।

নক্ষত্রকাকু বললেন, ‘এ বার থেকে আর অঙ্কে ভুল হবে না তোমার। সব অঙ্কের সমাধান জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

‘এটাই ম্যাজিক?’ টুবলু বলল।

‘হ্যা।ঁ এ বার বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে অঙ্ক নিয়ে বোসো। দেখো, কী রকম সহজে করে ফেলতে পারছ সব অঙ্ক’, নক্ষত্রকাকু হাসলেন।

‘আমি এখানে বসেই ক’টা অঙ্ক করি না, কাকু’, টুবলু বলল।

‘না, আমার হাতে আর সময় নেই। আমাকে এখনই চলে যেতে হবে।’ নক্ষত্রকাকুকে একটু বিমর্ষ দেখাল।

টুবলু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘চলে যেতে হবে! কোথায় চলে যেতে হবে, কাকু?’

নক্ষত্রকাকু একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন টুবলুর দিকে। তার পর বললেন, ‘আমার ডাক এসে গিয়েছে, টুবলু। তোমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে।’

‘পৃথিবী ছেড়ে মানে?’ নক্ষত্রকাকুর কথা কী রকম হেঁয়ালির মতো লাগল টুবলুর।

‘আমি এই পৃথিবীর কেউ নই, টুবলু। এখান থেকে অনেক অনেক দূরের এক গ্রহ থেকে আমি এসেছি। একটা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। হঠাৎই খুব আর্জেন্ট মেসেজ এসেছে আমার কাছে। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহাকাশযানও চলে এসেছে ইতিমধ্যে।’

টুবলুর কী রকম যেন ধাঁধা লেগে গেল। সে শুনেছে, বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু চোখের সামনে যাঁকে সে দেখছে, তিনি কি সত্যিই অন্য গ্রহের জীব?

নক্ষত্রকাকু বোধ হয় বুঝতে পারলেন তার কথা। বললেন, ‘ঠিক বিশ্বাস করতে পারছ না, তাই না? সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার যে চেহারাটা তোমরা দেখছ, সেটা আমার আসল চেহারা নয়। আসল চেহারাটা তোমার দেখতে ভাল লাগবে না। শোনো টুবলু, তোমাদের পৃথিবীর চেয়ে আমাদের গ্রহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কয়েক হাজার গুণ এগিয়ে আছে। আমরা ইচ্ছেমতো নিজেদের চেহারা পরিবর্তন করতে পারি। মানুষের মনের কথাও বুঝতে পারি।’

মানুষের মনের কথা জানতে পারেন নক্ষত্রকাকু, তাই তিনি জানতে পেরেছিলেন টিনটিনের বইয়ের কথা! ভাবল টুবলু।

‘কিন্তু তখন যে ম্যাজিকটা করলেন, সেটা কী, বললেন না তো?’ টুবলু বলল।

‘আমাদের জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা সবই তোমাদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। আমার সেই জ্ঞান, বিদ্যার সামান্য একটু অংশ তোমার মস্তিষ্কে প্রবাহিত করে দিয়েছি।

এ বার তুমি অঙ্কে দুর্দান্ত ফল করবে। শুধু অঙ্কে নয়, সব সাবজেক্টেই দারুণ নম্বর পাবে। এ বার এসো আমার সঙ্গে।’

টুবলুদের বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা। সেখানে বাগান করেছেন টুবলুর বাবা। বাইরে বেরিয়ে টুবলুকে নিয়ে সে দিকে এগোলেন নক্ষত্রকাকু। কিছুটা এগিয়ে টুবলু দেখল, বাগানের এক কোণে অন্ধকারে গোল চাকতির মতো একটা বস্তু। নক্ষত্রকাকু বললেন, ‘এটাই আমাদের যান।’

টুবলুর মনে পড়ল কল্পবিজ্ঞানের বইয়ে এ রকম ফ্লাইং সসার বা উড়ন্ত চাকির ছবি দেখেছে সে। নক্ষত্রকাকু বললেন, ‘তুমি এখানেই দাঁড়াও টুবলু, আর এগিয়ো না। আমি এ বার এই যানটায় উঠে পড়ব’, তার পর টুবলুর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোমার মঙ্গল হোক।’

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন নক্ষত্রকাকু। যানটার দরজা নিজে-নিজে খুলে গেল। নক্ষত্রকাকু উঠে পড়লেন যানটায়। তার পর টুবলুর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হেসে বললেন, ‘চললাম, টুবলু।’

দরজা বন্ধ হয়ে গেল ফ্লাইং সসারের। তার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা নিঃশব্দে উঠে গেল আকাশে। টুবলু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে দিকে।

কিছু ক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল টুবলু, তার পর ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। আজ পর্যন্ত কাউকে এ ঘটনা বলেনি সে। তবে হ্যাঁ, এ বারে ক্লাসের পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিল টুবলু। আর অঙ্কে পেয়েছিল একশোর মধ্যে পঁচানব্বই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

joy sengupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE