Advertisement
E-Paper

বড় হওয়া

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ছোটবেলায় এক বার নাকি মা’র কোলে চেপে পুরীতে এসেছিল টুকরি। স্বর্গদ্বারের হোটেলে ছিল। সে সব কিচ্ছু মনে নেই, কিন্তু এ বারের বেড়ানোটা থাকবে। কারণ, এখন ক্লাস সিক্স। বড় হয়ে গেছে। বাবার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ছবি তুলতে পারে সে। সূর্য ওঠার ছবিও।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছোটবেলায় এক বার নাকি মা’র কোলে চেপে পুরীতে এসেছিল টুকরি। স্বর্গদ্বারের হোটেলে ছিল। সে সব কিচ্ছু মনে নেই, কিন্তু এ বারের বেড়ানোটা থাকবে। কারণ, এখন ক্লাস সিক্স। বড় হয়ে গেছে। বাবার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ছবি তুলতে পারে সে। সূর্য ওঠার ছবিও। সমুদ্রের তীরে বসে সব তুলে রাখছে টুকরি। প্রকৃতি, প্রতীতি আর অনুষ্কাকে দেখাতে হবে তো! কিন্তু ঢেউয়ের এই দম ফুরিয়ে ফেনা তুলে বালিতে শুয়ে পড়া, ছবিতে ঠিকঠাক উঠলই না! ঢেউগুলো যেন ক্লাস থ্রি-তে পড়া রুমনির মতো হঠাত্‌ কোত্থেকে হাঁপাতে-হাঁপাতে ছুটে এসে টুকরিকে ছুঁয়েই দৌড় মারছে। এইটা কি ছবিতে ওঠে? এ সব গল্প ওদের মুখে বলতে হবে। বাতাসের সোঁ-সোঁ আওয়াজটাও নকল করে দেখাতে হবে ওদের। একটু পরেই মন্দিরে যাওয়া। সেই গল্পটাও মনে রাখা দরকার।

আর একটা গল্পও অবিশ্যি বলতে হবে। গত কাল বাবা-মা-টুকরি, শোভেনকাকু-নতুনকাকিমা-রুমনি এই ছ’জন মিলে একটা বড় গাড়ি চেপে গিয়েছিল রঘুরাজপুর। খুব বেশিক্ষণ তো লাগল না পুরী থেকে। টুকরি মোবাইল দেখে বুঝেছিল, বাইশ মিনিট। পথে যেতে যেতে বাবা জানিয়েছিল, এই গ্রামে থাকেন শিল্পীরা। কেউ নাচ শেখান, কেউ ছবি আঁকেন, আবার কেউ করেন হাতের কাজ। ঘরে বসেই ওরা এই সব করেন। যারা গ্রামে বেড়াতে যায়, তাদের অনেকে কেনে।

নতুনকাকিমা ছবি কিনল। টুকরির চেনা চেনা লাগে। সে এ বার পারুলপিসির সঙ্গে রথ টেনেছে। সেই রথের ভেতর অনেকটা এই রকম দেখতে মাটির মূর্তিই রেখেছিল পিসি। মা টুকরি আর রুমনির দিকে তাকিয়ে বলল, এ হল জগন্নাথদেবের ছবি। টুকরি মাথা নেড়ে বলতে গেল, হ্যাঁ জানি তো, কিন্তু তার আগেই রুমনি গলা ছেড়েছে, জগনদেব কে? নতুনকাকিমা হেসে বলল, ঠাকুর, নমো করতে হয়। রুমনি চোখ বন্ধ করে নমস্কার করল। বাবা বলল, চল এ বার গটিপুয়া নাচ দেখা যাক। ভাগ্যিস বাবা বলেছিল। ওই গ্রামে সব থেকে যা ভাল লেগেছে টুকরির তা হল এই নাচ। এক জনের বাড়ির হলঘরে বসল ওরা সবাই। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে কাঁচাপাকা চুলের এক জন বসলেন হারমোনিয়ামের সামনে। অন্য জনের হাতে কি ঢোল? বাবা বলল, না না পাখোয়াজ। এই কথাটা নতুন। তাই টুকরি তখনই মনে মনে তিন বার উচ্চারণটা ঠিক করে নিল। বন্ধুদের বলতে হবে তো! ভুল বললে তো হবে না। আরও দু’জন কাকু এল। এক জনের হাতে বাঁশি, অন্য জনের হাতে বাবা যা বাজায়, সেই বেহালা। বাজনা শুরু হতেই ছ’জন ছুটে এল। ওরা টুকরির থেকে কিছু লম্বা। আঁট-শাঁট করে শাড়ি পরা, মাথা গলা হাতে নানান গয়না। গানের সুরে-তালে ওরা নাচতে শুরু করল। বাবা বলল, জানিস তো শোভেন এই বাচ্চাগুলো সবাই ছেলে, মেয়ের পোশাকে নাচে। নতুনকাকিমা তো অবাক। মা বলল, সত্যি, একেবারে বোঝা যাচ্ছে না। টুকরিও কম অবাক হয়নি। বাবা বলল, এরা খুব ছোটবেলা থেকে গুরুর কাছে থেকে নাচ শেখে।

ওরা নাচছিল। হঠাত্‌ দু’জন মাথা পিছনে ঝুঁকিয়ে হাত দিয়ে মাটি ছুঁয়ে ফেলল। বাবা নিজের মনেই ঠোঁট নাড়ল, বাঃ কী সুন্দর আর্চ! টুকরির দিকে ফিরে বলল, বাংলায় একে বলে অর্ধ চক্রাসন। দু’জন মাথা নিচু, পা উপরে করে হাতের ভরে হাঁটতে হাঁটতে দু’দিক থেকে এসে পায়ের ভর রাখল অর্ধ চক্রাসনে থাকা দু’জনের পাঁজরে। বাকি দু’জনের এক জন টুকুস করে উঠে পড়ল ওদের উপর। সেও অর্ধ চক্রাসন করল মাটিতে ওই ভাবে থাকা দু’জনের পেটে! শেষের ছেলেটি উঠে পড়ল তার পেটে। কৃষ্ণের বাঁশি বাজাবার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে গেল। কী হাততালি! এই সব গল্প তো বলতেই হবে বন্ধুদের।

পুরীর মন্দিরের ভেতরে কী ভিড়! অনেকেই বাংলায় কথা বলছে। শ্যামসুন্দর পাণ্ডা বলে এক কাকু সামনের লোকজন ঠেলে সরিয়ে ওদের সবাইকে নিয়ে হাজির করল জগন্নাথদেবের সামনে! টুকরি ভাল দেখতে পাচ্ছিল না। বাবা তাকে কোলে নিয়ে নিল রুমনিকে নিয়েছে নতুন কাকিমা।

জগন্নাথদেবের কী বড় মূর্তি! মুখে-গায়ে যেন কেউ বেশ করে কালো রং মাখিয়েছে। চোখ দুটো বড়। কালো মণি, তাকে ঘিরে সাদা আর লালা দুই বৃত্ত। লাল ঠোঁটে হাসি। হাতে তালু নেই, আঙুলও নেই। পাশের মূর্তি দু’টিকেও টুকরি চেনে। পারুলপিসি বলেছিল। বোন সুভদ্রা আর দাদা বলরাম। ওদের গায়ে অবিশ্য কালো রং নেই।

নতুনকাকিমা বলল, সবাই নমো কর। সবাই নমস্কার করছে। রুমনি, শোভেনকাকু, মা, বাবা সবাই। আশপাশের লোকজনের কেউ কেউ মূর্তির দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে বিড়বিড় করে কী সব বলছে! টুকরি কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। বাবা ফিসফিস করে বলল, টুকরি নমস্কার কর। মা বলল, প্রার্থনা কর, ঠাকুর যেন পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল হয়। যেন শরীর ভাল থাকে। এই বার টুকরি বুঝল। আশপাশের লোকজনও তা হলে ঠোঁট নেড়ে কিংবা মনে মনে এই রকমই কিছু না কিছু চাইছে। সবাই বলছে ঠাকুর আমার ভাল করো। এই দাও-দাও শুনতে শুনতে ঠাকুরের মাথা ব্যথা করবে যে! কিন্তু বাবা-মা বলছে যখন...। টুকরি চোখ বন্ধ করে নমস্কার করল ঠাকুরকে। প্রার্থনাও করল।

ধাক্কাধাক্কি করে মন্দির থেকে কোনও রকমে বের হয়ে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়াল সবাই। বাবার কোল থেকে নেমে পড়ল টুকরি। রুমনিও নেমেছে। শ্যামকাকু বলল, কে কে পুজো দেবেন? শোভেনকাকু বলল, আমরা। মা বলল, আমরাও। শোভেনকাকু বাবাকে বলল, ইন্দ্র, তুই এদের কাছে থাক, আমি পাণ্ডার সঙ্গে গিয়ে সবার পুজো দিয়ে আসছি। বাবা হাসল, ঠিক আছে। শোভেনকাকু পা বাড়াতেই রুমনির চিত্‌কার, আমিও যাব, আমিও যাব। রুমনির বায়না না শুনে উপায় নেই।

ও সানাই বাজাতেই থাকবে! শোভেনকাকু রাগী মুখ করে ওকে নিয়ে চলল।

মা বলল, তৃণা জানো তো আগামী বছর মানে ২০১৫-তে ঠাকুরের নবকলেবর হবে। নতুনকাকিমা বলল, তাই নাকি? সোহাগ, তা হলে তো আসতে হয়। মা হাসল, মন্দ হয় না, এর আগে নবকলেবর হয়েছে সেই ১৯৯৬-তে। তখন তো দেখিনি, এ বার আসতে পারলে তো ভালই হয়। বাবা মাথা নেড়ে বলল, উরিব্বাস! ভীষণ ভিড় হবে তখন, লাখ-লাখ লোক আসবে!

নবকলেবর কী বাবা? টুকরি জানতে চায়। আমরা যেমন পুরনো পোশাক ছেড়ে নতুন পরি, এই ঠাকুরের দেহটাও সাধারণত বারো থেকে উনিশ বছরের মধ্যে পালটানো হয়। বাবা বোঝাতে থাকল। এই যে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা দেখলি, সব নিমকাঠে তৈরি। তবে সেই কাঠ যেমন-তেমন নিমগাছের হলে চলবে না। টুকরি চোখ বড় বড় করে শুনছিল। সেই গাছের কাছাকাছি একটি পুকুর কিংবা নদী থাকতে হবে। শ্মশান থাকা দরকার। থাকতে হবে উইয়ের ঢিবি, শিবমন্দির। গাছের মূলের কাছে গোখরো সাপের গর্ত থাকা প্রয়োজন। এমন আরও কিছু চিহ্ন থাকলে তবেই সেই গাছে হাত দেওয়া যাবে। এই রকম গাছ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে আশি-বিরাশি জনের দল। সেই দলে অনেক রকম লোকের সঙ্গে পুলিশও থাকে। এতটা বলে বাবা একটু থামল। হেসে বলল, আর একটু বড় হ, নিজেই বইপত্তর পড়ে বুঝে যাবি সব। এখন এর বেশি বললে গুলিয়ে যাবে। টুকরি তো বড় হয়ে গেছে। কেন যে বাবা বোঝে না!

হঠাত্‌ মা বলল, টুকরি তুই ঠাকুরকে নমো করে কী চাইলি? নতুনকাকিমার চোখ গোল গোল, হ্যাঁ সেইটাই তো শোনা হল না। বাবা হেসে বলল, কী টুকরি রানি, কী বলেছ বাবু? টুকরি দেখল সবাই তার দিকে তাকিয়ে। মা আবার বলল, কী রে?

টুকরি লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসল। বলেছি, জগন্নাথকাকু তুমি ভাল থেকো। তুমি ভাল থাকলে আমরা সবাই ভাল থাকব। এতটা বলে টুকরি চুপ করে যায়। মা’র শরীর খারাপ হলে বাবা তো এমনটাই বলে!

নতুনকাকিমা বলল, অ্যাঁ সে কী রে! মা’র মুখে হাসি। বাবা তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে টুকরিকে কোলে তুলে নিল। বলল, বেশ বলেছিস। তুই তো বড় হয়ে গেলি!

rabibarer anandamela ashok kumar mukhopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy