Advertisement
E-Paper

মাছ, বাঘ, নখ, কালো রোগা লোক

বাঘ কি মধু খায়? না। হ্যাঁ খায়। আমি বলছি খায়। পয়সা দিলে সবাই সব খায়। অ্যাই, ম্যানেজার কই? বাঘের পেমেন্ট হয়েছে? ছাগলকেও ডাকো। টাকা দাও। তার পরে দেখছি কে কী করে। কে কী খায়। ছাগলে বাঘ খাবে। বাঘে মধু দিয়ে ছাগলের দুধ খাবে। এই তো আমিও খাচ্ছি ভদকা দিয়ে।’ কিছু ক্ষণ চুপচাপ। সন্ধে হয়ে গেছে, ক’টা বাজে জানি না। অনেক দিন ঘড়ি নেই। মোবাইলে দেখা যায় যদিও, এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫

বাঘ কি মধু খায়? না। হ্যাঁ খায়। আমি বলছি খায়। পয়সা দিলে সবাই সব খায়। অ্যাই, ম্যানেজার কই? বাঘের পেমেন্ট হয়েছে? ছাগলকেও ডাকো। টাকা দাও। তার পরে দেখছি কে কী করে। কে কী খায়। ছাগলে বাঘ খাবে। বাঘে মধু দিয়ে ছাগলের দুধ খাবে। এই তো আমিও খাচ্ছি ভদকা দিয়ে।’ কিছু ক্ষণ চুপচাপ। সন্ধে হয়ে গেছে, ক’টা বাজে জানি না। অনেক দিন ঘড়ি নেই। মোবাইলে দেখা যায় যদিও, এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না। বললে লোকে হাসাহাসি করবে তাই চেপে যাই, সন্ধে হলেই আজেবাজে যত মেসেজ আসে। কে পাঠায়, কেন পাঠায় কে জানে। আসতেই থাকে, রাত পর্যন্ত। ভাল কথা কেউ বলে না। ভাল খবর আসে না।

আসলে বড় নৌকো, ইঞ্জিন লাগিয়ে দিব্যি লঞ্চ হয়ে গেছে। দোতলা। নীচের খুপরিতে বিছানা করা আছে। গদখালি ছেড়ে আসার পর প্রায় সবাই এখানেই ঘুমিয়েছে লাঞ্চের পর। ওপরের ছাউনি দেওয়া ডেক-এ বসেছিলাম আমি। প্রথমে সরু নদীর দু’পাশে গাছপালার আড়ালে বাড়ি, উলটে রাখা নৌকো, পাড়ের ওপর বাচ্চাদের দৌড়োদৌড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। এর পর নদীটা খুলে গেল। দূরে এক আধটা লঞ্চ আর মাছ ধরার নৌকা ছাড়া সব শুনশান। পাড়ের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাঙতে থাকা কাদামাটির চর, জটলা পাকানো গাছের শিকড়, এক আধটা সাবধানী বক, গাছের ডালে বাঁধা লাল কাপড়, সিঁদুর চোখে পড়ছিল। ‘বাঘে নিলে ও রকম বাঁধে’ বলল এক জন। কান দিলাম না। এই দলের আমি কেউ নই, এক জনই চেনা, তাই এসেছি ঘুরতে। ঝিমোচ্ছিলাম। তারই মধ্যে কে যেন একটা নীল সানগ্লাস পরিয়ে দিল ধীরে ধীরে, চার পাশে অন্ধকার হয়ে গেল। ঘুম ছুটে গেল চেঁচামেচি শুনে। ঝিকিমিকি আলো জ্বেলে, একটা লঞ্চ ওভারটেক করছে। সেখানে জোরালো মিউজিকের র্যাপার জড়ানো অনেক লোকের কথোপকথন। আমার ধারণা, কেউ কারও কথা শুনছে না। শুনতে চাইছেও না। মানুষ মানুষের কথা শোনে। জানোয়ার জানোয়ারের ভাষা বোঝে। অমানুষ অকারণে শব্দ করে।

সারেং-এর ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। খুপরি জানলা দিয়ে সে তাকিয়ে আছে সামনে। নজর রাখছে দূরের ফুটকি ফুটকি আলোর দিকে। কোথাও একলা লাল আলো স্থির হয়ে রয়েছে। কোথাও কমলা বিন্দু দপদপ করছে, নিশ্চয়ই রান্না চলছে খোলা নৌকোয়। কখনও ফটফটে সাদা আলোর সিগনাল আসছে জল ছুঁয়ে। জ্বলছে নিভছে। মাছ ধরার জাল পাতা আছে, জানিয়ে দিচ্ছে মাঝিরা। ‘সবাই এমন হল্লা করলে তো মুশকিল’, বললাম। সারেং উত্তর দিল না। কী-ই বা বলবে? জঙ্গলে বাঘ, লঞ্চে মাতাল, এই নিয়েই চলতে হয়, ঠান্ডার সময়, বছরের প্রথম দিকটায় খুব টুরিস্ট আসে। এসেই বলে ‘বাঘ কই?’ বাঘ তো দেখা যায় না সে ভাবে, জলের ধারের ডাঙাগুলো তো চিড়িয়াখানা নয়। তবে কোথায় নাকি জল ঘেরা জায়গায় বাঘ ছেড়েছে, টিকিট কেটে দেখা যায় এখন।

‘আসুন স্যর, কী তখন থেকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন, আরে বাঘ-ফাঘ কিসু নেই এখানে। আমরাই বাঘ। আসুন, একটু এনজয় করুন।’ কেউ এক জন ডেক-এ উঠে এসেছে, আমাকেই বলছে। এগোলাম। উপায় নেই। ধোয়া গ্লাস হাজির। চকচক করছে জ্বেলে দেওয়া আলোয়। নীচের কিচেন থেকে মাছ ভাজার গন্ধ। ‘বাচ্চা-আ, তোর বাবাকে জল দিতে বল, ভাল জল তুলেছিস তো, অ্যাই মিনারেল ওয়াটার উঠেছে তো?’ যাকে বলা হল, সে ছোট ছেলে, ঠান্ডা জলে থালা-বাসন ধোয়াধুয়ি করছে দুপুর থেকে। বাথরুমের জল তুলছে। ওর বাবা রান্না করছে। সবাইকে ‘স্যর স্যর’ বলছে।

‘উল্লাস! উল্লাস!’ স্বগতোক্তি করে সকলেই স্যাটাস্যাট প্রথম বড় পেগটা মেরে দিল। যেন স্টার্ট পয়েন্টে ইঞ্জিন রেস আপ করাল একগাদা স্পোর্টস কার। ‘আপনাকে একটা ছোট্ট করে দিলাম, কেমন?’ মাথা নাড়লাম অন্ধকারে। নিলাম। সবার হাঁ এখন বাঘের মতো, থাবা থাবা ডালমুট ঢুকে গেল সেখানে। কিছু লোক ব্যবসার কথা সেরে নিল তাড়াতাড়ি। তার পর এক জন বলল, ‘হেভি ঠান্ডা তো, অ্যাই বদি’দা, ওইটা গাও, ওই যে, চলো রিনা ক্যাজুরিনা।’ এর মধ্যেই বাঁদুরে টুপি পরা এক জন বলে বসল, ‘বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বাংলা ছবির, কে যেন অ্যাকট্রেস, খুব খোলাখুলি করে, তাকে আনা যেত। যা খরচ সে নাহয় দেওয়া যেত।’ সবাই বলে উঠল পরের বার এটা মাস্ট। মুখ ভর্তি মদে ভেজা ডালমুটের ফাঁক দিয়ে ভিজে আক্ষেপ ঝরে পড়ল। ‘এখানে তো কোনও মালই নেই। এত খরচা করে ফালতু আসা কেন? মন্দারমণি অনেক ভাল ছিল। সরকারের তো অনেক বাঘ, কিছু ছাড়ছে না কেন? দুপুরে যে কুমিরটা দেখাল, ওটা ফালতু, নড়েও না চড়েও না। ডেফিনিটলি প্লাস্টিকের তৈরি। তাইল্যান্ডে হয়। তখন থেকে খালি হেঁতাল বন, ক্যাওড়া গাছ, সুন্দরী গাছ, ম্যানগ্রোভস— যত বাজে জিনিস, আরে ম্যান, দিস ইজ আনফেয়ার।’ গলা চড়ছে, দ্বিতীয় রাউন্ড মদ পড়েছে। মাছভাজাও হাজির। বাচ্চা এনেছে প্লেট ভর্তি করে। কড়া করে ভাজা। ‘ওয়ে বাচ্চা, বাপের জন্মে বাঘ দেখেছিস? ভাজা এত কম কেন? বাকি মাছ কোথায় গেল? ডাক ডাক, তোর বাবাকে ডাক।’

বাচ্চার বাবা উঠে এল অন্ধকার থেকে। ‘স্যর মাছ তো দেখিয়ে নিয়ে গেলাম।’ ভাজলে মাছের পরিমাণ তো কমে যাবেই, কিন্তু শুনছে কে? ‘ওই ক’টা চুনো মাছ না ভেজে একটা হাঙর ধরলে হত না? ফিলে ফিলে করে ফ্রাই হলে হত না?’ কম আলোয় ভাষার তেজ বাড়ছে, অদ্ভুত ইংরিজি শব্দও ঢুকে পড়ছে চোরাগোপ্তা, ফাটছে অন্ধকারে। ‘সোঁদরবনের লোক বহুত চালু, কিন্তু ঘুঁটিয়ারি শরিফের ঘুঘু দেখেনি এরা, এক্ষুনি, আমি বলছি, এক্ষুনি আরও মাছ ধরে আনো, ওই যে লাখ লাখ মাছ ঘুরছে জলে। ফ্যাল জাল। অ্যাই, মাল দে তো।’

লঞ্চ এখন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে, দুলছে একটু একটু। সারা রাতই থাকবে এখানে, নোঙর করে। ময়লাটে হলুদ চাঁদ টলমল করছে জলে, ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তীর নিশ্চয়ই দূরে নয়, তবে আলো নেই, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আমার একটু মাথা ঝিমঝিম করছে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে তাদের গায়ে ডোরা ডোরা দাগ ফুটে উঠছে, আসলে সোয়েটার নিশ্চয়ই। অন্ধকারের চেয়েও কালো, রোগা লোকটা তার ছেলেকে ধরে ছাগলের মতো কাঁপছে। আমি কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কেউ শুনছে না। সুন্দরবনে এসে বাঘ দেখতে না পাওয়া, নেশার চোটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাঘ, মধু, ছাগল, দুধ গুলিয়ে চচ্চড়ি হয়ে গেছে এখন। ‘নেমে যা, আই সে, এক্ষুনি নেমে যা, মাছ ভেজে আন জল থেকে’, ঘড়ঘড়ে আওয়াজটা উঠল আবার। কয়েক পা পিছিয়ে গেল লোকটা। টর্চের আলো ফেলে, তাকে কাল্পনিক রাস্তাও দেখিয়ে দেওয়া হল, পাশেই পাড়, কাদা জল ভর্তি। বাপ আর ছেলে আরও পিছিয়ে গেল, তার পর মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

এর পরেই হল্লাটা থেমে গেল। তৃতীয় পেগেই থিতিয়ে এল উত্তেজনা, শাস্তি দিতে পেরে সবাই খুশি। রাতের খাওয়াদাওয়া হল না বিশেষ, কেউই খাওয়ার অবস্থায় নেই। আমারও ভাল লাগছিল না শরীরটা, কম্বল জড়িয়ে ডেকের চৌকিতে শুয়ে পড়লাম। বাকিরা কে কোথায় নেমে গেল খেয়াল নেই। অনেক রাত অবধি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল বাবা আর ছেলে হাত ধরাধরি করে যাওয়ার চেষ্টা করছে জল ভেঙে। চাঁদের সঙ্গে আমি কখন ঘুমের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম সেটা মনে নেই।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি, চার পাশে ঘন কুয়াশা। লঞ্চ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে। তীরের কাদায় গেঁথে আছে নোঙরটা। চার পাশে মনে হল অনেক পায়ের ছাপ। বড় মানুষের পায়ের দাগ, সঙ্গে ছোট মানুষের। আর রয়েছে অন্য চেহারার ভারী পায়ের দাগ। সবাই উঠে গেছে, মিলিয়ে গেছে কুয়াশা-মোড়া জঙ্গলের দিকে।

suvolama@gmail.com

rabibasariya anandabazar subhamoy maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy