ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
সামনে এম এসসি পরীক্ষা, অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে শুতে যাওয়ার আগে ছাদে একটু পায়চারি করে নিচ্ছিল শুভ্রনীল, হঠাৎ দেখল রেললাইন টপকে একটা রোগাপটকা ইয়াং চোর বেড়ালের মতো চুপি চুপি রাস্তা ক্রশ করে গলিতে উঠল, তার পর তাদের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পাশের ধরণীধরকাকুর বাড়ির দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইল। রেলের গার্ড ধরণীকাকু মালগাড়ি নিয়ে মোগলসরাই গিয়েছেন, পরশুর আগে ফিরছেন না, বাড়িতে কাকিমা একা বাচ্চা নিয়ে আছেন। চোরের টার্গেট ওই বাড়িই, কিছুক্ষণ ওয়াচ হবে, তার পর যখন বুঝবে সকলে ঘুমিয়ে কাদা, লাইন ক্লিয়ার, তখন কাজ শুরু হবে তার।
শুভ্রনীলের মাথায় আইডিয়া খেলে গেল, এক সেকেন্ড দেরি করল না, সেও তার কাজ শুরু করে দিল। বাড়িতে সকলে ঘুমচ্ছে, নীচে নেমে মেনগেট খুলে তালা দিয়ে চাবিটা পকেটে পুরে পা টিপে টিপে চোরের পিঠের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হালকা করে টোকা দিল। চোর ততক্ষণে পোশাকটোশাক ছেড়ে শুধু টাইট শর্টপ্যান্ট পরে অপারেশনের জন্য রেডি। ‘আঁক’ করে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল।
শ্শ্শ্! ঠোঁটে আঙুল দিয়ে শুভ্রনীল ফিসফিস করে বলল, এখানে সুবিধে হবে না ভাই, বাঘের মতো অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছাড়া আছে, কামড়ে ছিঁড়ে নেবে।
চোরটা বোধ হয় এই লাইনে নতুন। সে তোতলাতে শুরু করল, তু-তু-তুমি?
লাইনের লোককেই চিনতে পারছ না? আমি তোমারই মাসতুতো ভাই। চোরে চোরে তো মাসতুতো ভাই-ই হয়, কী বলো?
চোর চেয়ে আছে। শুভ্রনীল মুচকি হাসল, বিশ্বাস হচ্ছে না? চলো আমার সঙ্গে।
কো-কোথায়? চোর আড়ে আড়ে পালানোর রাস্তা দেখছে।
বেশি দূরে নয়, কাছেই। জব্বর কাজের খবর আছে। একা পারব না বলে লোক খুঁজছিলাম, ভালই হল তোমাকে পেয়ে গেলাম।
চোর জ্বলজ্বলে চোখে শুভ্রনীলকে দেখছিল, বলল, তোমার চেহারা দেখে লাইনের লোক বলে মনে হচ্ছে না ঠিক।
সকলেই তাই বলে। শুভ্রনীল বুদ্ধি করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এ জন্য কত ভাল ভাল কাজ হারিয়েছি। তবে এটা ছাড়ছি না। জলের মতো সোজা কাজ। নো কুকুর, নো পুরুষ মানুষ, দুই বুড়ি শুধু থাকে, আয়রনচেস্টে কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না আর টাকাপয়সা, তার চাবি থাকে ছোট বুড়ির মাথার বালিশের নীচে, একেবারে পাক্কা খবর।
চোর দেখছে। শুভ্রনীল আবারও বলল, কী হল? এটাও বিশ্বাস হচ্ছে না?
কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না আর টাকাপয়সা?
চোরের ওষুধ ধরেছে।
ঠিক তাই। শুভ্রনীল টোপ দিল, তুমি শুধু বাইরে পাহারায় থাকবে, আমি আসল কাজ করব। কয়েক লাখ টাকার মাল, আধাআধি বখরা। রাজি?
চোর এতক্ষণে পথে এল। একটু তা-না-না করে শুভ্রনীলকে বাজিয়ে নিয়ে রাজি হয়ে গেল। মনে মনে চোরকে ‘থ্যাঙ্কস’ দিয়ে শুভ্রনীল হাঁটতে শুরু করল, পিছন পিছন ফিটফাট হয়ে তাকে অনুসরণ করল চোর। রাস্তায় লোক নেই একটাও, কুকুরগুলোও মন দিয়ে প্রথম রাতের ডিউটি করে আবার শেষ রাতের ডিউটি ধরার ফাঁকে একটু রেস্ট করে নিচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনে উঠে এল শুভ্রনীল। সামনে পিছনে লাল ও সবুজ সিগনালের আলো জ্বলছে। দূরে আলো ঝলমল স্টেশন। জনমানবহীন লাইন ধরে ফাঁকায় ফাঁকায় একটু হেঁটে স্টেশনে উঠে এল তারা।
স্টেশনে তখন লাস্ট লোকালের খবর হয়েছে। দূরে গাড়ির আলোও দেখা যাচ্ছে। চোর ফিসফিস করে উঠল, সাইড মারো! সাইড মারো! ট্রেন আসছে।
তাড়াতাড়ি চলো! শুভ্রনীল ঘুরে দাঁড়াল, ট্রেনটা ধরতে হবে।
কেন? আবার ট্রেন কেন?
কাজটা ঠিক এখানে নয়। ট্রেনে দু’স্টেশন যেতে হবে। কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে?
ও। চোর আর কথা বাড়াল না।
ট্রেন ঝমঝম করে ঢুকে গেল স্টেশনে। রাতের ট্রেন বলে প্ল্যাটফর্মে লোকজন তেমন নেই, দু’জন জি আর পি কাঁধে বন্দুক নিয়ে রাত-টহল দিচ্ছে। পুলিশ দেখে শুভ্রনীল এ বার নিজের মূর্তি ধারণ করল, শুরু করে দিল তার খেলা, খপ করে চেপে ধরল চোরের একটা হাত।
চোর ঘাবড়ে গেল। বলল, হাত ছাড়ো!
শুভ্রনীল ছাড়ল না, বলল, সোজা ট্রেনে উঠে যাও, বেশি চালাকি করলে পুলিশ ডাকব। দেখছ?
চোর ভয় পেল, বলল, উঠছি, উঠছি।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল। শুভ্রনীল হাত ছেড়ে দিতে চোর আর সিনক্রিয়েট করল না, ধড়ফড় করে উঠে পড়ল ট্রেনে। এ বার বিদায়ের পালা। শুভ্রনীল নীচে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে হুমকি দিল, তোমায় দেখে রাখলাম, ফের যদি তোমায় এখানে দেখি দেখবে কী হাল করি তোমার। কথাটা মগজে ঢুকল?
খুব। চোর ট্রেনের গেটে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, আর জীবনে এ তল্লাট মাড়াব না। খুব শিক্ষা হল আমার।
কষ্ট করে হাসি চেপে শুভ্রনীল জিজ্ঞেস করল চোরকে, এ বার বুঝেছ তো আমি কে?
এক্কেবারে হাড়ে হাড়ে। যা দেখালে, তোমার খুরে খুরে দণ্ডবৎ গুরু!
শুভ্রনীল এ বার হেসেই ফেলল, গুরু?
হুইস্ল বাজিয়ে গাড়ি নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোরও বলল, হুঁ, মাসতুতো গুরু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy