ছবি: সুমন চৌধুরী
আমার কৈশোরে তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম ও শুনেছিলাম আমাদের এস আর দাশ রোডের বাসায়। বয়সে তিনি আমার চেয়ে বড়, কিন্তু তেমন কিছু বড় নন। বাবাকে গান শোনাচ্ছিলেন তিনি। মেয়েদের গলা বেশি সরু হলে আমার পছন্দ হত না, আজও হয় না। ছেলেবেলা থেকেই ভাল লাগত বরং যে মহিলা-শিল্পীদের গলার আওয়াজ একটু পুরু, ঘন, তাঁদের গান। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাজার-সফল মহিলা প্লেব্যাক শিল্পীর গলা শুনে মনে হয় গলাটা বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কারুর গলা যদি বছরের পর বছর ‘ষোড়শীর হৃদিসরসিজ-প্রেম’ থেকে যায় তো আমার পোষায় না। ছেলেবেলায় যে নবীনার গান বাড়িতে শুনছি, তাঁর কণ্ঠে কিন্তু বয়সোচিত চপলতার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ওজন। লুকোনো ওজন।
এই কমবয়সি গায়িকার আওয়াজ এমন যে গান ধরলে গানটা জানলা দিয়ে উড়ে চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভার-বহনে-সক্ষম একটি গলায় ভর করে গানটা ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নির্মলা মিশ্র।
এই মুহূর্তে যদি চল্লিশোর্ধ্ব কোনও বাঙালি শ্রোতাকে বলা হয়— নির্মলা মিশ্র নামটি বললে কোন গানগুলি আপনার মনে পড়ছে, তা হলে তিনি সম্ভবত ‘ও তোতাপাখি রে’ আর ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’— এই গান দুটির কথা বলবেন। আমি যে নির্মলা মিশ্রকে মনে রেখেছি এবং তাঁর ক্ষমতাকে কুর্নিশ জানিয়ে চলেছি, তিনি নানান ধরনের গানে এক ব্যতিক্রমহীন উৎকর্ষ ও নির্বিকল্প গায়কির পরিচয় দিয়ে চলেছেন (আমার স্মৃতিতে) ষাটের দশকের গোড়া থেকে, হয়তো তার আগে থেকেই।
চিন-ভারত যুদ্ধের সময়ে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হত তাঁর গাওয়া ‘মা আমার লক্ষ্মী মা গো অঙ্গ ঘিরে হেমবসন’ আর ‘তোরা ডাক দিয়ে বল্ বল্।’ না, দেশপ্রেম নয়, রক্তমাংসের সংগীতপ্রেমকে আরও জোরালো করে তুলতে পেরেছিল এই দুটি গান এক কিশোরের মনে। প্রথম গানটিতে ‘আঁচলখানি নীলবরণ’ অংশে ‘আঁচলখানি’ কথাটি যে নরম, অনুচ্চ তানের ওপর উচ্চারণ করেছিলেন তিনি, আজও তা আমার কাছে গান গাওয়ার একটি পাঠ। তেমনি দ্বিতীয় গানটির পল্লীগীতি ঘেঁষা সুর যে আদরের সঙ্গে গেয়েছিলেন তিনি— আবাল্য দেশপ্রেমবিরোধী এই আমিটার মনে তা এনে দিয়েছিল একটা আবেগ, যার স্মৃতি আমায় আজও কাঁদায়।
নির্মলা মিশ্রর গায়কিতে এমন একটা সহজ সাবলীল ভাব আছে, যা শুনে মনে হতে পারে, গান গাওয়া কী সহজ! আকাশবাণীর রম্যগীতির গান ‘চেয়ে বসে থাকি দিবসরজনী’ (সুরকার: অলোকনাথ দে) যে কতটা দক্ষতা দাবি করে, তা আজকের কোনও নামজাদা শিল্পী, কী মহিলা কী পুরুষ, এক বার নিজে গেয়ে যাচাই করে নিতে পারেন। নির্মলা গেয়েছেন যেন তিনি আটপৌরে কোনও বিষয়ে সহজ ভাবে কথা বলছেন।
অথচ শুধু ‘চেয়ে’ কথাটিতেই গলাটি যা করল, তাতে আমার অন্তত ঢোক গিলতে ইচ্ছে করে। অন্তরায় তারের সা থেকে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ গান্ধার এবং সেখান থেকে এক-প্রক্ষেপে তারের শুদ্ধ গান্ধার, তার পর তারসপ্তকেই ‘গপ মপ গ/- - -/- - - /’: বিনা আয়াসে। শ্রোতা কিছু বোঝার আগেই কাজ হাসিল। এক নিশ্বাসে তারের শুদ্ধ গান্ধারে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কণ্ঠ— আকাশে সন্ধেতারার মতো। তার পর ‘রচেছিলে মোহ’ গাইতে গিয়ে তিনি ‘মোহ’ কথাটিতে প থেকে কোমল নি-তে যাওয়ার সময় সামান্য একটু ঘন ধ্বনি বের করলেন, যা অলোকনাথের মেধা-প্রসূত ওই মোক্ষম কোমল নি পরদাটিকে সর্বনাশা করে তুলল। কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন ‘দুঃখ তার লেখে নাম।’ নির্মলা দুঃখের নাম লিখলেন তাঁর গায়কি দিয়ে। অথচ, সেই ভাবে ভেবে দেখলে কী এমন! দুটি মাত্র স্বর। কিন্তু এই দুটি স্বরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলার অনেক স্মরণীয় সুর। রবীন্দ্রনাথ জানতেন কী ভাবে হঠাৎ কোমল নি লাগিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনতে হয়। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ জানতেন। অলোকনাথ দে-ও দেখিয়ে দিলেন কী ভাবে কোনও কোনও উদ্ভট শ্রোতাকে সারা জীবনের মতো বন্দি রাখা যায়। দেখিয়ে দিলেন নির্মলা মিশ্রও, তাঁর গায়কির মধ্য দিয়ে।
‘আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান’-এর মতো চোখে আঙুল দিয়ে নয়, ভাবালুতা আর অতি-নাটকীয়তা ছাড়াই বেদনার ভাব জাগিয়ে তোলার প্রকৌশল নির্মলা মিশ্রর মতো রপ্ত করেছেন ইতিহাসে কম গায়ক-গায়িকাই। এই ‘বেদনা’য় কোনও হাহাকার নেই, বিলাপ নেই। আছে গভীর একটি বোধ। এখানেই নির্মলা মিশ্রর শিল্পীমেধার আধুনিকতা। ‘অনেক সোনালি দিন’, ‘যেও না এমন করে’, ‘যায় রে একী বিরহে’— প্রতিটি গানেই তাঁর পরিমিত আর্তি আমাদের সমব্যথী করে তোলে।
তেমনি সলিল চৌধুরীর সুরে ‘আমার এ বেদন মাঝে’ ইতিপূর্বে উল্লিখিত গানগুলির বিপরীতে দ্রুত লয় ও ছন্দবহুলতার কারণে নির্মলার কণ্ঠে ‘অশ্রু’, ‘বেদনা’র উদ্যাপন। এই দুটি কথা যে গানে আছে তা মোটের ওপর দ্রুত লয় এবং সুর-ছন্দের একাধিক আকস্মিক ওঠানামাকে প্রশ্রয় দেবে— এ আমাদের সংগীত-সংস্কৃতিতে তেমন নেই। এই ব্যতিক্রমটাই সলিল চৌধুরীর বৈপ্লবিক অবদান। আবেগের স্থৈর্য বজায় রেখে এই দুরূহ গানটির প্রতি সুবিচার নির্মলা মিশ্রর মতো আর কে করতে পারতেন, কে জানে।
এই দিক দিয়ে দেখলে, নির্মলার গায়কির এই পরিশীলিত, অনুচ্চ আর্তির দিকটাই তাঁর গাওয়া ‘ও তোতাপাখি রে’ এবং ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’-র বিপুল জনপ্রিয়তার একটি কারণ।
কিন্তু এই গানগুলির পাশাপাশি নির্মলারই গাওয়া ‘কখন যে প্রজাপতি পাখাভরা রং ছড়ায়’ শুনলে তবেই আমরা বুঝতে পারব, স্ফূর্তি ও আনন্দের উদ্যাপনে তিনি গায়কিতে একই অলৌকিক ক্ষমতা রাখেন।
ক্ষমতা। বছর উনিশ আগে নির্মলা মিশ্র এসেছিলেন এক টেলিভিশন চ্যানেলের সংগীত প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে। সব শেষে বিচারক একটি গান শোনাবেন। স্থায়ীটুকু গাইলেই হবে। তিনি বেছে নিলেন ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।’— ‘নাই আসি হেথা ফিরে’-তে ‘নাই’-এর সুর তারসপ্তকের পঞ্চম ছোঁয়া। গাইতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠে সেই পঞ্চম সামান্য একটু কম লাগল। এ কোনও ব্যাপারই নয়। চট করে গাইতে গেলে হতেই পারে। ভিডিয়ো-রেকর্ডিংয়ের পর তাঁকে গাড়িতে তুলে দিতে যাচ্ছি, হঠাৎ তিনি বললেন, ‘পারলাম না, না রে?’— আমি বললাম, কোথায়? একটু কঠোর গলায় তিনি বললেন, ‘বোকা সেজো না, তুমি খুব ভালই জানো যে আমি ওই পরদাটায় ঠিকমত পৌঁছতে পারলাম না।’— আমতা আমতা করতে লাগলাম আমি। হঠাৎ দু’চোখময় ব্যাকুলতা নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কেন পারলাম না রে!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy