Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১...

সহোদরা স্ত্রী

বা সহোদর স্বামী। বা রাজা অয়দিপাউস ও তাঁর মা। রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বা অতি ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে যৌন ক্রিয়া ঘটলে, তাকে বলে ইনসেস্ট। পৃথিবী জুড়ে তাকে ঘেন্না করা হয়। আবার পৃথিবী জুড়েই জীবনে ও শিল্পে বারবার অসহ পুলক হয়ে মাথা চাড়া দেয় এই ‘নিষিদ্ধ’। ঈপ্সিতা হালদারশুনেছিলাম বটে ছোটবেলাকার টেপ রেকর্ডারে তৃপ্তি মিত্রর তীক্ষ্ন আশ্লেষময় ‘আমার রাজা’ ডাক স্বামীকে, যিনি আদতে ওঁর সন্তান, এবং শম্ভু মিত্রর দমচাপা ‘য়োকাস্তা’, স্ত্রীকে, যিনি ওঁর মা। আমরা সম্যক কিছু না ভেবেই একমত ছিলাম যে, অয়দিপাউস নামে অভিশপ্ত লোকটা, যে অজান্তে পিতাকে হত্যা করে মাতার শয্যাকে কলঙ্কিত করে, সে অভাগাই। যা দেখার নয়, সেটা যে ঠিক কী বস্তু, তা ভাবতে বসলে আমাদের আয়নার মুখোমুখি হতেও বিড়ম্বনা লাগত, তাই তা এড়িয়ে আমরা বহু দিন অবধি এই না-শুনি না-শুনি না-জানি ভাব রেখে দিই।

ইডিপাস, ‘যা দেখার নয়’ তা দেখে ফেলার শাস্তি হিসেবে নিজেকে অন্ধ করে দেওয়ার পর। পিয়ের পাওলো পাসোলিনি নির্দেশিত ছবি ‘ইডিপাস রেক্স’।

ইডিপাস, ‘যা দেখার নয়’ তা দেখে ফেলার শাস্তি হিসেবে নিজেকে অন্ধ করে দেওয়ার পর। পিয়ের পাওলো পাসোলিনি নির্দেশিত ছবি ‘ইডিপাস রেক্স’।

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

শুনেছিলাম বটে ছোটবেলাকার টেপ রেকর্ডারে তৃপ্তি মিত্রর তীক্ষ্ন আশ্লেষময় ‘আমার রাজা’ ডাক স্বামীকে, যিনি আদতে ওঁর সন্তান, এবং শম্ভু মিত্রর দমচাপা ‘য়োকাস্তা’, স্ত্রীকে, যিনি ওঁর মা। আমরা সম্যক কিছু না ভেবেই একমত ছিলাম যে, অয়দিপাউস নামে অভিশপ্ত লোকটা, যে অজান্তে পিতাকে হত্যা করে মাতার শয্যাকে কলঙ্কিত করে, সে অভাগাই। যা দেখার নয়, সেটা যে ঠিক কী বস্তু, তা ভাবতে বসলে আমাদের আয়নার মুখোমুখি হতেও বিড়ম্বনা লাগত, তাই তা এড়িয়ে আমরা বহু দিন অবধি এই না-শুনি না-শুনি না-জানি ভাব রেখে দিই।

সম্পর্কের আলোচনায় অজাচার (‘ইনসেস্ট’-এর প্রচলিত বাংলা), অর্থাত্‌ অতি ঘনিষ্ঠ রক্তের সম্পর্কে যৌনাচার, বোধ করি সব চাইতে অনালোচিত, সবচেয়ে নোংরা কুত্‌সিত ও আতঙ্কের অধ্যায়। অপরাধবোধের তালা-চাবি এঁটে বন্ধ করা। আমরা শুধু নৃতত্ত্বের আলোচনা মেনে নিতে পারি যে, যেমন ছাগল, বা অন্য যে-কোনও পশু, পশুকুল, বিবেচনায় রাখে না কে কান্তা, পুত্রই বা কে, জৈবিক তাড়নার সেই আদিম মুহূর্তে, প্রাক্লগ্নে, মানুষেরও স্থিত হয়নি বাবা-মা-ভাই-বোন সম্পর্কগুলি। মানুষেরও যে এ রকম হতে পারে, হয়েছিল, এমনকী হয়, সে ভাবলেও আমরা কানে আঙুল দিই, ঝাঁ ঝাঁ করে মাথা।

সভ্যতার প্রাক্লগ্নে, টোটেম-নির্ভর গোষ্ঠীতে, রক্তের সম্পর্ক থাকা মানুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককেই পবিত্র ধরা হত। রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে, পারিবারিক সম্পত্তি হস্তগত রাখতে, রক্তের সম্পর্কেই বিয়ে ঠিক হত। অতি আদিম কালে, যখন গোত্রের বাইরে, পরিবারেরও বাইরে বিয়ে চালু হয়নি, আপন ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ ছিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে আমরা পড়ি মিশরের এমন সমাজের কথা, যা তখন পরিবারের ভিতরে যৌনাচার ও বিয়ে, আর পরিবারের বাইরে যৌনাচার ও বিয়ে দুইয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বাইরের গোষ্ঠীর মেয়ের প্রেমে পড়ো-পড়ো অবস্থায় ভাই গল্পের শেষে ফিরে আসে নিজের বোনের কাছে, চিরায়ত সম্পর্কের জয় দেখে বাবা-মা স্বস্তি পেয়ে হাসেন। তাঁরাও ভাই-বোন।

এর পর, একটি গোষ্ঠীর জমিজায়গা বাড়াতে, ধনসম্পত্তি ও পশু নারী ইত্যাদির সংখ্যা বাড়াতে, গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ের রীতি শুরু হল। যেহেতু দেখা গেল বিয়ের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সম্পদ আদান-প্রদানের প্রথা চালু করা সম্ভব। এরই ফলে ক্রমে এত দিনের সামাজিক পারিবারিক যৌনাচার হয়ে দাঁড়াল নিষিদ্ধ।

আকাশের তারা নিয়ে বইয়ের আলোচনায় উপনিষদের মতো পবিত্র গ্রন্থে অজাচারের উল্লেখ পেলে আমরা আজ আশ্চয্যি যাই বটে, কারণ আমরা ভুলে যাই সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদের নাওয়া-খাওয়া-আঁচানো ঢাকঢাক-গুড়গুড়’এর থেকে অনেক প্রাথমিক। তা প্রাচীনতম উন্মেষণা। এই যে বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্রহ্মা নিজ কন্যার পিছু কাম-বশে ধাওয়া করলেন, এই কাম সৃষ্টির আদিমতম অনুপ্রেরণা। সেই নারী, আদি পিতার থেকে জাত কন্যা বলে আদি নারী সে-ই। যম-যমী, বৈবস্বত মনু-শ্রদ্ধা, শুক্র ও তাঁর তিন বোনেরও একই আখ্যান। কিন্তু ক্রমে ঋগ্বেদ থেকে ব্রাহ্মণের দিকে আসার সময়ে ধারণাটা বদলে যায়। রুদ্র, রিচুয়ালের দেবতা, ইনসেস্টকে শাস্তি দিতে শুরু করেছেন, দেখি, ক্রমে।

অন্য দিকে, গ্রিক পুরাণে মানুষ আবার এই ধরনের কামেচ্ছা ব্যক্ত করেছে অতি খোলাখুলি, কখনও ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। ভগবান জিউস, হেড-গড যিনি, বোন ও কন্যাগমন করেই যাঁর ওলিম্পিয়াষষ্ঠীর কোল নানাবিধ দেবদেবীতে ভরেছে, তিনি নিজে আদি ভাই-বোন ক্রোনাস ও রেয়া-র সন্তান। পরের প্রজন্মে গ্রিক দেবদেবীদের প্রায় সব্বাই অজাচারবর্তী। জুপিটারের বোন/বউ জুনো বলে: জানি না কীসে বেশি গর্ব, জুপিটারের বোন হিসেবে, না বউ হয়ে।

রিরংসা ও ঘৃণা, চাহিদা ও চাহিদার প্রতি আতঙ্কের একটি আত্মঘাতী পর্যায়ের শুরু তার পরে, গ্রিক পুরাণে। দাদা থেয়েস্টেস তার যমজ ভাই অ্যাট্র্যিয়ুসের বউয়ের সঙ্গে পরকীয়া করছিল বলে ভাই রেগে দাদার বাচ্চাদের কেটেকুটে দাদাকেই খেতে দেয়। কী ভাবে নেব এর শোধ, জিজ্ঞাসায় দৈববাণী হয়— উপগত হও নিজ কন্যার সঙ্গে, সেই সন্তান/নাতি করবে প্রতিকার। আলো-আঁধারিতে নিজ মুখ লুকিয়ে কন্যা পেলোপিয়াকে ধর্ষণ করে থেয়েস্টেস। এই আখ্যানগুলো থেকে নীতিকথা পাই, রক্ত-সম্পর্কের মধ্যে যৌনাচার সর্বনাশা। তেমনি এই সব গল্পে সত্‌মা কামনা করে পুত্রকে, বোনের কামনা নিবেদনে আঁতকে ওঠে ভাই, বাবার প্রেমে পড়ে মেয়ে, মা অবগুণ্ঠনে মুখ লুকিয়ে যায় পুত্রের শয্যায়। এ থেকে পাশাপাশি স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে নারীই নরকের দ্বার!

এই সেই সময়, যখন এই সব সম্পর্কের নাম দেওয়া হয়ে গেছে, অথচ মুক্ত কামনার বোধ কমেনি। এই দ্বিধাহীন কাম, আর তার পর আত্মগ্লানি সমাজতাত্ত্বিকদের ভাষা ধার করলে মানব জৈবিকতাকে সভ্যতার চৌকাঠের দিকে ঠেলে দেয়। আত্মগ্লানি হয়ে ওঠে যথেচ্ছকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল। এই গল্পগুলি তাই সমাজের ইতিহাসকে বোঝার পথ। কোন সমাজে কোনটা বেশি গুরুত্ব পাবে পাপ হিসেবে, সেই অনুযায়ী গল্পের গতি ও নীতি এগিয়ে চলে, নানা ভাবে জৈবিকতার সামাজিকীকরণ হয়।

বাইবেলে, প্রবল খরার পর নিজ দেশকে ফের সুফলা করতে অন্বেষণে বেরোয় আব্রাহাম। মিশরের রাজার অন্তঃপুরে বোন সারাহ্কে পাঠায় সে, বদলে পায় ভেড়া মোষ শস্যবীজ। সে গোপন রাখে এই সত্য যে, সারাহ্ তার স্ত্রীও। এ দিকে না-জেনে হলেও পরপত্নীকে হারেমে রাখার পাপে মিশরে দেখা দেয় প্লেগ। ফারাও অতি ক্রুদ্ধ হন, আব্রাহাম সত্য গোপন করায়। বাইবেলের এই কাহিনিতে অজাচারের থেকে বরং পরকীয়া বেশি পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যেমন, ভাইঝি টায়রাকে প্রলুব্ধ করার জন্য কাকা সিসিফাস পায় এই নির্দেশ: তাকে পাহাড়ের মাথায় তুলতেই হবে বিপুল পাথরখান, কিন্তু শাস্তি এই যে, তোলামাত্র সে পাথর গড়িয়ে পড়বে নীচে, আর তাই আজন্ম সিসিফাসকে নীচ থেকে উপরে তুলতে হবে তা, বিরামহীন, কাজ সমাপ্তির স্বস্তিবিহীন। কিন্তু কাকা-ভাইঝি সম্পর্ক তো নিষিদ্ধ ছিল না গ্রিসে। তা হলে এই গল্পে গ্রিকদের পক্ষে কোন জিনিসটা হয়ে দাঁড়ায় আশঙ্কার? যৌন প্রলোভন?

রোমান কবি ওভিদ-এর কলমে পিতাকে ঘৃণা পাপ, আকাঙ্ক্ষা তার চেয়েও অধিক পাপ। বাইবেলে তৈরি হয় নিষেধাজ্ঞার নিদান, লেভিটিসিয়াস বলেন: the nakedness of thy father, or the nakedness of thy mother, shalt thou not uncover: she is thy mother, thou shalt not uncover her nakedness. (18:7). The nakedness of thy sister, the daughter of thy father, or daughter of thy mother, whether she be born at home, or born abroad, even their nakedness thou shalt not uncover. (18:9)

এগুলি বহু বছর ধরে প্রচলিত। মধ্যযুগে অজস্র গাথায় চলতে থাকবে এই আকাঙ্ক্ষা ও তার গ্লানি, প্রদত্ত শাপ। নিয়মকানুন তৈরি হওয়ামাত্রে, গল্প অনুসরণ করলেই দেখব, আত্মহত্যা-মৃত্যুদণ্ডের হিড়িক পড়ে গেল। নিশ্চয়ই অতীব প্রাথমিক এই চাহিদা, সহজে অবদমনের নয়, তাই নিষেধাজ্ঞা এত কঠোর, তাইই চাওয়াগুলি নিজের নিজেকেও পেরিয়ে উঠে আসে। তাই বোধহয় বারবার সাহিত্যে শিল্পে এই ‘নিষিদ্ধ’ কেবলই কাঁটাওলা পুলক রূপে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে!

নদীর জলে ভেসে আসা লম্বা চুল দেখেই ভাই প্রতিজ্ঞা করে বসে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে সে, যা তার বোনের চুল আসলে। এ বার কে কোথায় লুকায়! আবার অরুন্ধতী রায়-এর ‘গড অব স্মল থিংস’-এ ভাই-বোন নিজেদের শরীর ও আত্মার মধ্যে তীব্র আশ্লেষে খুঁজে পায় এতদিনকার অসহ নিঃসঙ্গতার মলম! এখান থেকে সমাজের ও পরিবারের গড়ন-পেটন, ব্যক্তির যৌনাচার, ফ্যান্টাসি, আতঙ্ক, উত্তেজনা পড়ে ফেলতে চাইবেন মনস্তত্ত্ববিদরা।

ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের জানা না-জানার বাইরে, যৌথ নির্জ্ঞানে নিহিত আকাঙ্ক্ষা। নিজের পিতাকে হত্যা করে মাতার শয্যায় যাওয়া অজান্তে ঘটলেও, আসলে এইই আদিম এষণা। ফ্রয়েডই বলেন, যৌন এষণা উন্মীলিত হওয়ার মুহূর্তে ঘন রক্ত-সম্পর্কের দিকে ধেয়ে যায় আকাঙ্ক্ষা, এই হল ইনসেস্ট। ফ্রয়েডের প্রায় সমসাময়িক, ফিনল্যান্ডের এডওয়ার্ড ওয়াটারমার্ক-এর তত্ত্ব ধরলে অবশ্য ফ্রয়েড প্রায় খারিজ হয়ে যান। ‘দ্য হিস্ট্রি অব ম্যারেজ’ (১৮৯১) বইতে ওয়েস্টারমার্ক দেখিয়ে দেন: বরং শৈশবের ঘনিষ্ঠতায় রক্ত-সম্পর্কের মধ্যে যৌনাবেগ আদতে ভেস্তে যায়। নিস্পৃহতা তৈরি হয়।

ইজরায়েলের কিবুট্‌জ প্রথায় একটা যৌথ খামার গোছের জায়গায় নিকট রক্ত-সম্পর্কের প্রায় ৩০০০ শিশুকে বয়ঃকাল পর্যন্ত পালন করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন রক্ত-সম্পর্কের মধ্যে আকর্ষণ বোধ করেছে। তাও এই ১৪ জন বড় হওয়ার কালে নিজেদের মধ্যে হাসি-খেলায় কম ঘনিষ্ঠ ছিল। ফ্রয়েডের নিজের ক্ষেত্রেও এ রকমটা বলা যেতে পারে, তাঁকে কোলে-কাঁখে নিয়ে দুধে-জলে-বাহ্যে-বমিতে মানুষ করেছিলেন যে দুধ-মা, তাঁর প্রতি যৌনাবেগ বোধ না করে কামনার উদ্ভব হল মায়ের প্রতি, যিনি তত ফ্রয়েডের কাছে ঘেঁষতেন না। ইডিপাসের গল্পই তো যত না ফ্রয়েডের, তার চেয়ে বেশি ওয়েস্টারমার্কের। কই, এষণাই যদি হবে, য়োকাস্তার বদলে পালিতা মায়ের প্রতিই তো ইডিপাসের কামনা দেখা যেত।

১৯৮০ নাগাদ বারবারা গোনিয়ো একটি ব্যাখ্যা দেন, শিকাগোতে একটি দত্তক সংস্থা চালানোর সময়, ইনসেস্টের কার্যকারণ এড়ানোর পদ্ধতি খুঁজতে গিয়ে। সেই ব্যাখ্যায়, এই আকর্ষণের কারণ হল জিনগত। যেমন মধ্যযুগীয় ব্যালাডে যমজ ভাই-বোনের সন্তান গ্রেগরিয়াস বহু কাল ভিনদেশে কাটিয়ে সতেরো বছর পর মায়ের দেশে ফিরে যাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, বিয়ে করে শেষে, দেখা যায় সেই মহিলা ওর মা। ইডিপাসও তো তা-ই, শাপগ্রস্ত বলে নয়, স্বভাবত বলে।

এই তত্ত্বের কিছু সমর্থন বেশ কিছু ঘটনায় পাওয়া যাবে। GSA বা ‘জেনেটিক সেক্সুয়াল অ্যাট্রাকশন’ নিয়ে চর্চার হিড়িক ওঠে বিভিন্ন মামলার পরেই। জার্মানির লাইপজিগ শহরে, শৈশব থেকে বহু কাল বিছড়ে থেকে দেখা হওয়ার পর ভাই ও বোন সম্পর্ক গড়ে, ভাইয়ের সন্তানের জন্ম দেয় বোন। জিনগত যৌন আকর্ষণের বিষয়টি এই সংক্রান্ত মামলা ও শাস্তিদানের প্রসঙ্গে উঠে আসে। যে, যুক্তি-শৃঙ্খলার বাইরের এক অমোঘ টান আছে যা নিকট-সম্পর্কের মধ্যে কাজ করে। ‘দ্য কিস’ নামে যে বইটি, ক্যাথরিন হ্যারিসন-এর আত্মজীবনী, তাতে দেখি ক্যাথরিন নিজের বাবার সঙ্গে চার বছর প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক যাপন করেন, তবে তার আগে কুড়ি বছর ক্যাথরিন বাবাকে দেখেনইনি। ‘জিএসএ’ সংক্ষেপে এটাই বলে: যদি রক্ত-সম্পর্কে আবদ্ধ দুটি নর-নারী প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়

এমনকী মেনস্ট্রিম সিনেমাও এই ‘বিরল ও বিকৃত’ বলে রটিয়ে দেওয়া জিনিসটিকে, এই ‘কক্ষনও ঘটে না’ বলে ধামাচাপা দেওয়া জিনিসটিকে, কিছুতে এড়িয়ে চলতে পারে না। হলিউডের ‘স্যাভেজ গ্রেস’ ছবিতে বাবা ছিনিয়ে নেয় ছেলের বান্ধবীকে। অবসাদগ্রস্ত ও সমকামী ছেলেকে ‘সারাতে’ এক সময় মা মিলিত হয় তার সঙ্গে। সব ছবি এত সরাসরি এই কামনার কথা বলে না। আমরা সবাই উপভোগ করেছি সেই মজাদার সায়েন্স-ফ্যান্টাসি গোত্রের হলিউডি ছবি, ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ যেখানে ছেলে টাইম মেশিনে চেপে হুড়মুড়িয়ে চলে গেল এমন সময়-এ, যখন মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ে হয়নি, আর মা কিনা, সেই ভবিষ্যত্‌ থেকে আসা স্মার্ট ছেলেকে দেখে, ক্যাবলা বাবাকে ছেড়ে তার দিকেই ধেয়ে যায়। আসলে কি ছেলে এই জন্যই অতীত সাঁতরে অভিযানে শামিল, যাতে সে উলটে লিখতে পারে বিধিলিপি, মা’কে পায়, নিরঙ্কুশ?

অজাচার যে সর্বদা শারীরিকতায় প্রাপ্ত, তা নয়। সে যেন এক অন্য যুক্তিপট। যেন একই শরীরকে দু’ভাগে ভাগ করার পরবর্তী অসহ্য বিচ্ছেদ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার নিষ্কলুষ প্রকৃতির মতোই ভ্রাতা-ভগিনীর নিষ্কলুষ কামবিহীন তীব্রতা। ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিয়ের দিন, ১৮০২ সালের ২ অক্টোবর, বোন ডরোথির রোজনামচায় পাই, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর স্ত্রী হাত ধরাধরি করে গির্জায় চলে যাওয়ার পর (বোন বিয়েতে যাননি) শয্যায় আছড়ে পড়েন ডরোথি। এর পর প্রায় কুড়ি কুড়ি বছর নিজেকে বন্দি রাখেন চিলেকুঠুরিতে, আর ভাই ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভোগেন নিরন্তর অপরাধবোধে।

আসলে, সমাজের ওপর নির্ভর করে, কতটা পাপ, কতটা নয়। ইসলামে রক্তের সম্পর্কের বাইরে তুতো-পাতানো-লালিত সম্পর্কে অজাচার ভাবা হয় না এবং নিষেধাজ্ঞা নেই। পিতা দত্তক-পুত্রের বিধবাকে বিয়ে করতে পারেন। আমরা সকলেই দক্ষিণী একটি হিন্দু সম্প্রদায়ে মামা-ভাগ্নির কাঙ্ক্ষিত বিবাহের রীতি জানি। আর মানি বা না-মানি, এ-ও আমরা বিলক্ষণ জানি, আমাদের জীবনে, আমাদের চার পাশের মানুষদের অধিকাংশের জীবনেই, তুতো ভাই-বোনদের মধ্যেই উদ্বোধিত হয় প্রথমতম যৌনবোধ। পরে আমরা অপরাধবোধে সরে আসি, নিজেকেই বলি ‘ছি! ও-সব ঘটেনি!’ কিন্তু সারা জীবনেও ভুলতে পারি না সেই আদি চুম্বনের, জাপটাজাপটির আকুলতা, যৌনতার অভিষেক।

পৃথিবীর নানা দেশে নানা মাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যেমন, তেমনই সরাসরি মাতা-পিতা-পুত্র-কন্যার বংশলতিকা ব্যতীত যে আত্মীয়তা, সেখানে যৌনাচার আইনি চোখে নিষিদ্ধ বা শাস্তিযোগ্য নয়। অবশ্যই বিয়ে বিষয়ে রয়েছে অত্যন্ত কঠোর এক নিয়মাবলি। কিন্তু অন্য আলোচনার অবকাশও থেকে যায়। যেমন, বলা হয়, অজাচার সমাজ-সংসারকে ছারখার করে দেয়। এর সঙ্গে এই বিতর্কও শুরু হয়: খুব জটিল ক্ষয়িষ্ণু ভরসাহীন পরিবারের দুটি সদস্যও নিজেদের বেছে নিতে পারে আবেগের হাল ধরতে। ফ্রান্সে নেপোলিয়ন ১৮১০ সালেই অজাচারকে অপরাধ ঠাওরে শাস্তি দেওয়া বন্ধ করেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সম্মতিসূচক যৌনাচারে সমাজের যে ক্ষতি হয়, তা প্রমাণসাপেক্ষ। এই দৃষ্টিভঙ্গির রদবদল আধুনিক আইনি ব্যবস্থায় ঘটে এবং শেষ অবধি কেউ অজাচারে অপরাধী সাব্যস্ত হলে বিতর্ক শুরু হয় মানবাধিকার মঞ্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে।

২০১২ সালে কলকাতার মঞ্চে ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের একটা পুরনো নাটক। রাজা অয়দিপাউস। আশ্চর্যের এই যে, কলকাতায় অয়দিপাউস কোরাসকে ছাপিয়ে আজও বলে উঠতে পারে না: হতে পারে পাপ, হ্যাঁ, কিন্তু শুধু যা দেখার নয় তা দেখে ফেলে অন্ধ করলাম না নিজেকে, দিলাম না নির্বাসন। বরং এই তীব্র কাম

যা উচ্ছ্রিত হয়েছিল মা ও সন্তানের পরস্পরের প্রতি, না জেনেই হয়তো, তা এ বার রাখব কোথায় না জেনে, কাম কী ভাবে স্নেহে রূপান্তরিত হবে না বুঝে নিলাম নির্বাসন। হ্যঁা কাম, শুধু পাপবোধ নয়। আর এখানেই কলকাতায় নাটকটির পুনর্পাঠে তাই আবারও অনালোচিত থেকে যায় সেই বোধ, যার নাম কামনা।

epsita.halder@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE