Advertisement
E-Paper

হ্যালো 70's

দুর্গাপুর আর ই কলেজ, যেটা এখন এন আই টি, ’৭৪-এর অগস্টে কোনও এক বর্ষার দিনে বাক্স, বিছানাপত্র নিয়ে সেই আর ই কলেজ-হস্টেলে এলাম। সময়টা জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। নানা কারণে এই সময়কাল পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-রাজনীতি তখন নকশাল আন্দোলন পেরিয়ে এক নতুন টালমাটালে। চারিদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, এর মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ভর্তি হলাম।

দেবাশীষ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০০:০৮
নতুন দল, নতুন সরকার। নির্বাচনে বিজয়ী জনতা পার্টি সরকারের বিদেশমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মার্চ, ১৯৭৭।

নতুন দল, নতুন সরকার। নির্বাচনে বিজয়ী জনতা পার্টি সরকারের বিদেশমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মার্চ, ১৯৭৭।

দুর্গাপুর আর ই কলেজ, যেটা এখন এন আই টি, ’৭৪-এর অগস্টে কোনও এক বর্ষার দিনে বাক্স, বিছানাপত্র নিয়ে সেই আর ই কলেজ-হস্টেলে এলাম। সময়টা জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। নানা কারণে এই সময়কাল পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-রাজনীতি তখন নকশাল আন্দোলন পেরিয়ে এক নতুন টালমাটালে। চারিদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, এর মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ভর্তি হলাম। মেঘলা দিন, নতুন পরিবেশ, কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে, মনটা খারাপ হয়েছিল। হস্টেলের এক একটা রুমে তখন তিন জন করে থাকতে হত। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে মনখারাপ ব্যাপারটা কাটিয়ে ধাতস্থ হলাম। নিয়মিত ক্লাস আর তার বাইরে গান্ধী মোড়, সিটি সেন্টার বা বেনাচিতি মার্কেট, এই ছিল তখনকার দিনে একঘেয়েমি-ভরা জীবনে স্বাদ পালটানোর জায়গা। সিটি সেন্টারে তখন ছিল একটা ছোট মার্কেট আর খাওয়াদাওয়ার জন্য মাদ্রাজি রেস্টুরেন্ট। গান্ধী মোড়-এ কিছু ঝুপড়ি দোকান। এখানে এলে মনে হত যেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হল। বিকেলে কলেজ থেকে হস্টেলে ফিরে খবরের কাগজটা পেতাম। আর ওটা নিয়েই আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি চলত। অনেক সময়ই এক একটা পাতা হয়তো তিন জনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, এমনটাও হত।

’৭৫-এর মাঝামাঝি ইমার্জেন্সি ঘোষণা হল। কলকাতা থেকে দূরে, কলেজের হস্টেলে থাকার জন্য তফাতটা খুব একটা বুঝতে পারিনি। তবে ক্লাস কামাই করা চলত না। অনুপস্থিত থাকলে ডেকে পাঠানো হত। অবশ্য খবরের কাগজ পড়ার স্বাদটা পালটে গিয়েছিল। ততটা আনন্দ পেতাম না। সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ চালু হওয়ার ফলে খবরগুলো সব কেমন যেন একপেশে। যদিও নিজেদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্কবিতর্ক সমান তালে চলত। বন্ধুদের মধ্যে ইমার্জেন্সি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বলার অভাব ঘটত না।

এক সময় ইন্দিরা গাঁধী ইমার্জেন্সি তুলে লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা করলেন। ’৭৭-এর মার্চে ভোট। খবরের কাগজ যেন আস্তে আস্তে তার আগের জায়গা ফিরে পেল। জনতা পার্টি তৈরি হওয়া, কলকাতার ব্রিগেডে জয়প্রকাশ নারায়ণের বিশাল জনসভা— সবই হেডলাইন হয়ে কাগজে বেরোতে লাগল। সমস্ত খবরাখবর জানার মাধ্যম ছিল রেডিয়ো আর খবরের কাগজ। টেলিভিশন তখনও দুর্গাপুরে পৌঁছয়নি।

হস্টেলে স্পষ্টতই দুটো দল তৈরি হয়েছিল, একটা কংগ্রেস, আর একটা জনতা পার্টির সমর্থনে। প্রায় প্রতি দিনই কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা। কাগজের খবরগুলো ইন্ধন জোগাত। এরই মধ্যে এক দিন তৃতীয় বর্ষের ফার্স্ট টার্মের পরীক্ষার সূচি প্রকাশ হল। দেখে মনখারাপ। যে দিন ইলেকশনের রেজাল্ট বেরোবে, তার পরের দিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম পরীক্ষা। সকাল আটটা থেকে। তার মানে এত উত্তেজনা, এত তর্কবিতর্ক, কিন্তু ইলেকশন রেজাল্ট ঘোষণার দিন আমাদের বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হবে। ধুস্স।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন সকাল থেকে প্রত্যেকেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। পরের দিনই পরীক্ষা। মাঝে মাঝে কেউ না কেউ আমাদের ঘরে আসছে খবর শোনার জন্য। তখন হস্টেলে যে গুটিকতক রেডিয়ো ছিল, তার একটা ছিল আমাদের ঘরে। কিন্তু বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সন্ধের সময় রেডিয়ো খুলতেই হল। খুলতেই চমক। কিশোরকুমারের গান বাজছে, যা বহু কাল রেডিয়োতে বাজত না। গান শেষ হলেই খবর শুরু হল। প্রথম ঘোষণায় এল কংগ্রেসের ৪টি আর জনতা পার্টির ১টি আসনে জয়লাভের খবর। তুমুল চিৎকার শুরু হল কংগ্রেস সমর্থক বন্ধুদের। কিছু ক্ষণ পর আবার খবর, এ বার কংগ্রেস ৮, আর জনতা পার্টি ৫। যারা কংগ্রেসের সমর্থনে চিৎকার করছিল, তারা থমকাল। অল্প কিছু ক্ষণ পরে কংগ্রেস যখন ১০ বা ১১, জনতা পার্টি সেই সংখ্যা পেরিয়ে গেল। হস্টেলে তখন তুমুল চিৎকার, স্টিলের থালা বাজানো। যেন মুক্তির আনন্দ।

আর পড়াশোনা করা গেল না। বই গুটিয়ে সেই আনন্দে সবাই শামিল হলাম। এক এক বার সর্বশেষ পরিস্থিতি রেডিয়োতে ঘোষণা হচ্ছে আর হস্টেল গর্জন করে উঠছে। গণনায় এগিয়ে-পিছিয়ে থাকার অনেক আসনের খবর জানা গেলেও, ইন্দিরা গাঁধী বা সঞ্জয় গাঁধীর আসনের কোনও খবরই পাওয়া যাচ্ছিল না। উপায়ই বা কী। রেডিয়োর বাইরে আর কোনও মাধ্যম নেই যা থেকে জানতে পারি।

বেশি রাতে ঘোষণা হল, রাজনারায়ণ কুড়ি হাজার ভোটে এগিয়ে আর সঞ্জয় গাঁধী পঞ্চাশ হাজার ভোটে পিছিয়ে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বহু ছেলে রাস্তায় নেমে এল। কাগজ পাকিয়ে মশাল তৈরি হয়েছে, স্টিলের থালাই কাঁসরঘণ্টার কাজ করছে। শুরু হল ক্যাম্পাস ঘোরা। ভাবখানা এই, পরীক্ষা অনেক দেওয়া যাবে কিন্তু এ উন্মাদনা সারা জীবনে হয়তো আর আসবে না।

পর দিন যথারীতি পরীক্ষা হল। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে খবর পেলাম, ইন্দিরা গাঁধী, সঞ্জয় গাঁধী হেরে গেছেন। কলকাতা দক্ষিণ থেকে হেরেছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, জিতেছেন প্রফেসর দিলীপ চক্রবর্তী। কাঁথি থেকে সমর গুহ। এমন আরও কত নাম।

অবশ্য এ সবের মাশুল আমাদের অনেককেই দিতে হয়েছে। বহু ছেলে ওই দিনের পরীক্ষায় ‘সাপ্লি’ (সাপ্লিমেন্টারি) পায়। তবু কাউকে কোনও আক্ষেপ করতে দেখিনি। পরে পরীক্ষা দিয়ে সাপ্লিমেন্টারি ক্লিয়ার করতে হয়।

সত্তরের দশকে ওই সময় পাঁচ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ হতে অনেক ক্ষেত্রেই বেশি সময় লেগে যেত। আমাদেরও পিছিয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৯-র ৩১ ডিসেম্বর দুর্গাপুরের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পর দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে হয়েছিল। আশির দশক শুরু। শুরু অনিশ্চয়তার। চাকরি পেতে হবে...

dgupta.cm@gmail.com

সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

debasish gupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy