Advertisement
১১ মে ২০২৪

ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন গালিলেও

সকলকে দিয়ে অভিনয়ের কাজটা হওয়ার নয়। এটা জোর দিয়ে বললে আমাদের এই অপেশাদার, সন্ধ্যাবেলার নাট্যচর্চার নড়বড়ে ইমারতটারই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। লিখছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়সকলকে দিয়ে অভিনয়ের কাজটা হওয়ার নয়। এটা জোর দিয়ে বললে আমাদের এই অপেশাদার, সন্ধ্যাবেলার নাট্যচর্চার নড়বড়ে ইমারতটারই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। লিখছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

যত দিন না শম্ভু মিত্রকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং বোঝার সুযোগ পেয়েছি তত দিন ওঁর সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ও মনগড়া ধারণা প্রশ্রয় পেয়েছে— যদিও সব সময়েই এক ধরনের সম্ভ্রমও মেশানো ছিল তার মধ্যে। জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে শম্ভু মিত্রের সার্বিক মূল্যায়নের কোনও প্রয়াস নয়, একটু ফিরে দেখা মাত্র।

প্রথম ধাক্কাটা লেগেছিল সম্ভবত আশির দশকের গোড়ায়, যখন আমাদের অনুরোধে তিনি আমাদের মহলাকক্ষে এসে দু’দিন ধরে নাট্য-বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিতে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। উঁচু উঁচু কাঠের সিঁড়ি টপকে আমাদের চার তলার মহলাকক্ষে অনায়াসে প্রবেশ করলেন এবং শতরঞ্চির উপর বসে পড়েই জানতে চাইলেন, ‘আমাকে(ই) কেন ডাকলে তোমরা? আমি কি এমন (বিশিষ্ট) কাজ করেছি যার জন্যে তোমরা আমার কাছে কিছু শুনতে চাইছ?’ অনেক কথা অনেকে মিলে বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই মূল সূত্রটিকে ছুঁতে পারছিলাম না। এবং না পাওয়ার দরুন মনে মনে ওঁর উপরেই রেগে উঠছিলাম। আপাত-সরল একটি প্রশ্নের উত্তরে যে গোটা দেশের একটা বিশেষ পর্বের নাট্যচর্চার ইতিহাস লুকোনো আছে— বিবর্তন, অগ্রগতি, সার্থকতা ছড়িয়ে আছে, সেটা বুঝতে পেরেই আমরা ছটফট করছিলাম— শেষ পর্যন্ত উনিই সংকট মোচন করেছিলেন। বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাস লিখতে হলে তার অনেকগুলো পাতা যে ওঁর জীবন ও কর্মের আলোচনায় ভরে যাবে, সেটা জেনেবুঝেই কোনও রকম ভনিতা বা বিনয়কে প্রশ্রয় না দিয়ে গণনাট্য ও তার পরবর্তী পর্যায়ে নব-নাট্যের ঐতিহাসিক রূপরেখা উনি প্রাঞ্জল ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কাজটা সহজ ছিল না।

‘গালিলেওর জীবন’

মাঝে আর তেমন যোগাযোগ ঘটেনি। তবে তার আগে বা পরে ওঁর পরিচালনায় এবং অভিনয়ে সমৃদ্ধ ‘বহুরূপী’র প্রায় সব ক’টি প্রযোজনাই দেখেছি— এ ছাড়া, অন্য যে সব প্রযোজনায় উনি অভিনেতা হিসেবে অংশ নিয়েছেন কোনওটাই বাদ দিইনি। সে আলোচনায় যাব না। কিন্তু, ব্যক্তিমানুষটিকে ঘিরে যে সব গল্প ছড়িয়েছে— ওঁর উন্নাসিকতা এবং সর্বোপরি ওঁর রাজনৈতিক অবস্থান সব সময় ওঁকে ঘিরে একটা বিতর্কের পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছে।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল যখন শম্ভু মিত্র ‘কলকাতা রেপার্টরি’ প্রযোজিত এবং ফ্রিৎস বেনেভিৎস নির্দেশিত ব্রেশট-এর ‘গালিলেওর জীবন’ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন। তখনই সত্যিকারের সুযোগ মিলল ওঁকে কাছ থেকে দেখার। নানা পরিস্থিতিতে ওঁর আচার-আচরণ লক্ষ করা এবং মহলায়, আলোচনা-বিতর্কে ওঁর সক্রিয় ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করা— সব কিছুর মাধ্যমে ওঁর ব্যক্তিত্বের একটা স্পষ্ট রূপ আমার চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম। পাণ্ডুলিপি সংশোধন থেকে শুরু করে চরিত্রায়ণে, পরিচালকের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে, সহ-শিল্পীদের সঙ্গে নিখুঁত বোঝাপড়ায় তাঁর গুণপণার নানা দিক প্রকাশিত হতে থাকল। যে কোনও ভাবের অন্তর্গূঢ় মূর্ত করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি তাঁর মেধা সদা তৎপর থাকত— হাঁকডাকের খুব একটা প্রয়োজন পড়ত না। উনি পাশে থাকলে ছোট-বড় যে কোনও চরিত্রের অভিনেতারই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কথা— যদি না তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অপ্রস্তুত শিল্পীকে অস্বস্তিতে না ফেলত।

শম্ভু মিত্রকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে চিনলাম। এবং কেন যে তাঁর সম্পর্কে আজগুবি গাল-গল্প গজিয়ে ওঠে তার কারণটাও বুঝলাম। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ ভাবে আমরা যে সব ঘটনার মুখোমুখি হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি, অজান্তে ভনিতার আশ্রয় নিয়ে ফেলি, সত্যকে সরাসরি ভাবে চিহ্নিত করতে না পেরে দ্বিচারিতা করি— কী জীবনে, কী চরিত্র রূপায়ণে— শম্ভু মিত্র সেটাকেই সরাসরি মোকাবিলার সাহস দেখান। সত্যকে এড়িয়ে জীবনের যথার্থ রূপ প্রকাশ পায় না, শিল্পও অসম্পূর্ণ থাকে— এই প্রত্যয় ছিল তাঁর। প্রতি দিন মহলায় চুলচেরা বিশ্লেষণে চরিত্রটিকে গড়তে দেখেছি। গড়ছেন, আবার ভাঙছেন, পর দিন আবারও সেই ভাঙাগড়ার খেলা। গালিলেও চরিত্রটির সঙ্গে তাঁর মিল নজরে পড়ার মতো। অতলান্ত গভীরে ডুবে গালিলেও জ্ঞানের নুড়ি সংগ্রহ করতেন। বার বার পরীক্ষা না করে বিজ্ঞানী গালিলেও কোনও সত্যকেই গ্রহণ করতেন না। সারা দিন পরীক্ষানিরীক্ষার পরে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছতেন সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই পরের দিনের কাজ শুরু হত। সন্ধ্যাবেলা আগের দিনের সিদ্ধান্তেই পৌঁছনোর পর এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন, ‘তা হলে কি এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত?’ শম্ভু মিত্রের চরিত্র বিশ্লেষণের পদ্ধতিটাও ওই রকম ছিল। এটা সত্যি যে, চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচালক ফ্রিৎস বেনোভিৎসের কিছু মতানৈক্য ঘটেছিল এবং সেই নিয়ে কিছু মুখরোচক মন্তব্য-মতামতও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু, সত্যিটা হল এই— এটা বিখ্যাত বিদেশি পরিচালক এবং বিখ্যাত দেশীয় নটের ‘ইগো’র লড়াই ছিল না। কিংবা ব্রেশট-এর অভিনয়-শৈলীর সঙ্গে শম্ভু মিত্রের পদ্ধতির কল্পিত সংঘাতও ছিল না। চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিরোধ বা মতানৈক্য যে কোনও সময়েই ঘটতে পারে। ঘটে থাকেও। ওই ঘটনাকে বাড়তি কোনও বিশেষণে ভূষিত না করাটাই সঙ্গত।

শিল্পীর তুলিতে: বিকাশ ভট্টাচার্য এবং সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের অঙ্কন।

শম্ভু মিত্র মোট ২২ রজনী ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অন্যতম সহ-পরিচালক হিসাবে প্রেক্ষাগৃহের একটি নির্দিষ্ট আসনে বসে থাকাই ছিল আমার দায়িত্ব। মোট ২১টি অভিনয় আমি দেখেছি। একটি দেখতে পারিনি। কারণ, বিকল্প অভিনেতা হিসাবে আমাকে মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছিল। প্রতি সন্ধ্যায় উদগ্রীব হয়ে দেখতাম তাঁর অসাধারণ অভিনয়। কখনও কখনও হয়তো বা চাইতাম উনি চরিত্রের অন্য কোনও ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন কোনও দিক মেলে ধরবেন। কিন্তু, খুব ছোটখাটো বদল ছাড়া মূল বিন্যাসে তাঁর অভিনয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য ফারাক আমার নজরে পড়েনি। এমন ভাবে গেঁথেছিলেন চরিত্রটিকে, প্রথম দৃশ্য থেকে পুরো তিন ঘণ্টার নাটক যেন গড়গড়িয়ে চলত। আমি প্রতি দিনই কোনও না কোনও জায়গায় বিস্মিত বা চমকিত হতাম। মহলায় বা অভিনয় চলাকালীন সাজঘরে অথবা উইং-এর পাশে উনি দাঁড়িয়ে থাকতেন— এতটুকু ‘টেনশন’ বা চাঞ্চল্য চোখে পড়ত না।

আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে টুকটাক লাগত। উনি সব সময়ই স্পষ্ট কথাই পছন্দ করতেন। সেই ভরসাতেই আমি হয়তো বা কখনও কখনও একটু বেশি সুযোগ নিয়ে ফেলেছি, কিন্তু কখনওই তাতে অশ্রদ্ধা বা ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়নি। সেই নিয়েও জলঘোলা হয়েছে। সেটার আঁচ পেয়েই উনি এক দিন আমার কাঁধে হাত রেখে, আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরেই বলেছিলেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে একটু বেশি বেশিই কথা বোলো। তাতে তোমার বন্ধুদের ভুল ধারণা কিছুটা কমবে।’ আমি তো এই আচরণের সহজ ব্যাখ্যাই করেছি, কিন্তু আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ এটারও অপব্যাখ্যা করেছেন। তাঁরা বোঝাতে চাইতেন যে, আমার কোনও আচরণে বা কথায় উনি আঘাত পেয়েছেন বলেই নাকি আমার সঙ্গে উনি ওই রকম ব্যবহার করেছিলেন। প্রয়োজনের স্বার্থে আমাকে অনেক সময় অনেক কথা বলতে হয়েছে। কিছু প্রস্তাব রাখতে হয়েছে। ওঁর বিবেচনায় যেগুলি গ্রাহ্য নয়, উনি সে সবই খারিজ করেছেন। কিন্তু তাতে তো ওঁকে আঘাত করা বা ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন ছিল না। আমি নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করি, যারা সব সময় ওঁর মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করতেন, তাঁদের অনেকের চেয়ে উনি আমাকে বেশি পছন্দ করতেন এবং আমার মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ওঁর পার্কসার্কাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে যে ক’দিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয়েছে, তাতে ওঁর স্মরণশক্তি, ইতিহাস-চেতনা এবং দার্শনিক উপলব্ধির আন্দাজ পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি, বিচারবোধ দেখে বিস্মিত হয়েছি।

নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরেও শম্ভু মিত্রকে চিনেছি তাঁর লেখালিখির মাধ্যমে। তাঁর অনেক লেখাই পড়েছি। লেখা নাটকও বেশ কয়েকটি পড়েছি। সব কিছুর মধ্যে তাঁর লেখা ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ নামে চটি বইটি আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করেছে। বইটি আসলে ওঁর দেওয়া একটি বক্তৃতার মুদ্রিত প্রতিলিপি। ছোট্ট বইটিতে উনি এমন কিছু প্রশ্নের বিচার করেছেন নাট্যকলার মূল শর্ত হিসাবে, যেগুলি বিশেষ ভাবে গ্রহণযোগ্য। সব থেকে মন কেড়েছে সেই অংশটি, যেখানে পরিচালকের ভূমিকা সম্পর্কে উনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, অভিনয় শিক্ষা দেওয়াটা পরিচালকের কাজ নয়। যদিও এখনও পর্যন্ত এ দেশীয় নাট্যচর্চায় বেশির ভাগ পরিচালকের মূল কাজই হল অক্ষম ও দুর্বল অভিনেতাদের তালিম দিয়ে মঞ্চে দাঁড়াবার উপযোগী করে তোলা। অনেকে এমনটাও বিশ্বাস করেন, এটাই পরিচালকের সব থেকে জরুরি কাজ। এই কাজটি না করলে তার আর কীই বা করার থাকে? উনি এই ধারণার মূল ধরে নাড়া দিয়েছেন। পরিচালকের কী কাজ সেটা এই পুস্তিকায় আলোচনায় ছিল না, তাই সে বিষয়ে উনি বেশি কিছু বলেননি। আসলে উনি যেটা বোঝাতে চেয়েছেন সেটা হল, অভিনয়টা শিখিয়ে-পড়িয়ে হওয়ার জিনিস নয় বোধহয়। যার মধ্যে ‘ন্যাক’ নেই তাকে অভিনেতা হিসেবে খাড়া করা যাবে এমন ঈশ্বর পরিচালক নন। আরও একটু স্পষ্ট করে উনি ঘোষণা করে দিতেই পারতেন যে, সকলকে দিয়ে অভিনয়ের কাজটা হওয়ার নয়। এটা নিয়ে উনি হয়তো আর বেশি দূর এগোতে চাননি বৃহত্তর কোনও দায়িত্ববোধ থেকেই। আগ বাড়িয়ে অমন কথা জোর দিয়ে বললে আমাদের এই অপেশাদার, সন্ধ্যাবেলার নাট্যচর্চার নড়বড়ে ইমারতটারই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

সবশেষে একটা প্রশ্ন: রবীন্দ্র নাট্য-চর্চায় শম্ভু মিত্র তথা ‘বহুরূপী’র অবদান ভোলার নয়। কিন্তু সেই চর্চার ধারা কি আমরা অব্যাহত রাখতে পেরেছি? বোধহয় না। এ ছাড়াও নাট্যদলের অভ্যন্তরীণ ও বহিরঙ্গের শৃঙ্খলা, বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ, অনুশীলন, নানা শিল্পের সমন্বয়ে নাট্য-প্রতিমা গড়ে তোলার যে কাজ, তার সূত্রপাত ও নিয়মিত চর্চার যে বাতাবরণ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি, তাও কি আগলে রাখতে পেরেছি আমরা?

ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE