Advertisement
২৫ মার্চ ২০২৩

নোবেল-যোগ্য গবেষণা ঘিরে বিতর্কের ঝড়

বিদ্যুৎ পরিবহণে বড় বাধা হল রেজিস্ট্যান্স বা রোধ। পরিবাহী তার বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে যেতে বাধা দেয়। বাধার কারণে কিছুটা বিদ্যুৎ নষ্ট হয়। যদি বাধা না থাকে, তবে যতটা বিদ্যুৎ পাঠানো হয় ততটাই পৌঁছয় পরিবাহীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।

অতিপরিবাহিতার পরিণাম: শূন্যে ভাসমান চুম্বক।

অতিপরিবাহিতার পরিণাম: শূন্যে ভাসমান চুম্বক।

পথিক গুহ 
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৯ ০১:৫৮
Share: Save:

ভারতে এক বিজ্ঞান গবেষণা এখন বিশ্বের নজরে। কারণ, সাফল্যটি, বিশেষজ্ঞদের মতে, নোবেল পুরস্কারের যোগ্য। এবং সাফল্যটি বিতর্কিত। বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর দুই বিজ্ঞানী অংশু পাণ্ডে এবং দেবকুমার থাপা সাড়া ফেলে দিয়েছেন স্বাভাবিক উষ্ণতায় সুপারকন্ডাক্টিভিটি বা অতিপরিবাহিতা আবিষ্কার করে।

Advertisement

বিদ্যুৎ পরিবহণে বড় বাধা হল রেজিস্ট্যান্স বা রোধ। পরিবাহী তার বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে যেতে বাধা দেয়। বাধার কারণে কিছুটা বিদ্যুৎ নষ্ট হয়। যদি বাধা না থাকে, তবে যতটা বিদ্যুৎ পাঠানো হয় ততটাই পৌঁছয় পরিবাহীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। অতিপরিবাহিতা হল রোধ বা বাধাহীন বিদ্যুৎপরিবহণ। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হাইকে ক্যামারলিং ওন্‌স এটা আবিষ্কার করেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি অধিকাংশই যেহেতু বিদ্যুৎপরিবহণ-নির্ভর, এবং প্রতিটি যন্ত্রের ক্ষেত্রেই রোধের কারণে বিদ্যুতের অপচয় অবশ্যম্ভাবী, তাই অতিপরিবাহিতার নাম শুনলে বিজ্ঞানীরা লোভাতুর হয়ে ওঠেন।

ক্যামারলিং যে অতিপরিবাহিতা আবিষ্কার করেছিলেন, তা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক অনেক নীচে। তার মানে, অতিপরিবাহিতা পেতে হলে আগে খুব, খু-উ-ব ঠান্ডার আয়োজন করতে হয়। সেটা বিশাল এক সমস্যা। সমস্যা কমে যদি একটু বেশি উষ্ণতায় অতিপরিবাহী পদার্থ আবিষ্কার করা যায়। সেই লক্ষ্যেই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের দৌড় অব্যাহত।

অতিপরিবাহিতা এতই লোভনীয় যে, ১৯৮৬ সালে সুইৎজ়ারল্যান্ডের জ়ুরিখে আইবিএম গবেষণাগারে দুই বিজ্ঞানী জর্জ বেদনর্জ এবং অ্যালেক্স মুলার যখন মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কিছু কিছু পদার্থে ওই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন, তখন পৃথিবীতে হইহই পড়ে। এতটা সাড়া ফেলে ওঁদের সাফল্য যে, পরের বছরই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় বেদনর্জ এবং মুলারকে। আমেরিকায় পদার্থবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে ওঁদের কাজ যখন রিপোর্ট করা হয়, শ্রোতার আসনের অতিরিক্ত গবেষক তা শুনতে যান বলে হলের দরজা ভেঙে লোক ঢুকে পড়ে। বিজ্ঞানীদের ওই সম্মেলন বিখ্যাত হয়ে আছে ‘উডস্টক অব ফিজিক্স’ হিসেবে। ১৯৬৯ সালে নিউ ইর্য়ক শহরের অদূরে সঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষে যে উন্মাদনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা স্মরণে যে ওই নামকরণ, সেটা বলাই বাহুল্য।

Advertisement

২০০১ সালে বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হয়েছিল জার্মান বিজ্ঞানী জান হেন্ড্রিক শন-কে ঘিরে। অনেক চমকপ্রদ আবিষ্কারের দাবি করেছিলেন তিনি। আবিষ্কারের তালিকায় ছিল, অতিপরিবাহিতাও। স্বীকৃতি স্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কারও জোটে ওঁর। পরে দেখা যায়, অনেক দাবির মতো অতিপরিবাহিতাও ভুয়ো। পুরস্কারগুলো কেড়ে নেওয়া হয় ওঁর থেকে।

অংশু এবং দেব বিশ্ববিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন গত বছর ২৩ জুলাই। গবেষণায় সাফল্য জার্নালে ছাপার আগে যে ইন্টারনেট পোর্টালে বিজ্ঞানীরা এখন তা পোস্ট করেন, সেই এআরএক্সআইভি-তে ওঁদের গবেষণা প্রকাশ করে। পেপারে ওঁরা দাবি করেন, এমন কিছু পদার্থ আইআইএসসি-র ল্যাবরেটরিতে বানানো গিয়েছে, যে সব বিদ্যুৎ পরিবহণ করে স্বাভাবিক উষ্ণতায়। বলা বাহুল্য পেপারটি ছাপা হতেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহল কৌতূহলী। একেবারে আমাদের চারপাশের উষ্ণতায় অতিপরিবাহিতা!

প্রায় এ রকমই কৌতূহল জাগিয়েছিল বিজ্ঞানের আর এক ঘোষণা। ১৯৮৯ সালে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী স্ট্যানলি পন্‌স এবং মার্টিন ফ্লেইশম্যান এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, তারা টেস্ট টিউবের মধ্যে ‘ফিউশন’ বিক্রিয়া ঘটাতে পেরেছেন। ফিউশন হল চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে একটা হিলিয়াম পরমাণু বানানো। সূর্যে বা যে কোনও নক্ষত্রে যা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। হাইড্রোজেন বোমায় যা ঘটে এক মুহূর্তে। সূর্য বা যে কোনও নক্ষত্রের আগুন বা আলোর মূলে ওই ফিউশন বিক্রিয়া। নক্ষত্রে বা হাইড্রোজেন বোমায় যা ঘটে, তা সম্ভব হয়েছে টেস্টটিউবে? তবে তো পৃথিবীতে শক্তি সঙ্কট নিমেষে শেষ! সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা (এই ভারতেও) ঝাঁপিয়ে পড়েন টেস্টটিউবে ‘ফিউশন’ দেখতে। অনেকেই তা দেখতে পান, অনেকেই তা পান না। ক্রমে দেখা যায় যাঁরা তা পান, তাঁরাও আসলে বিভ্রান্তিরই শিকার। শেষমেশ টেস্টটিউবে ফিউশন আবিষ্কার ঠাট্টার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

গত বছর অংশু এবং দেবের পেপারটি ঘিরেও বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক কৌতূহল তুঙ্গে ওঠে। ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক গবেষণাগারেই বিজ্ঞানীরা পরখ করে দেখতে চান ওঁদের দাবি ঠিক কি-না। বিজ্ঞানে এটাই দস্তুর। দাবি যদি অন্যদের পরীক্ষায় সত্যি প্রমাণ হয়, তবেই তা স্বীকৃতি পায়। কিন্তু অংশু এবং দেব যে সব পদার্থে স্বাভাবিক উষ্ণতায় অতিপরিবাহিতা দেখেছিলেন বলে দাবি করেন, সে সব পদার্থ কীভাবে তৈরি করেছেন, তার বিশদ বিবরণ ছিল না। এ প্রসঙ্গ, এবং পেপারে প্রকাশিত তথ্যের ত্রুটি ধরে, বিজ্ঞানীরা ওঁদের সমালোচনায় মুখর হন। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। টুইটারে আইআইএসসি-র দুই বিজ্ঞানীর সমালোচনায় মুখর হন আমেরিকায় ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-র তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান স্কিনার। ওঁর বক্তব্য: অংশু এবং দেবের গবেষণার রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ এবং সে কারণে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মুম্বইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর প্রতাপ রায়চৌধুরী, যাঁর গবেষণা নিম্নতাপ বিষয়ে, তিনি ফেসবুকে অংশু এবং দেবের গবেষণা বিষয়ে পক্ষে এবং বিপক্ষে মন্তব্য তুলে ধরেন। ওঁর সিদ্ধান্ত: ‘‘বিজ্ঞান যাঁর উপর ভর করে এগোয় সেই স্ব-সংশোধনী পদ্ধতি— অন্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা দাবি পরীক্ষা— এক্ষেত্রে ভাল ভাবে কাজ করেনি।’’

সমালোচনার জবাব দিতে অংশু এবং দেব ২১ মে ওই এআরএক্সআইভি-তেই আবার নতুন করে পেপার লিখেছেন। এ বার ওঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও কিছু গবেষক। এ বার ওঁরা বলেছেন অতিপরিবাহী পদার্থ কীভাবে তৈরি হয়েছে। ন্যানো (এক মিলিমিটারের ১,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ) মাত্রার রুপোর ফিল্ম এবং গুলি সোনার পাতের মধ্যে গ্রথিত করে তৈরি হয়েছে ওই অতিপরিবাহী পদার্থ।

নতুন পেপারে দারুণ উৎসাহিত আইআইএসসি-র অধ্যাপক টিভি রামকৃষ্ণন। বলেছেন, ‘‘ওঁদের এই সাফল্য যদি সত্যি হয়, তা হলে আমি বলব, ১৯২৮ সালে রামন এফেক্ট আবিষ্কারের পর এটাই এ দেশে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের সেরা সাফল্য।’’ আর স্কিনার? এ বার তাঁর মন্তব্য, ‘‘সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমি খুশি। এটা এখন বিজ্ঞানের খবর। সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্যান্ডালের খবর নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.