প্রতীকী ছবি।
অশনি সংকেত পাওয়া গিয়েছিল মাস কয়েক আগেই৷ যখন ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ ধস নেমেছিল অ্যাণ্টার্কটিকার ‘লার্সেন-সি’ আইস শেল্ফের ‘এ-৬৮’ হিমশৈলে৷
প্রায় ৩২টি কলকাতা শহরের সমান ওই হিমশৈল ভেঙে পড়ার খবরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের দিকেই আঙুল উঠতে শুরু করেছিল৷ সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ‘ভয়ঙ্কর’ এক সতর্কবার্তা বিজ্ঞানীদের৷ এ বার তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ভয়াবহ তাপপ্রবাহের৷ আর এই তাপপ্রবাহের মুখে পড়তে চলছে আমাদের দেশ৷ বিশেষ করে উত্তর ভারত এবং তার সংলগ্ন এলাকা৷ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারেন পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষজনও৷
আরও পড়ুন: সৌরমণ্ডলের বাইরে এই প্রথম চাঁদ দেখল মানুষ
সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির একদল গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই শতাব্দীর শেষে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মূল কারণ হতে চলেছে–কার্বন নির্গমনের হার সন্তোষজনক ভাবে না কমা৷ পাশাপাশি মাটির স্বাভাবিকতা নষ্ট হওয়াকেও অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন তাঁরা৷ গবেষকরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে কৃষিকাজ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ ওই এলাকায় জলস্তর শুকিয়ে যাবে। তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেবে৷
উষ্ণতা বাড়বে দিল্লি, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে।
কিন্তু, কেন এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে? কেনই বা উত্তর ভারত বা সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকাকেই বেছে নেওয়া হচ্ছে?
এই কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভৌগোলিক, অধ্যাপক ড. শিশির চ্যাটার্জি জানাচ্ছেন, গরম ও ঠাণ্ডার ভারসাম্য বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে— ৫০-৬০ হাজার বছর আগে ওই অঞ্চলের গঠনগত প্রকৃতি৷ তেমনই ২০-২৫ বছর আগের পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখা হয়৷ তাঁর মতে, “ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সময় ওই এলাকার উপরই সব থেকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছিল। সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকা (যেখানকার মাটি কৃষির জন্য সব থেকে বেশি উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল), পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যকে বেছে নেওয়া হয়৷ কৃষিক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়নের তাগিদে জমিতে অধিক পরিমানে সার, কীটনাশক, উন্নত ধরণের বীজ ব্যবহার শুরু হয়৷ জরুরিভিত্তিতে তার সুফলও মেলে৷ কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য আসে৷ কিন্তু, দীর্ঘকালীন দিক থেকে তার ‘কুফল’ দেখা যায়৷ কারণ, অতি অল্প সময়ের মধ্যে জমিতে অত্যাধিক পরিমাণ রাসায়নিক, সার, কীটনাশক ব্যবহার, মাটির স্বাভাবিক চরিত্রকে নষ্ট করে দেয়৷ বিনষ্ট হয়েছে জলচক্র৷”
আরও পড়ুন: অকারণ ভয়ে আর ভুগতে হবে না? পথ দেখালেন দুই বাঙালি
অধ্যাপক চ্যাটার্জির কথার সূত্র ধরেই পুণের ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের (India Meteorological Department) গবেষক ড. এ কে শ্রীবাস্তব জানাচ্ছেন, ভারতে স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ০.৪৮ হেক্টর৷ ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ০.১৪ হেক্টরে। ড. শ্রীবাস্তবের কথায়, “এই অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপ জমির উর্ব্বরতা, স্থানীয় জলবায়ুর উপর মৃত্তিকার প্রভাব ও সামগ্রিক খাদ্য সুরক্ষাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷” তিনি আরও জানান, বর্তমানে দেশে মাথাপিছু বন সম্পদের পরিমাণ মাত্র ০.৫ হেক্টর, যেখানে আন্তর্জাতিক গড় মান ২ হেক্টর৷ বন সম্পদের এই স্বল্পতা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতাকে আরও প্রকট করে দিচ্ছে৷
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ ড. দিলীপ কোথওয়ালের মত, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি জানাচ্ছেন, বিশ্বের মোট জমির ২.৫ শতাংশ বা প্রায় ৩২৮.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর ভারতে৷ এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ বা ১৪২ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি৷ এই জমি মূলত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কাজের ফলে দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে চলেছে৷ যা জলচক্র, বাস্তুতন্ত্র এবং আঞ্চলিক জলবায়ুকে নষ্ট করছে।
পঞ্জাব, হরিয়ানার উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক-গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক জলচক্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ওই সব এলাকায় জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে চলেছে৷ এ জন্যই পঞ্জাব-তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষজনের মধ্যে আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ৷ আজ থেকে কুড়ি বছর আগে জনসংখ্যা যা ছিল বর্তমানে তা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু, বাড়েনি জমির পরিমাণ৷ জনসংখ্যার অত্যাধিক চাপের জন্য এক ফসলি, দোফসলি জমির উপর চাপ বেড়েছে৷ পাশাপাশি, জলের অভাব তৈরি হচ্ছে৷
এ প্রসঙ্গে একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক৷ ভারতে ২০১১ সালে মোট জলের চাহিদা ছিল ৮২ হাজার কোটি কিউবিক মিটার৷ কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রকের এক রিপোর্ট বলছে, ২০৫০ সালে এই চাহিদা পৌঁছবে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কিউবিক মিটারে৷ এর একটা বিপুল পরিমাণ খরচ হবে কৃষিকাজে৷ আর ওই বিপুল পরিমাণ জলের চাহিদা মেটাতে গেলে নষ্ট হবে মাটির নিচের জলচক্র৷
কেমন হবে জলের চাহিদা
২০১১ সালে জলের চাহিদা ছিল ৮২ হাজার কোটি কিউবিক মিটার
২০৫০ সালে এই চাহিদা পৌঁছবে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কিউবিক মিটারে
কারণ, এই পরিমাণ জলের চাহিদা মেটাতে ভয়ঙ্কর চাপ বাড়বে। সাম্প্রতিকতম এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় ৫৩ শতাংশ বা ১৭৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি উৎকর্ষ হ্রাস ও ভূমিক্ষয়জনিত সমস্যায় ভুগছে৷ ভারতে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে জমি ক্ষয়ের পরিমাণ বার্ষিক পাঁচ হাজার মিলিয়ন টন৷ এই পরিমাণ মৃত্তিকা ক্ষয় এবং কার্বন নির্গমনের ফলে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র, জীবন চক্র, জল চক্র বিনষ্ট হচ্ছে৷ এ সব কারণেই উত্তর ভারত—বিশেষ করে গুরুগ্রাম, নয়ডা, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশের পরিস্থিতি আগামী দিনে আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে৷ গবেষকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের যে সব শহরে দূষণের হার সব থেকে বেশি, তার মধ্যে প্রথম দিকে রয়েছে দিল্লির মতো শহর৷
গবেষকরা তাঁদের মন্তব্যের অন্যতম উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছেন উত্তর চিনের প্রসঙ্গ৷ তাঁদের মতে, ১৯৪৯-এর বিপ্লবের পর গোটা বিশ্বে একা হয়ে গিয়েছিল মাও সে তুং-এর দেশ৷ সেই পরিস্থিতিতে দ্রুত নিজেকে সব দিক থেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ করে তুলতে লড়াই শুরু হয় চিনে৷ ফল স্বরূপ, কয়েক বছরের মধ্যেই চিনে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে৷ কিন্তু, সেই ঘটনার ‘কুফল’ ভুগতে হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মকে৷ সে সময় মাটির উপর অত্যাধিক ‘চাপ’ দেওয়ার ফলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে জমির স্বাভাবিক চক্র৷ নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য৷ ফি বছর চিনে (বিশেষ করে উত্তর প্রান্তে) বন্যা, খরা কখনও বা অত্যাধিক তুষার পাতের জন্য এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়াকেই দায়ী করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ওজন আধুলির মতো! পৃথিবীকে পাক মারছে ৬ মহাকাশযান
২০০৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার নিম্ন-গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিল৷ তখন কেন্দ্রের সেই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র এবং আরও অনেকে৷ তাঁদের যুক্তি ছিল, এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নষ্ট হবে মাটির ভারসাম্য৷ সাম্প্রতিক গবেষণা সেই আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করল৷
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy