Advertisement
E-Paper

হিরের হারপুন গেঁথে ধূমকেতু ধরবে নাসা

শিকলের মাথায় বাঁধা হিরের বর্শা গেঁথে দেওয়া হবে ধূমকেতুর পিঠে। এ ভাবেই এ বার ধূমকেতুতে নামবে মহাকাশযান।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ১২:৫১
এ ভাবেই বর্শা ছোঁড়া হবে ধূমকেতু লক্ষ্য করে। ছবি নাসার সৌজন্যে।

এ ভাবেই বর্শা ছোঁড়া হবে ধূমকেতু লক্ষ্য করে। ছবি নাসার সৌজন্যে।

শিকলের মাথায় বাঁধা হিরের বর্শা গেঁথে দেওয়া হবে ধূমকেতুর পিঠে। এ ভাবেই এ বার ধূমকেতুতে নামবে মহাকাশযান।

জ্বালানি খরচ বাঁচাতে এ বার ধূমকেতুতে এ ভাবেই নামবে মহাকাশযান থেকে ছোঁড়া ল্যান্ডার। তা একই ভাবে নামানো হবে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জ বা, অ্যাস্টরয়েড বেল্টে। নির্ঝঞ্ঝাটে ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের কক্ষপথে মহাকাশযানের ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হবে।

মোদ্দা কথাটা হল, এ বার ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করবে নাসা। পার্থিব জ্বালানির খরচ বাঁচাতে। ধূমকেতু বা, নক্ষত্রপুঞ্জে নেমে পড়া বা তাদের কক্ষপথে নির্ঝঞ্ঝাটে, দ্রুত ঢুকে পড়ার জন্য এ বার মহাকাশযানের জ্বালানির চাহিদা মেটাবে কক্ষপথে চক্কর মারা ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের নিজেদের গতিবেগ। মানে, তারা যে গতিতে কক্ষপথে ছুটে চলেছে, সেই গতি জন্ম দিচ্ছে প্রচুর গতিশক্তি বা কাইনেটিক এনার্জির। সেই শক্তিটাই হবে মহাকাশযানের জ্বালানি। আর সেই জ্বালানিটা পাওয়ার জন্য ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জকে বর্শা দিয়ে গেঁথে মহাকাশযানকে তাদের ছুঁয়ে ফেলতে হবে। ছুঁয়ে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে! ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের গতিশক্তিই মহাকাশযানের জ্বালানির চাহিদা মেটাবে। এ ভাবেই এ বার ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করবে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা, ইএসএ।

চলন্ত বাসে উঠতে গেলে আমি-আপনি যেমন ফুটবোর্ডের হাতল ধরে বাসের সঙ্গে কিছুটা দৌড়ে, তার পর লাফিয়ে উঠে পড়ি বাসে, তেমনই এ বার শিকল ছুঁড়ে আর শিকলের শেষ মাথায় বাঁধা বর্শা ধূমকেতুর পিঠে গেঁথে, ল্যান্ডার নামানো হবে ধূমকেতুতে। যে ভাবে আমরা বাসে উঠি, সে ভাবেই ধূমকেতুতে নামবে ল্যান্ডার। সে ভাবেই ধূমকেতুর কক্ষপথে সহজে ঢুকে পড়তে পারবে মহাকাশযান। ওঠার আগে চলন্ত বাসের হাতল ধরে কিছুটা পথ দৌড়ে নিলে আমরা একটা গতিজাড্য পাই। যা না পেলে চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতাম। বর্শা দিয়ে ধূমকেতুকে গেঁথে ধূমকেতু থেকে সেই গতিজাড্যটাই নেবে মহাকাশযান। যাতে অনায়াসেই ঢুকে পড়তে পারে ধূমকেতুর কক্ষপথে।

মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনির মতো গ্রহ আর তাদের উপগ্রহগুলির কক্ষপথে মহাকাশযানের চট করে ঢুকে পড়তে তেমন ঘাম ঝরাতে হয় না। তাদের মাটিতে নেমে পড়তেও অসুবিধা হয় না ল্যান্ডার বা রোভারগুলির। কারণ, ওই গ্রহ বা উপগ্রহগুলির অভিকর্ষ বল খুব জোরাল। যা, পাশ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাওয়া মহাকাশযানকে টেনে তাদের কক্ষপথে ঢুকিয়ে নেয়। কিন্তু, ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো ছোট ছোট মহাজাগতিক বস্তুগুলির কক্ষপথে খুব সহজে ঢুকে পড়তে পারে না মহাকাশযান। ওই ছোট ছোট মহাজাগতিক বস্তুগুলির অভিকর্য বল অত্যন্ত দুর্বল হয় বলে। আর তাই ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের কক্ষপথে মহাকাশযানকে ঢুকিয়ে দিতে গিয়ে প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়ে যায়। সামান্য যেটুকু জ্বালানি তার পর মহাকাশযানের ট্যাঙ্কারে থাকে, তা দিয়ে ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জের কক্ষপথে মহাকাশযানকে বেশি দিন রাখা যায় না। খুব বেশি জ্বালানি নিয়েও মহাকাশে পাড়ি জমাতে পারে না মহাকাশযান, মূলত, দু’টি কারণে। সেই জ্বালানি খুব দুর্লভ। তা বানানোর খরচও যথেষ্ট। বেশি জ্বালানি ছোটার গতিও কমিয়ে দেয় মহাকাশযানের। এর জন্যই গত নভেম্বরে ‘চুরিমোভ গেরাশিমেঙ্কো’ ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢুকতে আর ওই ধূমকেতুতে ‘ফিলি’ ল্যান্ডার নামাতে খুব অসুবিধা হয়েছিল ইএসএ-র রোসেটা মহাকাশযানের।

ওই সব সমস্যা মেটাতেই ধূমকেতুতে নামার জন্য এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসা-র জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির এক গবেষকদল। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাসাহিরো ওনো। এ মাসেই ওনো তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছেন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ অ্যারোনেটিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্স স্পেস কনফারেন্সে। গবেষণাপত্রটি ‘নেচার-কমিউনিকেশনস’ জার্নালের সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

নাসা-র ওই গবেষকদলের অন্যতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিল্লোল করগুপ্ত টেলিফোনে জানিয়েছেন, ‘‘এই অভিনব পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হলে শুধু ধূমকেতু বা নক্ষত্রপুঞ্জ কেন, আমাদের সৌরমন্ডল বা গ্যালাক্সির গন্ডি পেরিয়েও অন্য মহাজাগতিক বস্তু বা দূরবর্তী সৌরমন্ডলগুলির গ্রহে-উপগ্রহে মহাকাশযান পাঠাতে আর অসুবিধা হবে না। জ্বালানির প্রয়োজন ও খরচও অনেকটা কমে যাবে। নাসা এবং ইএসএ আর ৬ মাসের মধ্যেই এই প্রযুক্তি, পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করবে।’’

মহাকাশযানে দুর্লভ জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজন কেন কমবে এই অভিনব পদ্ধতিতে?

লরেল থেকে ই মেলে পাঠানো জবাবে হিল্লোলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘মহাকাশযানগুলি গ্রহ-উপগ্রহের পাশ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে আরও দূরে চলে যেতে চায়। কোনও গ্রহের কক্ষপথে তাদের ঢোকানোর জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে রিমোট কন্ট্রোলে তাদের গতি কমানো হয়। এটা করতে গিয়ে প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়ে যায়। জোর করে গতি কমানো হলেই নিউটনের তৃতীয় সূত্র (প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে) মেনে মহাকাশযান তখন উল্টো মুখে পৃথিবীর দিকে ছুটতে শুরু করে। তখনই গ্রহের অভিকর্ষ বল মহাকাশযানটিকে টেনে তার কক্ষপথে ঢুকিয়ে নেয়। ওই সময় উল্টো দিকে না ছুটলে অন্য গ্রহের জোরাল অভিকর্ষ বল মহাকাশযানটিকে তার মাটিতে আছড়ে ফেলত। যে কারণে পৃথিবীতে উল্কাপাত হয়। ধূমকেতুর মতো ছোট মহাজাগতিক বস্তুগুলির অভিকর্ষ বল অতটা জোরাল নয়। তাই তাদের কক্ষপথে মহাকাশযানকে ঢোকাতে আরও বেশি জ্বালানি খরচ করতে হয়। নতুন পদ্ধতিতে যার প্রয়োজনই থাকবে না। কারণ, শিকল আর বর্শাই মহাকাশযানকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি জুগিয়ে দেবে। যে জ্বালানিটা আসবে ধূমকেতুর নিজের গতিশক্তি থেকে। ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢুকতে মহাকাশযানের গতি কমানোর জন্য যে প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়, নতুন পদ্ধতিতে সেটাও হবে না।

এর কারণ, শিকল আর বর্শা যত জোরে মহাকাশযান থেকে ছোঁড়া হবে, তা তত জোরেই মহাকাশযানকে উল্টো মুখে ছোটাবে, নিউটনের সূত্র মেনে। এর ফলে, মহাকাশযানকে উল্টো মুখে ছোটাতে বাড়তি জ্বালানিও লাগবে না।’’

comet jpl nasa hitchhiker harpoon
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy