Advertisement
E-Paper

জিন, হরমোন, পরিবেশ পিছিয়ে রাখছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের?

‘ছাত্র’ আছে ভূরি ভূরি। ভাল ‘স্যর’ নেই এক জনও। নেই আলো, বাতাস খেলার ‘ক্লাস রুম’ও। তাই ‘মার্কশিট’ ভাল হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে কেন তেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছেন না ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা? হাল ফেরানোর কি কোনও উপায় নেই? থাকলে, সেগুলি কী কী? তার বিশ্লেষণ করলেন বিশিষ্ট ক্রীড়া বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, জিনতত্ত্ববিদরা। আজ প্রথম কিস্তি।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ১০:১৮
রিও অলিম্পিক্সের আসরে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা।

রিও অলিম্পিক্সের আসরে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা।

‘ছাত্র’ আছে ভূরি ভূরি। ভাল ‘স্যর’ নেই এক জনও। নেই আলো, বাতাস খেলার ‘ক্লাস রুম’ও। তাই ‘মার্কশিট’ ভাল হচ্ছে না।

চিন, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানির সঙ্গে এটাই ফারাক ভারতের। তাই ৩১ তম অলিম্পিক্সের আসরেও ভারতের প্রাপ্তির ঝুলিতে একটা রূপো, একটা ব্রোঞ্জ ছাড়া আর কোনও মেডেল নেই।

অন্য দিকে, প্রাকৃতিক বাধা আর যাপনের জটিলতা কাটিয়ে ওঠার যে অদম্য জেদ রয়েছে ইথিওপিয়া, অ্যাঙ্গোলা সহ আফ্রিকার দেশগুলির বা দুর্বল অর্থনীতির লাতিন আমেরিকার ক্রীড়াবিদদের, তাতে কিছুটা খামতি রয়েছে ভারতীয়দের। আর সেই জেদটাকে বাড়াতে যে উৎসাহের হাওয়া-বাতাস প্রয়োজন, তাতেও যথেষ্টই অভাব রয়েছে ভারতীয় ক্রীড়া জগতের ‘জহুরি’দের। তার সঙ্গে রয়েছে জিন, পরিবেশ আর হরমোনের পিছুটান। যদিও সেই পিছুটানের বাধা কাটিয়ে ওঠার ‘রাস্তা’ আছে। কিন্তু সেই ‘রাস্তা’গুলি ঠিক মতো খুঁজে দেখা হচ্ছে না।

এমনটাই বলছেন দেশের ক্রীড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানী, জিনতত্ত্ববিদ, ডাক্তার ও বায়োলজিস্টরা। তাঁদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে নজরকাড়া সাফল্যের জন্য প্রাথমিক ভাবে জহুরিদের ভূমিকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। তার পর আসে প্রশিক্ষণ। খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক শক্তি বাড়ানোর পদ্ধতি-প্রকরণ, আবশ্যকীয় ক্রীড়া সরঞ্জামের বিষয়গুলি। তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ক্রীড়া নীতির। রাজ্যে রাজ্যে ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের। খেলা শুধুই দেশে, বিদেশে পদক জয়ের জন্য নয়, চিকিৎসার খরচ, ওষুধের ব্যবহার ও তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে খেলা যে রেহাই পাওয়ারও একটা হাতিয়ার, প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেই ধারণাটা গড়ে তোলারও।

জহুরিদের দূরদর্শিতার কতটা প্রয়োজন, তার দু’টো দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন ক্রীড়া চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী প্রজন্মের ভাল সুইমার (সাঁতারু) বানানোর জন্য দক্ষ পুরুষ ও মহিলা সাঁতারুদের মধ্যে প্রজনন করানো হত চিনে। জলজ প্রাণীর সাঁতারে দক্ষতার স্বাভাবিক গুণ অর্জন করতে জলের তলায় রেখে প্রজনন করানো হত চিনা সাঁতারুদের। গর্ভাবস্থার গোটা সময়টা মহিলা সাঁতারুদের রাখা হত জলের তলায় সন্তান প্রসব করানো ও সেই সন্তানের কয়েক মাস বয়স পর্যন্ত। ফুটবলে দুর্দান্ত হেডার আর ভাল বাস্কেটবল প্লেয়ার বানাতে বেশ লম্বা মার্কিন ফুটবলার/বাস্কেটবলারদের সঙ্গে দেশের ফুটবলার/ বাস্কেটবলারদের প্রজনন করানো হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়।’’


বাধা জয় করেছেন যাঁরা। দীপা কর্মকার।

প্রাকৃতিক ও শারীরিক বাধা কাটিয়ে ওঠার অদম্য জেদই বহু ক্রীড়াবিদকে সেরা বানিয়েছে। এ দেশে, বিদেশে। ভেলোরের খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক, দেশের পুরোধা জিনতত্ত্ববিদ অলোক শ্রীবাস্তব তুলে ধরেছেন তেমনই কয়েকটা দৃষ্টান্ত। তিনি বলেছেন, ‘‘সাধারণ ভাবে আমাদের বংশানুক্রমে অর্জিত শক্তি আর পরিবেশ বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তি অর্জনের ক্ষমতা থাকে সমান সমান। ৫০-৫০। কিন্তু জেদ বা সাফল্যের খিদে দিয়ে অনেক দুর্ল্যঙ্ঘ বাধাই টপকে যাওয়া যায়। যেমন, বিজয় অমৃতরাজ। জন্মাবধি আ্যাজমার রোগী। অসম্ভব শ্বাসকষ্টে ভুগতেন। কোনও চিকিৎসায় কাজ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে শুধুই বাঁচতে হবে, এই জেদটুকু নিয়ে টেনিস খেলতে শুরু করেছিলেন।


গত ৯ বছর ধরে ট্র্যাকে আগুন ঝরাচ্ছেন বোল্ট।

সেই জেদ থেকে টেনিসে সাফল্যও পেতে শুরু করেছিলেন। আর সেই সাফল্যের খিদেটাই তাঁকে টেনিসের বিজয় অমৃতরাজ বানাতে পেরেছিল। পোলিওয় আক্রান্ত এমিল জ্যাটোপেক বাঁচার জন্য দৌড়তে শুরু করেছিলেন। যা পরে জ্যাটোপেককে দুনিয়ার সেরা স্প্রিন্টার বানিয়েছিল। স্বাস্থ্য হল শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়াকর্মের যোগফল। যা খেলাধুলোয় সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু তাতেও বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় না। সেটা হয় তখনই, যখন মদত বা উৎসাহটাও তার সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন, পেলের বাবা। তাঁর উৎসাহ না পেলে ‘ফুটবল সম্রাট’ হতে পারতেন কি না পেলে, তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয় রয়েছে। মায়ের অমন উৎসাহ না পেলে ববি চার্লটনের মতো ফুটবলার জন্মাতেন না। এইখানেই জহুরির ভূমিকা।’’

ভারতের ক্রীড়া ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘাটতিটা হল, একেবারে শৈশবে দেশের অবহেলিত, প্রায়-বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকে ক্রীড়া প্রতিভা (স্পোর্টস ট্যালেন্ট) খুঁজে বের করা। যাকে বলে, ‘স্পটিং’। পুরুলিয়া বা সাঁওতাল পরগনায়, বিহার, পঞ্জাব, হরিয়ানা, ওড়িশায় যেখানে রোজকার পানীয় জল জোগাড় করতে একেবারে শৈশব থেকেই বালতি হাতে বা মাথায় নিয়ে ছেলে, মেয়েদের গড়ে ২০/৩০ মাইল করে হাঁটতে হয়, সেখান থেকে চেষ্টা করলে, খুঁজে নেওয়ার ‘জহুরি’ চোখ থাকলে কেন আগামী দিনের পদক জেতার মতো ম্যারাথন দৌড়বীর পাওয়া যাবে না? প্রাকৃতিক বাধাই তো তাঁদের প্রাথমিক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, ক্লেশ,পরিশ্রমের ধকল সইবার উদ্যম জোগাচ্ছে। ওই সব প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের সহনশীলতা বা ‘এনডিওরেন্স’ বাড়াচ্ছে। অথচ, উপযুক্ত ‘স্পটার’ বা জহুরির অভাবে ওই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজনের থেকে ভবিষ্যতের দক্ষ ম্যারাথনার বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না। নদীনালার অভাব নেই এ দেশে। প্রোমোটার রাজের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও প্রত্যন্ত গ্রামে, মফস্‌সলে পুকুর, খালবিল এখনও যথেষ্টই। তা হলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চগুলিতে পদক জেতার মতো দক্ষ সাঁতারু তেমন মিলছে না কেন? সেই জহুরির অভাব!

আরও অনেকগুলি ফ্যাক্টর রয়েছে। সেগুলি কী কী?

কল্যাণবাবুর কথায়, ‘‘এ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশেরও কম বিভিন্ন খেলাধুলোয় জড়িত। এদের মধ্যে আবার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে খেলাধুলো ছেড়ে দেওয়ার (ড্রপ আউট) সংখ্যাটাও কম নয়। যাঁরা খেলাধুলোয় থেকে যাচ্ছেন, তাঁরা সছিক ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। তাঁদের শরীরে পুষ্টির মাত্রা (লেভেল অফ নিউট্রিশন) যা থাকা উচিত, বেশির ভাগেরই তা থাকে না। শুধুই পদক জয়ের লক্ষ্যে নয়, খেলাধুলোটা যে স্বাস্থ্যরক্ষা, ওষুধের ব্যবহার, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও চিকিৎসার খরচ কমানোরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, একেবারে তৃণমূল স্তরে সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া আর তাকে বাস্তবায়িত করার সরকারি, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে যথেষ্টই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বিখ্যাত সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ এক সময় বলেছিলেন, ‘‘আই এনজয় দ্য স্পোর্টস। ইফ মেডেল কাম্‌স, ইটস ওকে। ইভেন আই এনজয় ইট, ইফ ইট ডাজন্‌ট কাম।’’ খেলাটাকে উপভোগ করার মধ্যেই আনন্দ। আর সেই আনন্দের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সাফল্যের চাবিকাঠি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! সৃষ্টির সুখ উল্লসিত করলেই কোনও ক্রীড়াবিদ একের পর এক ‘হার্ডল’ টপকে সফল হতে পারেন। তাঁর সাফল্যকে উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। নতুন নতুন রেকর্ড করতে পারেন। নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙতে পারেন। এখানেই শেষ নয়। ঘাটতির ফর্দটা আরও বড়।


সাঁতারুদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে ব্যবহৃত ‘শার্ক সুইম স্যুট’।

আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠার জন্য যে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বা ক্রীড়া সরঞ্জামের দরকার, তার প্রচণ্ড অভাব। একটা উদাহরণ দিই। সমুদ্রে হাঙরের গতি সম্ভব হয় তার শারীরবৃত্তীয় গঠন আর তার চামড়ার বৈশিষ্ট্যের জন্য। সুদক্ষ সাঁতারু গড়ে তোলার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ‘শার্ক সুইম স্যুট’ পরে সাঁতার শেখানো শুরু হয়েছিল। এখন জার্মানি, ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স সহ বহু দেশেই ‘শার্ক সুইম স্যুট’ আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। এই স্যুট এমন ভাবে বানানো যাতে জলের প্রতিরোধ ক্ষমতা শূন্য হয়। একেকটা স্যুটের দাম ৩/৪ লক্ষ টাকা। অর্থাভাবে কোনও শিক্ষার্থী সাঁতারু তো বটেই, জাতীয় স্তরে পদক জয়ী সাঁতারুরাও তাঁদের পারফরম্যান্সকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য ওই স্যুট পরে সাঁতার প্র্যাকটিস করতে পারেন না। তাঁদের প্রয়োজন মেটানোর মতো কোনও সরকারি, বেসরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। প্রয়োজন একটি জাতীয় ক্রীড়া নীতি প্রণয়নেরও। জিডিপি-র নিরিখে শতাংশের হারে ক্রীড়া ক্ষেত্রের জন্য বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত সরকারের।’’

তবে এর পরেও পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ার মতো কিছু ঘটেনি। আশার কথা রয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আলোচনায় ঢুকব বৃহস্পতিবার।

ঋণ স্বীকার: চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়

আরও পড়ুন- চোখের জলের হয় না কোনও দাম? এ বার চালু হচ্ছে প্রথম টিয়ার্স ব্যাঙ্ক!

(চলবে)

Sports Why Indian Athletes Fail To Win Medals In International Games Olympics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy