অলঙ্করণ: শেখর রায়।
কবি বলিয়াছেন, ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’
যে দেশে গরিষ্ঠ সংখ্যক নাগরিক দরিদ্র, দারিদ্রসীমা নিয়ে নানাবিধ রাজনৈতিক অঙ্ক কষেও সংখ্যাটির বিশেষ হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি, যে দেশে আয়কর দিতে পারেন এমন নাগরিকের সংখ্যা প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মাত্র, যে দেশের কোনও না কোনও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনা দফতর পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিভাগ দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের দায়ে অভিযুক্ত— তেমন একটি দেশ জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন কেমন করে নিতে পারে, কোন বিচারে, তা ভাবলে প্রকৃতপক্ষে দেশটা চলছে কী করে, এই ভাবনাই এক বিস্ময় হয়ে ওঠে!
বিস্ময়ের আরও কারণ, ভারতের মধ্যে নিহিত থাকা অসংখ্য ছোট ছোট ভারত। জাতপাতের ভারত, ধর্মভিত্তিক ভারত, খাপ পঞ্চায়েত শাসনের ভারত এবং লিঙ্গ ভিত্তিক ভারত। এ দেশে প্রতিদিন যত মেয়ে ধর্ষিত হয়, যত জন গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার, যত মেয়ে প্রবল অপুষ্টিতে ভোগে স্রেফ এই মানসিকতার কারণে যে সংসারে নারীর স্বাস্থ্যভাবনা অশ্লীল ও স্বার্থপরতা— তার তথ্য দেখলে বোঝা যায় এই পুরুষতান্ত্রিক ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা চলতে থাকবে আরও অনেক কাল।
কিন্তু এ ভাবে কোনও সম্ভাবনা এবং শক্তিকে চিরকাল দমন করে রাখা যায় না। বহু অসাম্য এবং অর্থহীন সংস্কারে আচ্ছন্ন ভারত থেকেও বিশ্বমঞ্চের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে মেয়েরা। সাক্ষী মালিক, দীপা কর্মকার, ললিতা বাবর এবং পি ভি সিন্ধু। এঁরা প্রত্যেকেই আসলে যে পদকটি জিতেছেন তাঁর নাম আত্মসম্মান। এঁরা প্রত্যেকে দেশকে যা দিয়েছেন, তা সাফল্যের গৌরব মাত্র নয়, অলিম্পিক্সের মতো মঞ্চে ভারতের নামটি যে তলানিতে পড়ে থাকত, সেখান থেকে আস্তে আস্তে ভারত নামটি উজ্জ্বল আলোর তলায় নিয়ে আসাই নয়, এঁরা দেখালেন, এমনকী খেলার জগতেও মেয়েরা পারে, পারছে।
পথ সহজ নয়। অন্তত হরিয়ানার মতো রাজ্য থেকে তো নয়ই। কিন্তু প্রগতিশীল ভাবনায় গর্বিত বাঙালির মধ্যেও কি সহজ? একটি মেয়ে এবং তাঁর শরীর এমনই নিরাপত্তার বলয়ে পরিবেষ্টিত, যা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলতার নামান্তর। পুরুষ কোচ একটা বিরাট সমস্যা। যদি গায়ে হাত দেয়! কানে ফিসফিসিয়ে মন্তরটি পড়ে দেওয়ার জন্য বহু কাকি-পিসি মজুত থাকে। কী হবে খেলে? সেই তো বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করতে হবে! যেন মরতে হবে বলে কেউ আর বেঁচে থাকার জন্য ভাত খায় না! বেশি খেলাধুলা করলে মেয়েদের স্বাভাবিক শ্রী নষ্ট হয়ে যায়!
এই সব ধারণার নাম সমাজ! এই সব আপাততুচ্ছ কিন্তু অত্যন্ত জোরদার ধারণাগুলোর নাম রক্ষণশীলতা! কে এর বিরুদ্ধে বলবে, হ্যালো, মেয়েদের শ্রী-র মান কী! কে তা নির্ণয় করে দেয়?
প্রশ্নটা কিন্তু শোনা যাচ্ছে। দীপা-সিন্ধু-সাক্ষীই তুলছেন। তাঁরা হেঁটে গেলেন বলে পথটা প্রশস্ত হল খানিক। এরপর আরও বেশি সংখ্যক মেয়ে হাঁটবেন।
সম্পন্ন উদারচিত্ত পরিবারগুলো এখন সকালে একটি সুন্দর চিত্র রচনা করে। ছুটির সকাল। বাবা ছেলেকে নিয়ে চলেছেন ক্রিকেট কিংবা টেনিসে। মা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছেন নাচ বা গানের ক্লাসে।
আশা করা যেতে পারে, এ বার চিত্র সুন্দরতর হবে। অভিভাবকরা সাক্ষীর অভিভাবকদের মতো হবেন। ক্রীড়াজগৎ, স্বাভাবিক জীবন এবং মেয়েজন্মের সংস্কারে বিরোধ ঘুচবে এ বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy