Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এক পা নিয়েই বিশ্বের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী, অরুণিমার অবাক লড়াই

ট্রেনের কামরায় ছিনতাইবাজদের সামনে রুখে দাঁড়ানোর শাস্তি হিসেবে তাঁকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনের চাকায় কাটা পড়েছিল বাঁ পা। সারা রাত যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দেখেছিলেন, তাঁর কাটা পড়া পায়ে ভিড় করছে ইঁদুরের দল।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৪৭
Share: Save:

ট্রেনের কামরায় ছিনতাইবাজদের সামনে রুখে দাঁড়ানোর শাস্তি হিসেবে তাঁকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনের চাকায় কাটা পড়েছিল বাঁ পা। সারা রাত যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দেখেছিলেন, তাঁর কাটা পড়া পায়ে ভিড় করছে ইঁদুরের দল।

উত্তরপ্রদেশের অম্বেদকর নগরের মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণী অরুণিমা সিংহ তখন ২৩, জাতীয় স্তরের ভলিবল খেলোয়াড়। এখন ২৮-এর অরুণিমা প্রস্থেটিক পা নিয়ে বিশ্বের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইনফোকম-এ তাঁর কাহিনি মন্ত্রমোহিতের মতো শুনলেন তাবড় শিল্পোদ্যোগীরা। জানলেন, নিজের ধর্ম পালন করতে হলে কিছু চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয়। কিন্তু কর্ম পালন করতে হলে প্রার্থিত বস্তুকে শুধু চাইলে হয় না। ছিনিয়ে নিতে হয়।

নকল পা লাগানোর অস্ত্রোপচারের পরেই অরুণিমা যখন এভারেস্ট জয়ের সঙ্কল্প করেছিলেন, সবাই ভেবেছিলেন এত বড় ‘দুর্ঘটনায়’ মেয়েটার মাথাটাও বুঝি বিগড়ে গিয়েছে। ‘‘তখন আমায় কেউ পাগল বললে রাগে-দুঃখে চিৎকার করতাম। এখন ভাল লাগে। কারণ যখনই তোমায় কেউ পাগল বলবে, জানবে ঠিক পথে এগোচ্ছ। লক্ষ্য পূরণে পাগলামি জরুরি।’’ আজ গর্বের সঙ্গে এ কথা বলতে পারেন অরুণিমা। হাততালিতে ভরে ওঠে রাজারহাটের প্রেক্ষাগৃহ।

‘পাগল’ বলে সারা দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর ভারতের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী বাচেন্দ্রী পালের কাছে গিয়েছিলেন অরুণিমা। জানিয়েছিলেন এভারেস্ট-স্বপ্নের কথা। উত্তর পেয়েছিলেন, ‘‘তুমি যে এই অবস্থাতেও এভারেস্ট অভিযানের কথা ভেবেছ, এতেই শৃঙ্গজয় হয়ে গিয়েছে তোমার। বাকিটা কেবল লোকের জানার অপেক্ষা।’’

উত্তরকাশীতে পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় পায়ে একটু চাপ পড়লেই প্রস্থেটিকের সংযোগস্থল ফেটে রক্ত পড়ত। দাঁতে দাঁত চেপে অরুণিমা নিজেকে বোঝাতেন, এই যন্ত্রণার একমাত্র উপশম এভারেস্ট। প্রশিক্ষণ শেষ করে, কয়েকটি ছয়-সাড়ে ছ’হাজার মিটারের শৃঙ্গ আরোহণে পরে ২০১৩-র এপ্রিলে এভারেস্ট অভিযান শুরু। অসম্ভবের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সে এক চরম লড়াই। আর তাতে জিতেছে আত্মবিশ্বাসই। তাই দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় খাড়া বরফ-দেওয়ালে ক্র্যাম্পন (বরফে চলার জুতোর নীচে লাগানো কাঁটা) গাঁথার সময় যখন প্রস্থেটিক পা-টা ঘুরে গিয়ে গোড়ালি সামনে চলে এসেছিল, তখনও হাল ছাড়েননি অরুণিমা। শেরপার সাহায্যে পা ঠিক করে পরের পদক্ষেপ করেছিলেন।

২১ মে, সকাল ১০:৫৫-তে যখন এভারেস্টের চুড়োয় ভারতের পতাকাটা উড়িয়েছিলেন, তখনও অরুণিমা জানতেন না জীবিত অবস্থায় নামতে পারবেন কি না। কারণ এভারেস্ট ছোঁয়ার পরেও ছিল অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়া, প্রস্থেটিক পা খুলে যাওয়া, হাতে তুষার কামড়ের মতো আরও বহু বাধা। তারাও হার মেনেছে তরুণীর মনের জোরের কাছে।

এখন নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিকলাঙ্গদের জন্য ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান খুলেছেন অরুণিমা। লিখেছেন বই, ‘‘বর্ন এগেন অন দ্য মাউন্টেন।’’ হয়ে উঠেছেন অসংখ্য মানুষের ‘আইকন’। আজ শুধু এভারেস্ট নয়, পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলির মধ্যে ছ’টিই আরোহণের পালক তাঁর মুকুটে। আগামী বছরের গোড়াতেই পরিকল্পনা আছে অ্যান্টার্কটিকার ভিনসন শৃঙ্গ অভিযানের। সাফল্য এলে, সম্পূর্ণ হবে ‘সেভেন সামিট’।

সপ্তশৃঙ্গ জয়ের আগাম শুভেচ্ছা জানাতে গোটা প্রেক্ষাগৃহ যখন উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল হাততালিতে কুর্নিশ জানাচ্ছে অরুণিমাকে, তাঁর জেদ, সাহস, লড়াইকে— তখনই নিজের অভিজ্ঞতায় পাওয়া মোক্ষম শিক্ষাটা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘জীবনে ঝুঁকি না-নেওয়াটাই সব চেয়ে বড় ঝুঁকি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Infocom Everest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE