মহড়া: শুক্রবার কোঝিকোড়ে প্রবল গরম উপেক্ষা করে সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলনে মগ্ন এনরিকে। নিজস্ব চিত্র
কেরলের কোঝিকোড় শহরের সঙ্গে অদ্ভুত মিল গোয়ার। এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া রাস্তায় যেতে যেতে কখনও চোখের সামনে ভেসে উঠবে আরব সাগর। কখনও নারকেল গাছের সারি। পুরনো বাড়িগুলোর অধিকাংশই পর্তুগিজ স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে চলেছে। অবশ্য হবে না-ই বা কেন। ১৪৯৮ সালের ২০ মে এখানেই যে নেমেছিলেন ভাস্কো দা গামা।
পর্তুগিজ নাবিকের নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার বিশ্বের ছবিটাই বদলে দিয়েছিল। সহজ হয়ে গিয়েছিল ইউরোপ থেকে ভারতে যাতায়াতের পথ। সেই ঐতিহাসিক কোঝিকোড়েই স্বপ্নের সন্ধানে ইস্টবেঙ্গল কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস গার্সিয়া। আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর এই যাত্রাপথে অন্যতম ভরসা এক পর্তুগিজই। তিনি— জোসে মোরিনহো!
‘দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান’-র অসংখ্য বিখ্যাত উক্তির মধ্যে অন্যতম, ‘‘কোনও এক জনকে নিয়ে আলোচনা করতে আমি ঘৃণা করি। খেলোয়াড়েরা ট্রফি জেতায় না। চ্যাম্পিয়ন হয় দল।’’ রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ ও রিজার্ভ দলের কোচ থাকার সময় মোরিনহোর সংস্পর্শে এসেছিলেন আলেসান্দ্রো। তার প্রভাবেই লাল-হলুদ কোচের মুখে কখনও শোনা যায় না কোনও ফুটবলারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। কাঁদতে বসেন না প্রথম দলের কোনও ফুটবলার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে ছিটকে গেলেও।
থুতু কাণ্ডে নির্বাসিত হয়ে জবি জাস্টিন ছিটকে না গেলে আজ, শনিবার গোকুলম এফসি-র বিরুদ্ধে বাড়তি শক্তি নিয়ে নামতে পারত ইস্টবেঙ্গল। স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে আলেসান্দ্রোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল জবির না থাকাটা কতটা ক্ষতি দলের পক্ষে। নির্লিপ্ত গলায় ইস্টবেঙ্গল কোচের উত্তর, ‘‘জবি দারুণ ফুটবলার। কিন্তু এখন যারা খেলছে, আমি শুধু তাদের নিয়েই ভাবতে চাই। জবির এই ঘটনা বিশ্ব ফুটবলে নতুন নয়।’’ এর পরেই যোগ করেন, ‘‘জবি ভুল করেছে। যদিও ক্ষমাও চেয়েছে। রেফারি যদি শুরুতেই হস্তক্ষেপ করতেন তা হলে এই ঘটনা ঘটত না।’’
অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় শিবির থেকে শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েছেন কমলপ্রীত সিংহ। তিনি কি আসছেন? আলেসান্দ্রোর জবাব, ‘‘যে আঠারো জন এসেছে, তারাই থাকবে।’’
মোরিনহোর আর একটা বিখ্যাত উক্তি, ‘‘শুধু কাজ নয়, পেশাদার জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করি।’’ আলেসান্দ্রো নিজে শুধু সেই দর্শনে বিশ্বাসী নন, ছড়িয়ে দিয়েছেন দলের মধ্যেও।
কলকাতা থেকে কোঝিকোড়ের এখনও পর্যন্ত সরাসরি কোনও উড়ান নেই। হয় বেঙ্গালুরু, চেন্নাই। না হলে মুম্বই হয়ে আসতে হয়। শুক্রবার ভোর সাড় পাঁচটার উড়ানে কলকাতা থেকে রওনা হন এনরিকে এসকুয়েদারা। বেঙ্গালুরু হয়ে কোঝিকোড় পৌঁছলেন দুপুর বারোটা নাগাদ। অথচ দুপুর একটায় শহরের ঠিক মাঝখানে ইএমএস কর্পোরেশন স্টেডিয়ামে প্র্যাক্টিস করার কথা। কোনও মতে হোটেলে লাগেজ রেখে মধ্যাহ্নভোজ না সেরেই সোয়া একটা নাগাদ ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত শরীরে স্টেডিয়ামে এলেন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। সহকারীদের নিয়ে কোচ অবশ্য তার আগেই পৌঁছে গিয়ে মাঠ পরীক্ষা করছিলেন।
মাঠে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চমকপ্রদভাবে বদলে গেল ফুটবলারদের শরীরী ভাষা। কে বলবে কয়েক মিনিট আগেই তাঁরা কোনও মতে টিম বাস থেকে নেমে স্টেডিয়ামে ঢুকেছিলেন। মাঠে নামতেই যেন প্রাণসঞ্চার হল ফুটবলারদের মধ্যে।
কোঝিকোড়ে এখনই রীতিমতো গরম। দুপুর একটা নাগাদ তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু অনুভূত তাপমাত্রা আরও তিন ডিগ্রি বেশি। রোদের তেজ এতটাই তীব্র যে, বেলা এগারোটার পর থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। যাঁরা বেরোচ্ছেন, তাঁদের কারও মাথায় ছাতা। কেউ কেউ সাদা কাপড়় দিয়ে মাথা ও মুখে ঢেকে বেরোচ্ছেন।
প্রচণ্ড রোদ ও প্রবল গরম অবশ্য আলেসান্দ্রো ও তাঁর ছাত্রদের দমাতে পারেনি। ঘণ্টাখানেক রুদ্ধদ্বার প্র্যাক্টিস করেই মাঠ ছাড়েন তাঁরা। বার্তাটা স্পষ্ট— শনিবার গোকুলম এফসি-কে হারাতে না পারলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁক রাখা চলবে না।
লাল-হলুদ শিবিরে কোঝিকোড়ের আবহাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন শুধু এক জনই। তিনি, ফিজিক্যাল ট্রেনার কার্লোস নোদার। ফুটবলারদের তরতাজা রাখতে বেশি করে জল ও টক দই খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্র্যাক্টিস সেরে হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সারেন জনি আকোস্তারা। সেখানেই কার্লোস জানিয়ে দেন কী ধরনের খাবার খেতে হবে সবাইকে।
গোকুলম আই লিগের খেতাবি দৌড়ে না থাকলেও এই ম্যাচকে ঘিরে উন্মাদনা বাড়ছে। লাল-হলুদ সমর্থকদের বসার জন্য গ্যালারির একটা অংশে বিশেষ ব্যবস্থা করছে গোকুলম কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হবে শ’তিনেক বিনামূল্যের টিকিটও। ইস্টবেঙ্গল প্রথমবার জাতীয় লিগ জিতেছিল ২০০০-০১ মরসুমে। কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে। এ বার কোঝিকোড়ে শেষ ম্যাচ। সেটাই লাল-হলুদ সমর্থকদের আশার আলো দেখাচ্ছে। অধিকাংশই শনিবার সকালে কোঝিকোড় পৌঁছচ্ছেন। অনেকে ঝুঁকি না নিয়ে শুক্রবার রাতেই চলে এসেছেন।
আই লিগে লাল-হলুদ শিবিরের ভাগ্য নির্ভর করছে চেন্নাই সিটি এফসি বনাম মিনার্ভা এফসি-র ম্যাচের ফলের উপরে। ইস্টবেঙ্গলকে শুধু জিতলেই হবে না। পয়েন্ট নষ্ট করতে হবে চেন্নাইকে। তা হলেই পনেরো বছরের যন্ত্রণার অধ্যায় শেষ হবে। অঙ্কের বিচারে পেদ্রো মানজ়িরা এগিয়ে থাকলেও আই এম বিজয়নের মতে এনরিকেরা যে রকম মরিয়া হয়ে রয়েছেন, তাতে ইস্টবেঙ্গলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল। ত্রিশূর থেকে শনিবার সকালেই কোঝিকোড় আসার কথা ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকারের। আনন্দবাজারকে বিজয়ন বললেন, ‘‘দলগত ফুটবলই ইস্টবেঙ্গলের প্রধান অস্ত্র। এই ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক ফুটবলারই চাপে পড়ে যায়। কিন্তু এনরিকেদের দেখে মনে হচ্ছে, ওরা জেতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই জানে না। অগ্নিপরীক্ষার আগে মরিয়া ভাবটাই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করছি শনিবার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে ইস্টবেঙ্গলের আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেখতে পাব।’’
একা বিজয়ন নন, ইস্টবেঙ্গল কোচ, ফুটবলার থেকে অসংখ্য সমর্থক— এই স্বপ্নই এখন দেখছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy