Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Nacho

রোনাল্ডোর মঞ্চ প্রায় কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইনসুলিন নেওয়া নাচো

বক্স থেকে প্রায় কয়েক হাত দূর থেকে ডান পায়ের নিখুঁত শটে পর্তুগালের জালে বল জড়িয়ে ফেললেন খানিক আগেই ‘ভিলেন’ হয়ে ওঠা ২৮ বছরের নাচো।

তিন নম্বর গোল করার মুহূর্তে নাচো। ছবি: এএফপি

তিন নম্বর গোল করার মুহূর্তে নাচো। ছবি: এএফপি

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৮ ১৯:০০
Share: Save:

রাজার জন্য তৈরিই ছিল রাজ্যপাট। সব আলো ধরে রেখেছিল তাঁরই ভক্তকূল। খেলা শুরুর তিন মিনিটের মাথায় এসেও গেল সুযোগ। স্পেনের চার নম্বর জার্সির খাটো চেহারার ছেলেটা তখন ‘ভিলেন’ তামাম স্পেনীয়দের কাছে। বিশ্বকাপের মঞ্চে পেনাল্টি কিক ঢুকিয়ে দিলেন ম্যাচের কাঙ্ক্ষিত চরিত্র। সি আর ৭।

তত ক্ষণে মাঠের উন্মত্ত ‘রোনাল্ডো’ চিৎকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে ‘ভিলেন’ নাচো-র ভুলের আফসোস। ক্রূর নিয়তি কেড়ে নিয়েছে স্প্যানিশ আর্মাডার যাবতীয় ছক। পেনাল্টি কিক-এ পিছিয়ে পড়া মনমরা দলটায় একখানা দিয়েগো কোস্তা না থাকলে যে কী হত! ফুটবল দেবতা বোধহয় মুচকি হেসেছিলেন তখন। সেই হাসির প্রতিফলন বিশ্ব দেখল ম্যাচের ৫৮ মিনিটের মাথায়। বক্স থেকে প্রায় কয়েক হাত দূর থেকে ডান পায়ের নিখুঁত শটে পর্তুগালের জালে বল জড়িয়ে ফেললেন খানিক আগেই ভিলেন হয়ে ওঠা ২৮ বছরের নাচো। গোলটা করার পরই নীচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি সেই শাপমুক্তির আশ্বাসই আউরে গেলেন তিনি?

শান্ত, ধীরস্থির হোসে ফার্নান্দেজ পালাসিওস ফুটবল দুনিয়ায় পরিচিত ‘নাচো’ নামে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সেই নাচোই নাচিয়ে ছাড়লেন ফুটবলপ্রেমীদের। রাশিয়ার রোনাল্ডোপ্রমীদের চিৎকার, উত্তেজনা, স্লেজিংয়ের স্নায়বিক চাপ সামলে ডান পায়ের জাত চেনালেন নিঃশব্দে। শটটা দেখে রেফারি জ্যানলুকাও বাঁশি বাজাতে দেরি করে ফেললেন কয়েক সেকেন্ড। সম্ভবত, কিক-টা ধাতস্থ করতেই। গোটা ফিস্ট স্টেডিয়াম জুড়ে জমাট বাঁধা পর্তুগিজ স্বপ্নে জল ঢেলে দিলেন নাচো, অন্তত কিছু ক্ষণের জন্য। রাজা রোনাল্ডোর জন্য তৈরি মাঠে স্কোরবোর্ড খানিক ক্ষণ জ্বলজ্বল করে রইল ৩-২ এর ফলক নিয়ে।

অারও পড়ুন : ‘বিশ্বকাপ না পেলেও মেসিকে সেই সেরাই বলব’

গোলের পর সতীর্থদের আদর। ছবি: এএফপি

এমনিতে তাঁর কিটব্যাগ খুললে প্রথমেই ধাক্কা মারে টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসের ইনসুলিনের প্যাকেট, ওষুধের চড়া গন্ধ। টাইম মেশিনে আরও ১৫-১৬ বছর পিছিয়ে গেলে দেখা যায় মায়ের ভয়, চিকিৎসকের নিষেধ— কোনওটাই অমূলক ছিল না। ১২ বছর বয়সেই জুভেনাইল ডায়াবিটিসের শিকার হতেই স্বপ্নের প্র্যাকটিসে পড়ে গিয়েছিল দাঁড়ি। শরীরে গ্লুকোজের প্রকোপে কমতে শুরু করেছিল এনার্জি। খেলার মাঠে গেলেও বার বার ছুটতে হত টয়লেটে। স্ট্রাইকার হওয়ার অদম্য ইচ্ছে থাকলেও ডিফেন্ডারেই খুশি থাকতে হয়েছিল এক কালে। রাতে ঘুমের মধ্যেও হানা দিত রিয়াল মাদ্রিদে খেলার স্বপ্ন। আর সকাল হলেই চিকিৎসকের খেলা বন্ধ করার ফরমান।

মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হওয়া অসুখকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার ক্ষমতা ছিল না নাচোর মায়েরও। ছেলেকে খেলা থেকে সরিয়ে রাখতে কম বকাবকি করেননি। অবশেষে খেলাপাগল ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবেই গেলেন অন্য আর এক চিকিৎসকের কাছে। এ বার আরও এক বার নাচোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন খেলার ঈশ্বর। ওই চিকিৎসক জানালেন, খেলাই তাঁকে রাখবে সুস্থ। তবে দরকার, নিয়মিত ওষুধ আর সতর্কতা। সে দিন থেকেই কিটব্যাগে ঢুকে গেল ইনসুলিন, অ্যান্টি ডায়াবিটিক ওষুধপত্রেরা। ডায়েটে এল বিপুল সচেতনতা। এ ভাবেই ২১ বছর বয়সে চিঠি মিলল প্রিয় কোচ হোসে মারিনহোর তাঁবু থেকে। রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ।

আজও ওই ক্লাবই নাচোর ঘরের মাঠ। যে জিনেদিন জিদানকে দেখে বেড়ে ওঠা, আজ সেই জিদানই রিয়ালের ম্যানেজার। বিশ্বকাপে খেলতে আসার প্রস্তুতি পর্বে যিনি চোখে চোখে রেখেছেন দলের এই সম্পদকে। নাচোর পরিবারের মতো জিদানেরও রাত কেটেছে ভয়ে ভয়ে, এই না নাচোর রক্তে বেড়ে যায় গ্লুকোজের অঙ্ক, এই না ক্লান্তি থাবা বসায় খেলোয়াড়ি রুটিনে! নিজের দেশের অনেকেই তাঁকে ‘ফিট’ বলে ধর্তব্যে আনতেন না। সংশয় ছিল তাঁর এনার্জি লেভেল নিয়েও।

আরও পড়ুন: মর্তের সেরা আমিই, বলে দিলেন নেমার

শুক্রবার বিশ্বকাপের মঞ্চে যাবতীয় সংশয়, যত্ন আর ভয়ের জবাবে উজাড় করে দিলেন নিজের সেরাটুকু। রোনাল্ডোর মুখে তাক করে রাখা আমাদের ফুটবল হ্যাংলামোর সার্চলাইটটা ঘুরিয়ে নিলেন নিজের দিকে। হলই বা তা কিছু ক্ষণের জন্য! গ্যালারির অনেক দূরে থেকে সেই দৃশ্য কি দেখতে পেলেন ড্যানি ম্যাকগ্রাঁ, পেননাম, ক্রেগ স্ট্যানলির মতো প্রাক্তন টাইপ ১ ডায়াবিটিক ফুটবলাররা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nacho Football ronaldo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE