জুটি: কুলদীপ যাদবের সঙ্গে কোচ কপিল পাণ্ডে। নিজস্ব চিত্র
ইংল্যান্ড সফর চলার সময়ই টিভি-তে নজর রেখেছিলেন ছাত্রের ওপর। কী কী ভুল করেছিলেন, সব উঠে গিয়েছিল কোচের খাতায়। ইংল্যান্ড থেকে ফিরেই কুলদীপ যাদব ছুটে যান তাঁর ছোটবেলার কোচ কপিল দেব পাণ্ডের কাছে। হাতে মাত্র তিন দিন সময় ছিল। যে সময়ের মধ্যেই কুলদীপের ভুলত্রুটি শুধরে তাঁকে টেস্টের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন কপিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে রাজকোটে পাঁচ উইকেট নিয়ে জীবনের সেরা বোলিং করে গুরুর কথা বলতে ভোলেননি কুলদীপ।
কিন্তু কী কী ভুল করছিলেন এই চায়নাম্যান বোলার? কী ভাবেই বা এই সব ত্রুটি মেরামত হল? রবিবার কানপুর থেকে ফোনে আনন্দবাজারের সঙ্গে আলাপচারিতায় কুলদীপের কোচ কপিল পাণ্ডে তুলে ধরলেন তিন দিনের সেই ‘ক্র্যাশ কোর্স’-এর পুরো বিবরণ।
কুলদীপের সমস্যা এক, ইংল্যান্ডে লাল বল গ্রিপ করতে ঝামেলায় পড়ছিলেন কুলদীপ। টিভি-তে তাঁর ছাত্রের বোলিং দেখার পরে কপিল বুঝেছিলেন সমস্যাটা। ‘‘ইংল্যান্ডে টেস্ট শুরু হওয়ার পরে আবহাওয়াটা একটু ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সেটা একটা কারণ ছিল ঠিক মতো বল গ্রিপ করতে না পারার। তা ছাড়া সাদা বল থেকে লাল বলে এসেও ওর একটু সমস্যা হয়েছিল,’’ বলছিলেন কপিল।
দুই, বল ডেলিভারি করার সময় কুলদীপের হাতের তালু ভিতরের দিকে থাকার বদলে বাইরের দিকে বেশি চলে যাচ্ছিল। এতে কী সমস্যা হচ্ছিল? কোচের ব্যাখ্যা, ‘‘এর ফলে কব্জির মোচড়ে বলকে ঘোরানো যাচ্ছিল না। যে জন্য পিচে পড়ার পরে বল সে ভাবে স্পিন করছিল না।’’
তিন, বল বেশির ভাগ সময় ডান হাতি ব্যাটসম্যানদের পায়ের কাছে পিচ পড়ছিল। যে স্পটে বল ফেললে উইকেট পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ব্যাটসম্যানরাও সহজে অন সাইডে স্ট্রোক খেলতে পারেন। কেন এ রকম হচ্ছে, বলছিলেন কপিল— ‘‘ইংল্যান্ডে লম্বা স্পেল করতে পারেনি কুলদীপ। টেস্টে তো নয়ই, প্র্যাক্টিসেও নয়। ফলে ঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারছিল না। তার ওপর সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে টেস্ট খেলতে এসে আরও সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল।’’
কুলদীপের দাওয়াই এক বার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পরে কোচের কাজ ছিল মাত্র তিন দিনে তার দাওয়াই বার করা। যেটা কপিল করে ফেলেন। যেখান থেকে ক্রিকেটে হাতেখড়ি এই চায়নাম্যান বোলারের, সেখানে ফিরে এসেই নিজেকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য তৈরি করে নিলেন কুলদীপ। কী ভাবে?
এক, গ্রিপিং সমস্যা দূর করতে কুলদীপকে নতুন লাল বলে অনুশীলন করানো হয়। ‘‘নতুন বল একটু পিচ্ছিল হয়। নতুন লাল বল তো একটু বেশিই হয়। স্পিনারদের পক্ষে গ্রিপ করতে সমস্যা হয়ে যায়। তাই কুলদীপের জন্য নতুন বলের ব্যবস্থা করি ট্রেনিংয়ে। ওই বলে অনুশীলন করে ওর গ্রিপিং সমস্যা কেটে গিয়েছে,’’ ব্যাখ্যা দিলেন ছোটবেলার কোচ।
দুই, ডেলিভারির আগে কুলদীপের হাতের আর তালুর অবস্থান ঠিক করা হয় অনুশীলনে। সেটা কী রকম? প্রশ্ন শুনে কপিল বললেন, ‘‘ঘড়িতে যখন এগারোটা বাজে, তখন কাঁটার অবস্থানটা দেখেছেন? বল ছাড়ার সময় কুলদীপের হাতও ওই ‘ইলেভেন ও’ক্লক’ অবস্থায় থাকা উচিত। সে সব গুলোই ঠিক করেছি আমরা।’’ একই সঙ্গে তালুর অবস্থানও ঠিক করে দিয়েছেন কোচ। বল ছাড়ার সময় হাতের তালু এখন ভিতরের দিকে থাকার ফলে বলে ‘রোটেশন’ অনেক বেশি হচ্ছে। স্পিনও করছে।
তিন, লাইন এবং লেংথ— দু’টোতেই সমস্যা হচ্ছিল কুলদীপের। কোচ বুঝে যান, লম্বা স্পেল করতে না পেরেই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। হাতে তিন দিন ছিল। এই তিন দিনে ৬০ ওভার বল করিয়েছেন কুলদীপকে। হাতের অবস্থান ঠিক করে দেওয়ার ফলে বল জায়গায় পড়েছে। বল স্পিন করে ডান হাতি ব্যাটসম্যানদের ভিতরে এসেছে, বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে বাইরে গিয়েছে। ‘‘লম্বা স্পেল করতে করতে কুলদীপ লাইন-লেংথটাও ঠিক করে নিতে পেরেছিল। যেটা স্পিনারের সব চেয়ে বড় অস্ত্র বলে আমি মনে করি,’’ বলছিলেন কপিল।
পাশাপাশি আরও একটা জিনিস করা হয়েছে অনুশীলনে। ডান হাতি, বাঁ হাতি— দু’ধরনের ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে প্র্যাক্টিস দেওয়া হয়েছে কুলদীপকে। কোচের মন্তব্য, ‘‘বাঁ হাতি, ডান হাতির ক্ষেত্রে লাইনটা বদলাতেই হয়। সেটা মাথায় রেখে আমি ওর প্র্যাক্টিসের ব্যবস্থা করেছিলাম। এক জন রঞ্জি ব্যাটসম্যান, এক জন অনূর্ধ্ব ১৯ ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি ভাল এক জন বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানও নিয়ে এসেছিলাম। যার ফল
পাওয়া গেল।’’
অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের বিরুদ্ধে বেসরকারি টেস্ট ম্যাচের আগে তিন দিন সময় ছিল কুলদীপ আর তাঁর কোচের হাতে। যেখানে সেই ১২-১৩ বছর বয়সে ক্রিকেট শুরু করেন, কানপুরের রোভার্স গ্রাউন্ডে কপিল পাণ্ডের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেই ফিরে যান কুলদীপ। কপিল বলছিলেন, ‘‘কুলদীপ অত্যন্ত পরিশ্রমী ছেলে। এই তিন দিনে কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছে, ভাবতে পারবেন না। এখানে প্রচণ্ড গরম। রোদে ওর মুখের চামড়া পুড়ে গিয়েছে। আমার হাত-পায়ের অবস্থা খারাপ। কিন্তু তাও আমরা
হাল ছাড়িনি।’’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্টে ছাত্রের পারফরম্যান্স দেখেছেন কপিল। পুরোপুরি যে সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন, বলা যাচ্ছে না। খেলার পরে কুলদীপকে ফোনে ধরেন তিনি। বলেন, ‘‘পাঁচটা নিয়েছিস, ঠিক আছে। কিন্তু আর একটু ঠিকঠাক বল করলে ছ’-সাতটা উইকেটও হয়ে যেতে পারত।’’ কুলদীপকে যে কয়েকটা জায়গা ঠিক করে নিতে বলেছেন কোচ, তা এ রকম: এক, আরও বেশি গুগলি করা যেত। দুই, ব্যাটসম্যানকে সামনের পায়ে টেনে আনতে পারলে উইকেট আসত। তিন, লাইন-লেংথ আরও নিখুঁত করা যেত। যা শুনে কুলদীপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পরের বার এই ভুল শুধরেই নামবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy