Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
আফ্রিদিদের বিদায়, সামনে ভারত

দেশকে রূপকথার রাত উপহার দিলেন মাশরফি

মাশরফি মর্তুজাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটমহল আর দেশজ মিডিয়া যেমন প্রশ্নাতীত আনুগত্যের সঙ্গে দেখে, সে ভাবে রণতুঙ্গাকেও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দেখে কি না সন্দেহ! বা সৌরভকে ভারত!

ফাইনালে ওঠার উল্লাস। —এপি, টুইটার

ফাইনালে ওঠার উল্লাস। —এপি, টুইটার

গৌতম ভট্টাচার্য
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪৬
Share: Save:

মাশরফি মর্তুজাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটমহল আর দেশজ মিডিয়া যেমন প্রশ্নাতীত আনুগত্যের সঙ্গে দেখে, সে ভাবে রণতুঙ্গাকেও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দেখে কি না সন্দেহ! বা সৌরভকে ভারত!

মাশরফি শুধু টিমের অধিনায়কই নন, দলের পিতা। বলা যেতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাইক ব্রিয়ারলি। তাঁর বলের গতি এখন একশো তিরিশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ব্যাটেও নিয়মিত প্রচুর রান করে দেন, এমন নয়। তবু মাশরফিকে বাদ দিয়ে টিম নামানো যায় না কারণ গোটা দলের রিমোট সব সময় তাঁরই হাতে। তিনি প্লেয়িং আবার এক অর্থে নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেনও। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আজ অবধি কেউ এমন লোকগাথার নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। তা তাঁকে ঘিরে অতিমানবীয় রূপকথার প্রলেপে বুধবার আর একপ্রস্ত আবির লাগিয়ে দিলেন মাশরফি। কার্যত সেমিফাইনাল ম্যাচের কঠিনতম সময়ে পরপর দু’টো বাউন্ডারি মারলেন বিপক্ষের ভয়ঙ্করতম মহম্মদ আমেরকে।

ওয়ান ডে বিশ্বকাপের আবিষ্কার মাহমুদউল্লাহ-র হাত থেকে এল উইনিং স্ট্রোক। তাঁর অপরাজিত ২২ রানের আগে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট একটা ১ সংখ্যা বসাবে। শাহিদ আফ্রিদির দেশের জন্য যদি আজকের রাত কলঙ্কের হয়। বাংলাদেশের জন্য মায়াবী ইতিহাস!

একটা টিম যাদের টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিং বিশ্বে দশ নম্বর। যারা পরপর দু’টো দেশকে কখনও এই ফর্ম্যাটে হারাতে পারেনি। যাদের টি-টোয়েন্টি খেলা মানে সমর্থকেরাও জানে বেশি আশা করে লাভ নেই। তারা কী চমকপ্রদ ভাবে না এশিয়া কাপের ফাইনালে! বাড়ি পাঠিয়ে দিল মালিঙ্গার শ্রীলঙ্কা আর আফ্রিদির পাকিস্তানকে। পড়ে থাকলেন শুধু রোববারের ধোনিরা।

ফাইনাল বাকি রয়েছে তো কী? এই রকম সংঘাতের তো একটা আবেগ আছে। মাহমুদউল্লাহ-র শটটা শেষ ওভারে ডিপ মিড উইকেট বাউন্ডারিতে অদৃশ্য হয়েছে কী হয়নি, উচ্ছসিত গোটা বাংলাদেশ টিম মাঠে ঢুকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। বড় ফাইনাল জিতলে যেমন হয়। এ দিন শূন্য রানে আউট হয়ে নিজের অধিনায়কত্বকে চূড়ান্ত সঙ্কটে নিয়ে ফেলা আফ্রিদি তখন নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আর তাঁর সামনেই কি না উৎসব শুরু! মহম্মদ সামিকে দেখলাম কোমরে হাত দিয়ে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে। উনিশতম ওভারে দু’টো যাচ্ছেতাই নো-বলের জন্য তাঁর কেরিয়ারও না আফ্রিদির পিছন পিছন চলে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে গ্যালারির যে জলদগম্ভীর অভিব্যক্তি থাকা উচিত, সেটা কিন্তু নেই। আসলে দর্শকদেরও তো স্বাভাবিকতায় ফিরতে সময় লাগে। তাঁরা তখনও ঘোরের মধ্যে। বিহ্বল! কেউ আল্লাহ-র কাছে প্রার্থনা করছেন। কেউ কাঁদছেন আনন্দে। কেউ বাংলাদেশের পতাকা নাড়িয়ে চলেছেন। এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী— তিনি কি ছিলেন শেষ পর্যন্ত? না কি টেনশন সহ্য না করতে পারা শেখ হাসিনা চলে যান?

ম্যাচ ঘোরানো শট মাশরফির।

শুনলাম শেষ বল অবধি দেখে গিয়েছেন। ষোলো কোটি বাংলাদেশবাসীর আজ মাঠে থাকা বা না থাকার মধ্যে বিশেষ প্রভেদ ছিল না। এমনই নাটক-প্রতিনাটক-আশা-আশার বিপর্যয়ে ক্রমান্বয়ে ম্যাচ চলছিল। মাশরফি আর সাকিব আল হাসান যেমন ম্যাচের আজ আলো এবং অন্ধকার হিসেবে যুগপৎ হাজির হলেন।

আঠারোতম ওভারে তাঁর শেষ অস্ত্র মহম্মদ আমেরকে নিয়ে এসেছিলেন পাক অধিনায়ক। তাঁর তো এই একটাই ঘোড়া। তিনি টপ স্কোরার সৌম্য সরকারকে ফিরিয়েছেন। এই ওভারে আরও একটা উইকেট মানে নিজেরা মাত্র ১২৯ করেও ম্যাচ আছেন। বাংলাদেশ স্ট্র্যাটেজি তখন অবশ্যই আমেরকে সাবধানে খেলে শেষ দু’ওভারে ঝুঁকি নেওয়া। ১৮ বলে ২৬ করতে হবে। অনেক সুযোগ। ঠিক এই সময় গোটা বাংলাদেশের হৃদয় খানখান করে সাকিব আউট হয়ে গেলেন। তাঁর বোধহয় সাময়িক ব্রেন ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিল। নইলে জীবিত অথবা মৃত কোনও ব্যাটসম্যান মহম্মদ আমেরকে এই সময় স্কুপ করে! সাকিব এর পর যা করলেন আরও অবিশ্বাস্য। ব্যাট দিয়ে হতাশায় প্রচণ্ড জোর স্টাম্পে মারলেন। ক্ষমা যতই চেয়ে নিন এর পর ম্যাচ রেফারির ঘরে তাঁর অবশ্যই ডাক পড়া উচিত!

মাঠের উত্তর কোণে ফুচকা কাউন্টার। মীরপুর বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র ক্রিকেট মাঠ যেখানে গ্যালারির মধ্যে অন্য সব খাবারের পাশাপাশি তেঁতুল জল দিয়ে ফুচকা বিক্রি হয়। ঠিক ওই সময়ে আর কারও কোনও কিছুতে রুচি নেই। স্তম্ভিত মাঠ। বাংলাদেশের নামী সাহিত্যিক আনিসুল হক, গীতিকার জুলফিকার রাসেল, অভিনেত্রী পূর্ণিমা খেলা দেখতে এসেছিলেন। আর পাঁচ জনের মতো তাঁদেরও স্তব্ধবাক দেখাল। গ্যালারি মাথায় হাত দিয়ে বসা। আকুল সেন্টিমেন্ট, এত কাছে এসেও হল না!

মাশরফি ঠিক এই সময় আবির্ভূত হলেন মহাকাব্যিক চরিত্র হিসেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর বোলিং রেকর্ড খুব সাদামাঠা। ৭ ম্যাচে মাত্র ২ উইকেট। কিন্তু আজ তো এশিয়া কাপ সেমিফাইনাল। আজ বড় ম্যাচ। খুকুদের খেলা নয়। পরপর দু’টো বল এর পর অবিস্মরণীয় হয়ে থাকল। একটা আমেরকে ড্রাইভ মারলেন। একটা ফাইন লেগ দিয়ে চালিয়ে দিলেন। দু’বল ৮ রান এবং রূপকথায় সেই তাঁর নতুন অধিষ্ঠান!

আহত মুস্তাফিজুরকে বাদ দিয়েও বাংলাদেশ এত ধারালো আক্রমণ করবে ভাবা যায়নি। তাসকিন আহমেদ আজও একশো পঁয়তাল্লিশ ও তার আশেপাশে বল করলেন। দু’বাংলার যাবতীয় পেসার ধরে তিনি বোধহয় সর্বকালের দ্রুততম। প্রথম ৩ ওভারে রান দিলেন মাত্র ২। ডট বল ১৬। ওখানেই আফ্রিদির পাকিস্তান এমন চাপে প়ড়ল যে একটা পার্টনারশিপ ছাড়া কোনও সমাধানই খুঁজে পায়নি। এই বাংলাদেশ টিমে তারকা তো হাতে গোনা। বেশির ভাগকেই বিশ্ব ক্রিকেট জানে না চেনে না। কিন্তু এই তথাকথিত অনামীরা হালফিল এত সপ্রতিভ যে, ভারতে বিশ্বকাপে আবার নজর কাড়তে বাধ্য।

শের-ই-বাংলায় ব্যাঘ্র গর্জন।

নতুন বলের তাদের আর এক পেসার আল হোসেন যেমন। বাঁ হাতি স্পিনার আরাফত সানি যেমন। পদ্মার ও পারে ক’জন এঁদের নাম শুনেছে? অথচ এত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাক ব্যাটিংকে কী লড়াইটাই না দিলেন। আরাফত সানির কথা বলছিলেন এখানকার সাংবাদিকেরা। মা এসে দিনের পর দিন মাঠের বাইরে বসে থাকতেন। দূর থেকে তাঁর মা-কে দেখেই সবাই বুঝত ছেলে মাঠের মধ্যে রয়েছে। ধৈর্য ধরতে ধরতে, লড়তে লড়তে আজ কি না তিনি রোববারের ফাইনালে বল হাতে কোহলিদের মুখোমুখি।

শ্রীজাত-র একটা সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট ছিল যে, একজন অন্তর্মুখী স্পিনারের ডেলিভারির মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে। তার প্রতিটি ডেলিভারিতে ওঁত পেতে থাকে যৌবনের সব প্রত্যাখ্যান ও অপমান, উপহাস আর নীরবতা। উইকেট পড়ার শব্দ আর দর্শকের উল্লাসের মাঝখানে যে এক সেকেন্ডের স্তব্ধতা, সেটাই তার উত্তর।

গভীর রাতে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে পায়চারি করতে করতে মনে হচ্ছে শুধু স্পিনার কেন, গোটা বাংলাদেশ টিম সম্পর্কেই তো লাইনগুলো সত্যি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE