Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

গলের সমুদ্র লক্ষ্মীবারে কোহলিদের আরও বড় জোয়ারের অপেক্ষায়

গল স্টেডিয়াম আর তার সংলগ্ন এলাকা বিশ্বকর্মার এক অপরূপ সৃষ্টি। মাঠের একটা দিক প্লেয়ার্স প্যাভিলিয়ন। আর একটা দিক গল ফোর্ট। এত প্রকাণ্ড সেই দুর্গ যে, ব্যোমকেশ-অজিত সহ ‘দুর্গরহস্যের’ দারুণ শ্যুটিং করে আসতে পারেন অঞ্জন দত্ত। কলকাতায় যেমন লোকে আকাশবাণীর ছাদে বসে ইডেনের টেস্ট ক্রিকেট দেখত, গল দুর্গের টঙে বসেও মানুষ এ দিন সঙ্গকারাকে দেখার চেষ্টা করছিল।

অশ্বিন-তোপ।

অশ্বিন-তোপ।

গৌতম ভট্টাচার্য
গল শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

গল স্টেডিয়াম আর তার সংলগ্ন এলাকা বিশ্বকর্মার এক অপরূপ সৃষ্টি। মাঠের একটা দিক প্লেয়ার্স প্যাভিলিয়ন। আর একটা দিক গল ফোর্ট। এত প্রকাণ্ড সেই দুর্গ যে, ব্যোমকেশ-অজিত সহ ‘দুর্গরহস্যের’ দারুণ শ্যুটিং করে আসতে পারেন অঞ্জন দত্ত। কলকাতায় যেমন লোকে আকাশবাণীর ছাদে বসে ইডেনের টেস্ট ক্রিকেট দেখত, গল দুর্গের টঙে বসেও মানুষ এ দিন সঙ্গকারাকে দেখার চেষ্টা করছিল।

দুর্গের পাশে আবার সমুদ্র। এই মাঠের লং লেগের পেছনে যদি আরও একটা লং লেগ রাখা যায়, তা হলে তার পা গিয়ে জলে পড়বে। পৃথিবীর আর কোনও মাঠে সমুদ্র এত কাছে নয়। তিন তলার প্রেসবক্সে বসে দেখা যাচ্ছে সামনের ভারত মহাসাগরে কখন জোয়ার চলছে। কখন ভাঁটা নামছে।

তা সিরিজ উদ্বোধনী দিনে গলের সমুদ্র দেখল ভারতের জোয়ার আর শ্রীলঙ্কার ভাঁটা!

অথচ গল হল সঙ্গা-মুরলীদের প্রিয় মাঠ। ভারতীয় ক্রিকেটারদের যেমন চেন্নাই সবচেয়ে পয়া মাঠ— এদের গল। বছর দশেক আগে একটা পিরিয়ড যাচ্ছিল যখন গলে টেস্ট মানেই মুরলীর উইকেটের ফুলঝুরি জ্বলবে আর শ্রীলঙ্কা জিতবে। সেই বাজারে বেশ কিছু দিনই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের মন্দা যাচ্ছে। এক মাস আগে এখানেই হারিয়ে দিয়ে গেছে পাকিস্তান। বুধবারেও টেস্টের যা গতিপ্রকৃতি, বৃষ্টি সাহায্যে না এলে প্রিয় মাঠে আবার তাদের সুনামি-বিধ্বস্ত পুরনো গল স্টেডিয়ামের মতো দেখাতে পারে। তা-ও কিনা এই শুকনো সারফেসে টস জেতার সুযোগ হাতে নিয়ে!

দুটো অপ্রত্যাশিত ঘটনা সকাল-সকাল দেখার সুযোগ হয়ে গেল। এক, কুমার সঙ্গকারার জন্য ডিজাইনার ভিড়েরও ব্যবস্থা করা যায়নি। স্কুলের বাচ্চাকাচ্চা এসে মাঠ দুপুরের দিকে কিছুটা ভরল। কিন্তু সেটা কত? স্থানীয় ক্রিকেট-রসিকের বিলাপ শুনছিলাম যে, সঙ্গা যদি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার শেষ করতেন, তা হলে সেই ক্রিকেটীয় শেষযাত্রা অনেক বর্ণাঢ্য আর রোমাঞ্চকর হত! সকালে ওই হাতেগোনা ভিড় দেখে সত্যি মনে হচ্ছিল যে, চিয়ারগার্ল আর ডিজের এখন আইপিএল ছেড়ে টেস্ট ক্রিকেটমুখী হওয়া দরকার। ওটা তো এমনিতেই লোক টানে। কিন্তু এখানে কৃত্রিম উত্তেজনা আর এনার্জির ঠেসান না পেলেই নয়।

আর কে জানত, বাইরের উত্তেজনার অভাব মিটিয়ে বাইশ গজই যে প্রথম ঘণ্টায় আচমকা জীবন্ত হয়ে যাবে! বিদেশে টেস্ট সিরিজের ওপেনিং দিন যে বস্তুটা অনিবার্য ভাবে ভারতীয় বিনাশ ঘটায়, সেটাই কাজে লাগিয়ে কোহলির ভারত দুম করে ম্যাচের গ্রিপ নিয়ে নিল। গতিসম্পন্ন শর্ট পিচ‌্ড বোলিং।

দুর্গের দিক থেকে ইশান্ত। প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে বরুণ অ্যারন। পেসার জুড়ি এই সময় যে গতিতে বল করছিলেন, তা ভারতীয় পেসাররা এ বার অস্ট্রেলিয়াতেও করেননি। গড়পড়তা ডেলিভারি ছুটছিল ১৪০-১৪৫ কিলোমিটার গতিতে। আর মাঝে মাঝেই গুড লেংথ থেকে শর্ট পিচ। উপমহাদেশীয় হয়েও আজকের গল পিচ অন্তত বাউন্স দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ব্যাটিং সেটা সামলাতে চূড়ান্ত অদক্ষতা দেখাল।

এমন বাউন্সার-আক্রান্ত দিনে তাদের ত্রাতা হতে পারতেন কুমার সঙ্গকারা। ফাস্ট বোলিং অসম্ভব ভাল খেলেন। ফর্মেও আছেন। সারের হয়ে শেষ দুটো ইনিংসের একটায় ৭০। একটায় সেঞ্চুরি। আজ যখন ব্যাট করতে নামছেন, বেশ অভিনব অভ্যর্থনা দিলেন গল ক্রিকেট কর্তারা। দুর্গের দিক থেকে পাঁচ বার তোপধ্বনি হল তাঁর সম্মানে। সেটা কাজেক্রমে হয়ে গেল ভারতীয় বোলিংয়ের তোপধ্বনি।

গোটা মাঠ এবং শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট অনুরাগীদের নিস্পন্দ, রক্তশূন্য করে দিয়ে নিজের প্রথম ওভারেই সঙ্গাকে উপড়ে দিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। আউট হওয়ার ধরনটা একেবারেই সঙ্গকারাচিত নয়। অফে পুশ করতে গেছিলেন। একটু উঠে পড়েছিল। সিলি পয়েন্ট দশ বারের মধ্যে নয় বার এই সময় রিফ্লেক্সে হয় চোখ বুঝবে বা মাথা সরিয়ে নেবে। লোকেশ রাহুল কোনওটাই করেননি। তাই দু’চোখ খোলা অবস্থায় শক্ত ক্যাচটা নিতে পারলেন।

অশ্বিনের বলে রোহিতও শর্ট লেগে দারুণ ক্যাচ লুফলেন। শিখর ধবন সেকেন্ড স্লিপে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলেন। গড়পড়তা দিনে ভারতীয় মিডিয়ায় চালাচালি শুরু হওয়া উচিত, ফিল্ডিং কোচের নামটা কী যেন? এ দিন যদি করে থাকে, সেটা অন্য কারণে যে, লোকটা ঠিকঠাক কাজ করছে তো!

শ্রীলঙ্কার ১৮৩ আজ ৮৩ হতে পারত মোক্ষম ক্যাচগুলো না ছাড়লে। ধবন স্লিপে যেটা ফেললেন আর ঋদ্ধি উইকেটের পেছনে, সেগুলো অনূর্ধ্ব ১৪ ক্রিকেটেও ছেলে ফেললে কোচ ‘গার্জেন টু সি’ করতে পারেন। ঋদ্ধির মিসটা তো অবিশ্বাস্য। ইশান্তের বল কোনও সুইং করেনি। ব্যাটসম্যানের হালকা এজ লেগে একই পেসে বাঁক না নিয়ে বল আসছে। ওটা তো সান্টুকে ক্যাচ ধরতে শেখানো যে, দ্যাখো এটাকে ক্যাচ ধরা বলে। ঋদ্ধি সেটাও ফেলায় তখন ৫ রানে থাকা দীনেশ চণ্ডীমল ৫৯ করে গেলেন।

অ্যাঞ্জেলো এই সময় ম্যাচটা প্রায় বাগে নিয়ে নিয়েছিলেন। পেলেন না অশ্বিনের নিরবচ্ছিন্ন চাপ রেখে যাওয়ার জন্য। আজ তাঁকে বারবার জুনিয়র কুম্বলে মনে হচ্ছিল। যেমন লাইন ঠিক রেখেছেন। তেমন বাউন্স করিয়েছেন। একটা সময় ধোনির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়ায় অবসাদে ভুগছিলেন অশ্বিন। ইংল্যান্ডে ধোনি তাঁকে বারবার বাদ দিয়ে জাডেজাকে খেলাচ্ছিলেন। এর পর কোহলি ক্যাপ্টেন হয়ে প্রথমেই তাঁকে অ্যাডিলেড টেস্টে বসিয়ে দেন। অশ্বিন হয়ে যান আরও মনমরা। ঠিক এই সময় পয়া গ্রহরত্নের মতো অশ্বিনের জীবনে রবি শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাবে কাছে আসা! শাস্ত্রী প্রথমেই বলেন, তুমি সেরা অফস্পিনার তো সবাই জানে। এ বার সেরা অলরাউন্ডারটা হও। অশ্বিন এমন আস্থায় অভিভূত হয়ে যান। এর পর থেকে শাস্ত্রীর অধীনে তিনি অ্যাকশন নিয়ে অবিরত পরীক্ষা করে যাচ্ছেন। অনেক রিল্যাক্সড। আর বিধ্বংসীও। এটা ঠিক যে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব জুড়ে ব্যাটসম্যানশিপের এমন অবনতি ঘটেছে যে, আজকের মতো সামান্য রসালো উইকেট হলে কেউ খারাপ বলের জন্য ধৈর্য অবধি দেখাচ্ছে না। চালিয়ে আউট হয়ে যাচ্ছে। এবং সেই যুগেও টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিন স্পিনারের ছেচল্লিশ রানে ছয় উইকেট একটা ব্যক্তিগত উৎসবযোগ্য ব্যাপার।

এমন হুড়মুড়িয়ে উইকেট পড়ছিল যে, লাঞ্চে শ্রীলঙ্কা পাঁচ উইকেটে পঁয়ষট্টি। কাউকে যেন মনে করিয়ে দিতে হবে যে, ব্যাটিং টিমই টস জিতেছে। গল প্যাভিলিয়নের ঠিক মুখোমুখি রেলওয়ে স্টেশন আর কিছু দোকানপাট। দোকানে পৌঁছতে সাড়ে তিন মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তবু দুপুরে মোবাইল টপ-আপ করাতে সে দিকে যেতে পারিনি। ভয়— ফিরে এসে দেখব পুরো ইনিংস শেষ হয়ে গেছে। সরি, অশ্বিন শেষ করে দিয়েছেন।

এই শ্রীলঙ্কা এখনও কোনও অশ্বিনের খোঁজ পেয়েছে বলে দেখাতে পারেনি। পারলে চিকু আর গব্বরের পার্টনারশিপ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। সরি, চিকু হল ড্রেসিংরুমের ডাক। ওটা বিরাট কোহলি। আর গব্বর— শিখর ধবন। তাঁদের এত ঝামেলাই করতে হত না তিন নম্বর ব্যাটসম্যান চাপ সামলে নিলে। তিনি রোহিত শর্মা তো আবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ব্যাটিংয়ের ভাবভঙ্গি দেখে এক বারও মনে হয়নি যে, টেস্ট ক্রিকেটে এই তিন নম্বরের লকারের চাবিটা তিনি পাওয়ার যোগ্য। অনেক বছর বাদে এ দিন চেতন শর্মাকে প্রেসবক্সে দেখা গেল। চেতন বলছিলেন, ‘‘এ কী নাম্বার থ্রি। নতুন বলের লাইন থেকে কত দূরে দূরে খেলছে!’’

ঋদ্ধির প্রতিযোগী ধারেকাছে নেই। তিনি আরও সুযোগ পাবেন। তিন নম্বরে রোহিতের পরিবর্ত কিন্তু ড্রেসিংরুমেই মজুত। আরও একটা ব্যর্থতা এলে সেই পূজারাকে না কলম্বোয় দেখতে হয়! অবশ্য চিকু-গব্বররা যদি টিমকে বড় লিড নেওয়াতে পারেন, তখন অনেক কিছুই সেই জোয়ারের তলায় চাপা পড়ে যাবে!

প্রথম দিনের স্কোর

শ্রীলঙ্কা
প্রথম ইনিংস

করুণারত্নে ক রাহানে বো ইশান্ত ৯

সিলভা ক ধবন বো অ্যারন ৫

থিরিমান্নে ক রাহানে বো অশ্বিন ১৩

সঙ্গকারা ক রাহুল বো অশ্বিন ৫

ম্যাথেউজ ক রোহিত বো অশ্বিন ৬৪

মুবারক ক রাহুল বো অশ্বিন ০

চণ্ডীমল ক রাহানে বো অমিত ৫৯

প্রসাদ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ০

হেরাথ বো অশ্বিন ২৩

কৌশল ক রোহিত বো অমিত ০

প্রদীপ ন.আ. ০

অতিরিক্ত

মোট ১৮৩।

পতন: ১৫, ১৫, ২৭, ৫৪, ৬০, ১৩৯, ১৫৫, ১৭৯, ১৭৯।

বোলিং: ইশান্ত ১১-৩-৩০-১, অ্যারন ১১-০-৬৮-১,

অশ্বিন ১৩.৪-২-৪৬-৬, অমিত ৬-১-২০-২, হরভজন ৮-১-১৭-০।

ভারত

প্রথম ইনিংস

রাহুল এলবিডব্লিউ প্রসাদ ৭

ধবন ন.আ. ৫৩

রোহিত এলবিডব্লিউ ম্যাথেউজ ৯

কোহলি ন.আ. ৪৫

অতিরিক্ত ১৪

মোট ১২৮-২।

পতন: ১৪, ২৮।

বোলিং: প্রসাদ ৭-০-২২-১, প্রদীপ ৮-১-৩২-০, ম্যাথেউজ ৪-১-১২-১,

কৌশল ৮-০-৪১-০, হেরাথ ৭-১-১৫-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE