বাবা ভি উন্নিকৃষ্ণন চাষের জমিতে দিনমজুর। মা পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। বছর দেড়েক আগেও এ ভাবেই সংসার চলত তাঁদের।
কেরলের পালাক্কাদের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই পরিবারেরই সেজো মেয়ে পালাক্কিঝিল উন্নিকৃষ্ণন (পি ইউ) চিত্রাকেই এখন বলা হচ্ছে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের নতুন ট্র্যাকের রানি।
পর পর দু’টো এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ১৫০০ মিটার ইভেন্টে ভারতের হয়ে সোনা জিতেছেন। যে কৃতিত্ব নেই কোনও ভারতীয়ের। পি টি উষার রাজ্যের মেয়ে এই সাফল্যের দিনেও পরিবারের এক সময়ের দারিদ্রের কথা ভুলছেন না। ফোনে আনন্দবাজারকে চিত্রা বললেন, ‘‘দু’বছর আগে ভুবনেশ্বরে যখন সোনা পেয়েছিলাম এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে, তখনও আমার মা লোকের বাড়ি কাজ করতেন। বাবা চাষের মাঠে দিনমজুর। ছ’জনের সংসার চলত পাঁচ-ছ’ হাজার টাকায়।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘এমনও দিন গিয়েছে, যখন অর্থের অভাবে এক বেলা খেয়েছি আমরা। এ বার দোহা থেকে ফের সোনা জেতার পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফোন করে গেজেটেড অফিসারের চাকরি দেবেন বলেছেন। মনে হচ্ছে পরিশ্রমটা সার্থক।’’
চাকরি অবশ্য গত বছর এশিয়ান গেমসে ১৫০০ মিটারে ব্রোঞ্জ পাওয়ার পরেই পেয়েছিলেন চিত্রা। ভারতীয় রেলে কেরানির চাকরি। কিন্তু অলিম্পিক্সের প্রস্তুতির জন্য জাতীয় শিবিরে থাকতে হবে বলে সেখান থেকে এক বছর ছুটি নিয়েছেন তিনি। তবে মাসিক রোজগারের সুরাহা হওয়ায় বাবার কাজ বন্ধ করে দেন। সগর্বে চিত্রা বলেন, ‘‘মাকেও এখন লোকের বাড়ি গিয়ে পরিচারিকার কাজ করতে হয় না।’’
চিত্রার আদর্শ পি টি উষা। যদিও তাঁর কাছে অনুশীলন করেননি কখনও। তিনি পালাক্কাদের বিখ্যাত অ্যাথলেটিক্স কোচ সৃজিন এন এস-এর আবিষ্কার। সেই সৃজিন স্যরও বলছেন, ‘‘মেয়েটাকে এতদূর নিয়ে এসেছে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও তাগিদ। কোনও দিন অনুশীলনে ফাঁকি দিত না। এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ পাওয়ার পরে খুব মুষড়ে পড়েছিল। এ বার দোহায় যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, সোনা নিয়েই ফিরবে। সেটা ও ঠিক করে দেখিয়েছে।’’
কী ভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন চিত্রাকে? সৃজিন বলেন, ‘‘মুন্দুর হাইস্কুলে পড়ত চিত্রা। আমি সেই স্কুলেরই অ্যাথলেটিক্স কোচ। ও যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, তখন আমাদের এক ছাত্রী স্কুল গেমসে সোনা পেয়েছিল। ওকে স্কুল ও রাজ্য সরকার সংবর্ধনা দেয়। যা দেখে চিত্রা দু’দিন পরেই আমাকে এসে বলে। ও অ্যাথলিট হতে চায়।’’ বলে চলেন তিনি, ‘‘ওর আগ্রহের কারণটা যদিও ছিল আলাদা। চ্যাম্পিয়ন হওয়া ওই মেয়েটি সাইয়ের বৃত্তি হিসেবে প্রত্যেক দিন ২৫ টাকা করে পেত। এ ছাড়া মাসে ৬০০ টাকা রাজ্য সরকারের তরফে দেওয়া হত ওর পরিবারকে। এটা জানতে পেরেই চিত্রা আমার কাছে অ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিল। প্রথম সপ্তাহ অনুশীলন করিয়েই বুঝেছিলাম, মেয়েটার গতি বেশ ভাল। দূরপাল্লার দৌড়ের জন্য জন্মগত প্রতিভা।’’
চিত্রাও তাঁর শুরুর দিনগুলোর জন্য ধন্যবাদ দেন তাঁর সৃজিন স্যরকে। মালয়ালম ছবির অভিনেতা মোহনলাল ও চিকেন চেত্তিনাদের ভক্ত বলেন, ‘‘স্যার শুরুতে আমাকে ১৫০০, ৩০০০, ৫০০০ মিটার ক্রস কান্ট্রিতে নামাতেন। সাত বছর আগে পুণেতে জাতীয় স্কুল গেমসে ক্রস কান্ট্রি বাদে সব বিভাগেই সোনা জিতেছিলাম। তার পরে ২০১৩ সালে এশিয়ান স্কুল গেমসে একই ফল হয়। ২০১৬ সালে জাতীয় গেমসে অংশ নিয়ে দেড় হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার মিটারে সোনা জিতি। সেখান থেকেই জাতীয় কোচের নজরে পড়ি।’’
তা হলে ১৫০০ মিটারের বিশেষজ্ঞ হলেন কী ভাবে? চিত্রা বলেন, ‘‘২০১৫ সালের পরেই অন্য ইভেন্টে প্রতিযোগী বেশি বলে সৃজিন স্যর আমাকে ১৫০০ মিটারে মনোনিবেশ করতে বলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার পিছনে উনি সময় দিয়েছেন নিখুঁত করার জন্য।’’
দু’বছর আগে ভুবনেশ্বরে ৪ মিনিট ১৭.৯২ সেকেন্ড সময় করে সোনা জিতেছিলেন চিত্রা। এ বার দোহায় বাহরিনের দুই অ্যাথলিটকে হারিয়ে চিত্রা সোনা জিতেছেন ৪ মিনিট ১৪.৫৬ সেকেন্ড সময় করে। দু’বছরে এই সময় কমানোর নেপথ্য কাহিনিও চমৎকার। চিত্রা বলছেন, ‘‘এশিয়ান গেমসের আগে চোট ছিল। প্রস্তুতি ভাল হয়নি। ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। তার পরে পি টি উষার সঙ্গে একদিন দেখা করেছিলাম।’’ তিনিই বলেন, সময়টা অনুশীলনে ৪.০৬ মিনিটে নামিয়ে আনতে। শেষ ১৫০ মিটারে পুরো গতি প্রয়োগ করতে। তাতেই সাফল্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy